‘কোহলি… কোহলি… কোহলি…’, স্লোগান আর গর্জনে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম যেন কাঁপছিল। ইউনিসেফের দূত হিসেবে মাঠে আসা ফুটবল তারকা ডেভিড বেকহ্যাম, এর চেয়েও বড় স্টেডিয়াম, বড় উপলক্ষ আর বেশি দর্শকের সামনে অনেক খেলেছেন যিনি, তিনিও চমৎকৃত হয়ে চারপাশে দেখছিলেন। ফুটবল, ক্রিকেট, চলচ্চিত্র, সব আঙিনার কত তারকা মাঠে! সবাই রোমাঞ্চ নিয়ে অপেক্ষায়, মুহূর্তটি কখন আসে!
ভিরাট কোহলির রান তখন ৯৮। অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হলো না খুব একটা। শতরান ছুঁয়ে তিনি উড়াল দিলেন। লাফিয়ে যেন ছুঁতে চাইলেন আকাশ। এমন উদযাপন তিনি কতবারই তো করেছেন। তবে এ দিনের মতো মানিয়ে যায়নি আর কখনোই। সত্যিই তো তিনি ছাড়িয়ে গেলেন আকাশের সীমানা!
৫০টি ওয়ানডে সেঞ্চুরি। যে সংখ্যার ছবি আগে কেউ আঁকতে পারেননি, যে উচ্চতায় আগে কারও পা পড়েনি, সেই চূড়ায় পৌঁছে গেলেন আধুনিক ক্রিকেটের অবিসংবাদিত সম্রাট।
রেকর্ড, মাইলফলক, ইতিহাস-এসব তো কতই গড়া হয় ক্রিকেটে। কোহলির ৫০ সেঞ্চুরির মুহূর্তটি যেন ছাড়িয়ে গেল সবকিছুকে। দর্শকে ঠাসা গ্যালারি উল্লাসে ফেটে পড়ছে, একজনও বসে নেই। উড়ন্ত চুম্বন ছুড়ে দিলেন তার প্রেয়সী আনুশকা শার্মা। বেকহ্যাম তালি দিচ্ছেন, হার্দিক পান্ডিয়া, ইউজবেন্দ্র চেহেলরা তালি দিচ্ছেন, শাহিদ কাপুর-ভিকি কৌশাল… আরও কত কত তারকা। আর একজন মহাতারকা। সাচিন টেন্ডুলকার!
যার রেকর্ড ছাড়িয়ে গেলেন কোহলি, সেই টেন্ডুলকার হাত উঁচিয়ে তালি দিয়েই যাচ্ছেন মুখে চওড়া হাসি নিয়ে। কোহলির চোখ গেল সেদিকে। গ্লাভস খুলে, ব্যাট ফেলে হাঁটু গেড়ে কুর্নিশ করলেন তার নায়ককে। যেন বোঝাতে চাইলেন, রেকর্ডে ছাড়িয়ে গেলেও শ্রেষ্ঠত্বে আর সম্মানে নয়!
শ্রেষ্ঠত্বের বিবেচনা করবে মহাকাল। আপাতত এই মুহূর্তটায় থাকা যাক।
দিল্লির যে কিশোর ক্রিকেটের পথে ছোটার স্বপ্ন দেখেছিলেন টেন্ডুলকারকে দেখে, যে ছেলেটি প্রতি রাতে ঘুমাতে যেত আর ঘুম থেকে জেগে উঠত টেন্ডুলকারের মতো হবে বলে, সেই ছেলেটিই আজ তার নায়ককে স্বাক্ষী রেখেই তাকে ছাড়িয়ে গেল সেঞ্চুরিতে!
সেটিও কোন দিনে?
৩৪ বছর আগে ঠিক যে দিনটিতেই অমরত্বের পথে যাত্রা শুরু করেছিলেন টেন্ডুলকার, গোটা দেশের প্রত্যাশা নিজের ভারী ব্যাটে বইতে শুরু করেছিলেন মুম্বাইয়ের ১৬ বছর বয়সী কিশোর, যে দিন থেকে রেকর্ড আর পরিসংখ্যানের অবিশ্বাস্য উচ্চতায় শুরু হয়েছিল তার আরোহণ, ঠিক সেই দিনেই তার গৌরবময় এক রেকর্ড নিজের করে দিলেন তারই উত্তরসূরি।
ভারতীয় ক্রিকেটে, বিশ্ব ক্রিকেটেও ১৫ নভেম্বর এক বিশেষ তারিখ হয়ে আছে টেন্ডুলকারের আন্তর্জাতিক অভিষেকের দিন বলে। সেই দিনটিই এখন নতুন মহিমা পেয়ে গেল টেন্ডুলকার-কোহলির সংযোগে।
টেন্ডুলকারের ঘরের মাঠে তার সামনেই তার আন্তর্জাতিক অভিষেকের দিনেই তাকে ছাড়িয়ে গেলেন কোহলি- এসব মুহূর্তকেই বলা হয়, ‘It was written in the stars.’
রেকর্ড শুধু এই একটি?
২০০৩ বিশ্বকাপে টেন্ডুলকারের ৬৭৩ রানও একটি ‘আইকনিক’ সংখ্যা হয়েই ছিল এত দিন। বিশ্বকাপের এক আসরে সর্বোচ্চ রান। চারটি বিশ্বকাপ অক্ষত থাকার পর সেই রেকর্ড এখন কোহলির। ওয়ানডে বিশ্বকাপ প্রথমবার দেখতে পেল, একজন ব্যাটসম্যান একাই করতে পারেন সাতশ রান (৭১১)।
ওপেনিং ছাড়া অন্য পজিশনে সাকিব আল হাসানর রেকর্ড ৬০৬ রান পড়ে গেল কতটা পেছনে! টেন্ডুলকার আর সাকিবের যৌথ রেকর্ড, এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি পঞ্চাশ ছোঁয়া ইনিংস (৭টি) পেরিয়ে কোহলি এবার নিয়ে গেলেন আটে।
এই ৩৫ বছর বয়সে ক্যারিয়ার টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম থাকে কত ক্রিকেটারের, কতজনেরই তো নেমে আসে গোধূলি বেলা। কোহলির ক্যারিয়ার সূর্য যেন মধ্যগগণে।
রেকর্ড আর উপলক্ষ ছাড়িয়ে গেছে আসলে সবকিছুকে। তবে এ দিন নিজের সঙ্গে একটি বোঝাপড়ার ব্যাপারও তার ছিল। কিছুটা তাগিদ ছিল জবাব দেওয়ার। অভাবনীয় সব অর্জনে সমৃদ্ধ ক্যারিয়ারেও তো কিছু অপূর্ণতা থাকে। কিছু ঘাটতির ছাপ থাকে। কোহলির ক্যারিয়ার বলছিল, বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে তিনি ব্যর্থ বারবার।
২০১১ বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে আউট হয়ে যান ৯ রান করে। তখনও তিনি তরুণ, বড় তারকা নন, দলের বড় ভরসা নন। তাই বড় করে ফুটেও ওঠেনি তা। কিন্তু ২০১৫ আর ২০১৯ বিশ্বকাপে তো তার ব্যাটে তাকিয়ে ছিল দল। কিন্তু দুবারই আউট হন স্রেফ ১ রান করে।
এমন ঝকঝকে ক্যারিয়ারে এটুকু কালির দাগও বা কেন থাকবে!
এবার তিনি মুছে দিলেন।
গোটা বিশ্বকাপে তিনি যেভাবে খেলছেন, এই ইনিংসটিও গড়েছেন ঠিক সেভাবেই। দারুণ নিয়ন্ত্রিত। গোছানো। এক প্রান্তে হাল ধরে রাখা, খুব ঝুঁকি না নিয়ে রান রেট ঠিক রাখা, সুযোগ পেলে চড়াও হওয়া। এই বিশ্বকাপে এই ভূমিকাই দল থেকে দেওয়া হয়েছে তাকে। তিনি সানন্দে লুফে নিয়েছেন। এই ইনিংসে যেমন দেখালেন আরও একবার।
সপ্তাহ দুয়েক আগেও এই মাঠে তার জন্য একটি উপলক্ষ ছিল তৈরি। ওয়াংখেড়েতে সাচিন টেন্ডুলকারের ভাস্কর্য উন্মোচন করা হলো সেদিন। তিনি নিজেও ছিলেন মাঠে। গোটা ভারত অপেক্ষায় ছিল টেন্ডুলকারের মাঠেই তার ৪৯ ওয়ানডে সেঞ্চুরির রেকর্ড স্পর্শ করবেন কোহলি।
কিন্তু সেদিন সেঞ্চুরি থেকে স্রেফ ১২ রান দূরে থমকে যান।
দুদিন পরই সেই দূরত্বটুকু তিনি ঘুচিয়ে ফেলেন। সেটিও দারুণ এক উপলক্ষেই। নিজের জন্মদিনে কলকাতায় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেঞ্চুরিতে স্পর্শ করলেন নায়কের কীর্তি।
জীবন আর ক্যারিয়ারের এমন পর্যায়ে উপলক্ষগুলোও যেন রঙিন হয়ে উঠতে চায় কোহলির রঙে!
নইলে গত রোববার বেঙ্গালুরুতেও তো রেকর্ডটি গড়তে পারতেন কোহলি। প্রতিপক্ষ ছিল নেদারল্যান্ডস, ফিফটিও পেরিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন থমকে গেলেন ৫১ রানেই। ওই যে, তার জন্য আদর্শ মঞ্চ তো প্রস্ততই ছিল!
ভাবতে পারেন, এমন উপলক্ষ, এমন সময়, এমন মুহূর্ত কেবল স্বপ্নেই আসে। কিন্তু কোহলিরা তো এমনই, ঘুচিয়ে ফেলেন স্বপ্ন আর বাস্তবের সীমানা।
তিনি নিজেও যে অভিভূত, তা লুকালেন না ইনিংস বিরতিতে ব্রডকাস্টারদের সঙ্গে আলোচনায়।
“গ্রেট মানুষটি (টেন্ডুলকার) নিজে আমাকে অভিনন্দন জানালেন… সত্যি বলতে, সবকিছু আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। অবাস্তব লাগছে… কখনোই ভাবিনি, আমার ক্যারিয়ারে আমি আজকের এই জায়গায় আসব।”
“যেটি বললাম, এসব স্বপ্নের মতো… আনুশকা বসে আছে ওখানে, সাচিন পাজি (বড় ভাই) আছেন গ্যালারিতে… আমি জানি না… আমার জন্য ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন। যদি আদর্শ কোনো ছবি আঁকতে বলা হতো, আমি এমন কিছুই চাইতাম। আমার জীবনসঙ্গিনী, যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি (আনুশকা), সে বসে আছে ওখানে। আমার নায়ক (টেন্ডুলকার) আছেন ওখানে। আমি পঞ্চাশের দেখা পেলাম তাদের সামনে, এত এত সমর্থক এবং ওয়াংখেড়েতে, এরকম ঐতিহাসিক ভেন্যুতে… সব মিলিয়ে অসাধারণ।”
জীবন নাকি কখনও রূপকথা হয় না। কোহলিকে দেখুন। উত্তরটা পেয়ে যাবেন।
প্রতিভা, পরিশ্রম, নিবেদন, একাগ্রতা, আবেগ, আকাঙ্ক্ষা আর তাড়না- সবকিছু যদি এক বিন্দুতে মেলে, তাহলে তাকে কোহলি বলে। কিংবা বলে রূপকথা।