গ্লেন ম্যাক্সওয়েল যখন ক্রিজে এলেন, হ্যাটট্রিকের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আজমাতউল্লাহ ওমারজাই। তিনশর কাছাকাছি লক্ষ্য তাড়ায় পঞ্চাশের আগে চার ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে তখন বিপদে অস্ট্রেলিয়া। হ্যাটট্রিক বলে এলবিডব্লিউয়ের আবেদন হলো, আম্পায়ার সাড়া দিলেন না, আফগানিস্তান রিভিউ নিল। বল প্যাডে নয়, ব্যাটে লাগায় বেঁচে গেলেন ম্যাক্সওয়েল। এরপর তিনি বল খেললেন আরও ১২৭টি। আর রান? ২০১ নট আউট!
মুম্বাইয়ে মঙ্গলবার রাতে ঝড়-টর কিছু ছিল না। তবে আরব সাগরের কাছে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে যেন বয়ে যায় টর্নেডো, ম্যাক্সওয়েলের ব্যাটে। ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে আর চোটের বাধা এড়িয়ে যেভাবে তিনি আফগানিস্তানের বোলারদের কচুকাটা করলেন, অষ্টম উইকেটে দুইশ ছাড়ানো জুটিতে দলকে অবিশ্বাস্য জয় এনে দিলেন- অতিমানবীয়, অকল্পনীয় শব্দগুলিও হয়তো ক্লিশে শোনাবে।
দলের বিপদের মুখে শুধু ক্রিজে যাওয়াই নয়, ম্যাক্সওয়েলকে এক পাশে রেখেই বিদায় নেন অস্ট্রেলিয়ার আরও তিন ব্যাটসম্যান। ২৯২ রানের লক্ষ্য তাড়ায় ৯১ রানে ৭ উইকেট হারানো অস্ট্রেলিয়ার হার তখন মনে হচ্ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার। বিশ্বকাপে নিজেদের সর্বনিম্ন রানে গুটিয়ে যাবে কি-না, সবচেয়ে বড় পরাজয়ের তেতো স্বাদ পাবে কি-না, ঘাটতে হচ্ছিল কত পরিসংখ্যান।
৯১/৭ থেকে খানিক পর অস্ট্রেলিয়ার স্কোর হয়ে যেতে পারত ১১২/৮। কিন্তু শর্ট ফাইন লেগে ম্যাক্সওয়েলের যে ক্যাচটা মুজিব উর রহমানের হাত ফসকে বেরিয়ে গেল, রিপ্লে দেখলে মুজিব নিজেও বিব্রত হবেন।
ওই ওভারের শুরুতে ম্যাক্সওয়েল বেঁচে যান আরও এক দফা। এলবিডব্লিউয়ের আবেদনে আম্পায়ার আঙুল তুলে দেওয়ার পর রিভিউ নিয়ে রক্ষা হয় তার। প্রথমবারে তার রান ছিল ২৭, পরেরবার ৩৩।
এরপর আর সেভাবে আফগানিস্তানকে সুযোগই দেননি তিনি। চলতি আসরে আগেই বিশ্বকাপের রেকর্ড ৪০ বলে শতক করে ফেলেছেন নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। এবার দ্বিতীয় শতকটি করতে তার লেগে যায় অবশ্য ৭৬ বল।
‘শতক করলে বিশ্বকাপেই করব’, ম্যাক্সওয়েলের দর্শন যেন এটিই। তার চার ওয়ানডে শতকের তিনটিই যে হয়ে গেল বিশ্ব মঞ্চে!
শতক ছোঁয়ার আগেই শরীর বেঁকে বসে তার। টান লাগে পায়ের মাংসপেশিতে। পরে তা জোরাল হয় আরও। একবার একটি সিঙ্গেল নেওয়ার পর তো শুয়ে পড়ে রীতিমতো কাতরাতে শুরু করে দেন ম্যাক্সওয়েল। ফিজিওকে মাঠে ছুটে আসতে হয় কয়েক দফা। অ্যাডাম জ্যাম্পা ব্যাটিংয়ে নামার জন্য ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়েও যান কয়েকবার।
তবে ম্যাক্সওয়েল দমে যাননি। পড়ে গেছেন, আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। জানতেন, জিততে হলে মূল কাজটা করতে হবে তাকেই। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রান নিয়ে প্রান্ত বদলেছেন, কখনও এক পায়ে দাঁড়িয়েই বল আছড়ে ফেলেছেন গ্যালারিতে। প্যাট কামিন্সকে এক পাশে দর্শক বানিয়ে রেখে দলকে পৌঁছে দিয়েছেন চূড়ান্ত লক্ষ্যে।
পরিসংখ্যানই যেমন বলছে, ওয়ানডেতে অষ্টম উইকেটে বিশ্ব রেকর্ড ২০২ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে ম্যাক্সওয়েলের একার অবদানই ১৭৯!
তার ১০ ছক্কা ও ২০ চারে গড়া ১২৮ বলে অপরাজিত ২০১ রানের এই ইনিংসে রেকর্ডও হয়েছে একগাদা।
ওয়ানডে ইতিহাসে রান তাড়ায় কোনো ব্যাটসম্যানের প্রথম দ্বিশতক, ছয় নম্বরে বা এর নিচে নেমে সর্বোচ্চ ইনিংস, এই সংস্করণে অস্ট্রেলিয়ার কারও প্রথম দ্বিশতক- সবকিছুই এখন ম্যাক্সওয়েলের।
রেকর্ড হয়েছে আরও। তবে এসব তো কেবলই সংখ্যাতত্ত্ব। ধ্বংসযজ্ঞ থেকে যেভাবে লড়াই করেছেন ম্যাক্সওয়েল, খাদের কিনারা থেকে দলকে যেভাবে টেনে তুলেছেন, চোখে-মুখে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে যে দৃঢ়তায় লড়ে গেছেন শেষ পর্যন্ত, তা সত্যিই অতিমানবীয়।
২২ গজে ব্যাট হাতে স্মরণীয়, রোমাঞ্চকর এক গল্প লিখলেন গ্লেন জেমস ম্যাক্সওয়েল।