বিশ্বকাপের টুর্নামেন্ট সেরা হওয়ার লড়াই এবার জমে উঠেছে দারুণ, শেষ পর্যন্ত সম্ভাবনায় এগিয়ে কে।
Published : 18 Nov 2023, 06:41 PM
দল হিসেবে বাংলাদেশের বাস্তবতা গত বিশ্বকাপের মতোই। ফাইনালের ত্রিসীমানায় নেই তারা। তবে গত বিশ্বকাপে ফাইনালের আগে খানিকটা হলেও উপস্থিতি ছিল বাংলাদেশের, যদি ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট হন সাকিব আল হাসান! সম্ভাবনা যদিও খুবই সামান্য ছিল, তবু কিছু আলোচনা ছিল। এবার সেটুকুও নেই। ফাইনালে ওঠা দুই দল, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের ক্রিকেটাররাই আছেন মূলত টুর্নামেন্ট সেরা হওয়ার লড়াইয়ে।
বিশ্বকাপ ১৯৭৫ সাল থেকে শুরু হলেও ম্যান অব দা টুর্নামেন্টের পুরস্কার দেওয়া শুরু হয় ১৯৯২ আসর থেকে। টুর্নামেন্টজুড়ে অসাধারণ ব্যাট করে সেবার সেরা হন নিউ জিল্যান্ডের কিংবদন্তি মার্টিন ক্রো। এরপর অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে ১৯৯৬ বিশ্বকাপের সেরা হন সানাৎ জায়াসুরিয়া, ম্যাচ জেতানো দুর্দান্ত সব ইনিংসের সঙ্গে কার্যকর বোলিং মিলিয়ে ১৯৯৯ সালের সেরা ল্যান্স ক্লুজনার, বিশ্বকাপে রানের রেকর্ড গড়ে ২০০৩ আসরের সেরা সাচিন টেন্ডুলকার, উইকেটের রেকর্ড গড়ে ২০০৭ আসরের সেরা গ্লেন ম্যাকগ্রা, অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে ভারতকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে ২০১১ সালের সেরা ইউভরাজ সিং, আগুনে পেস বোলিংয়ের প্রদর্শনীতে ২০১৫ বিশ্বকাপে এই স্বীকৃতি পান মিচেল স্টার্ক আর গত বিশ্বকাপে ধারাবাহিক ব্যাটিংয়ের সঙ্গে দুর্দান্ত নেতৃত্ব দিয়ে সেরা হন কেন উইলিয়ামসন।
এবার সেরার লড়াই জমে উঠেছে দারুণ। বেশ কয়েকজনই আছেন এই স্বীকৃতি পাওয়ার মতো। ফাইনালের পারফরম্যান্স ও দলের ফল শেষ পর্যন্ত পার্থক্য গড়ে দিতে পারে সেরা নির্ধারণে। দেখে নেওয়া যেতে পারে ফাইনালের আগ পর্যন্ত তাদের পারফরম্যান্স।
মোহাম্মদ শামি
টুর্নামেন্টের প্রথম চার ম্যাচ তার কেটেছে ডাগআউট গরম করে আর পানি-তোয়ালে টেনে। তখন কে ভাবতে পেরেছিল, এই বিশ্বকাপেই তাকে সামলানোর ভাবনায় ঘুম হারাম হবে প্রতিপক্ষের আর তিনি হয়ে উঠবেন টুর্নামেন্ট সেরার দাবিদার!
হার্দিক পান্ডিয়ার চোটে ভারত একাদশের ভারসাম্য বদলে ফেলাতেই মূলত সুযোগটা পেয়েছিলেন মোহাম্মদ শামি। এরপর স্রেফ লুফে নেননি, একের পর এক ব্যাটিং লাইন আপ স্রেফ চুরমার করে দিয়েছেন।
এবারের বিশ্বকাপে প্রথম খেলতে নেমে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ধারামশালায় নেন ৫ উইকেট। পরের ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লক্ষ্নৌতে ৪টি, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়াংখেড়ে আবার তার শিকার ৫ উইকেট। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ইডেন গার্ডেন্সে নেন ২টি। সেমি-ফাইনালে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে তো রেকর্ড বইয়ে তোলপাড় ফেলে দিয়ে শিকার করেন ৭ উইকেট। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে কীভাবে উইকেট পেলেন না, ভাবলে সেটিই এখন বিস্ময়কর লাগে!
ভারতের প্রথম বোলার হিসেবে বিশ্বকাপে ৫০ উইকেট পূর্ণ করেছেন এই আসরেই, বিশ্বকাপ ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুততায় পৌঁছেছেন এই মাইলফলকে। এক বিশ্বকাপে তিনবার ৫ উইকেট শিকারের অনন্য কীর্তিও গড়েছেন। সব মিলিয়ে এবারের আসরে স্রেফ ৬ ম্যাচে তার শিকার ২৩ উইকেট। টুর্নামেন্টে তার গড় ৯.১৩, প্রতি ১০.৯ বলে উইকেট নিয়েছেন একটি করে-সবই অবিশ্বাস্য পরিসংখ্যান।
স্রেফ পরিসংখ্যানেই নয়, দুর্দান্ত সুইং, নিখুঁত লাইন কার্যকর বাউন্সার ও স্কিল মিলিয়ে ব্যাটসম্যানদের আতঙ্ক হয়ে উঠেছেন তিনি।
ফাইনালের উইকেটে অবশ্য পেসারদের সহায়তা খুব একটা থাকার কথা নয়। তবে শামির স্কিলও তো কম নয়! রানবন্যার বিশ্বকাপে তাই স্রেফ ৭ ম্যাচ খেলেই সেরা হতে পারেন শামি।
ভিরাট কোহলি
ফাইনালের আগ পর্যন্ত টুর্নামেন্ট সেরা হওয়ার সম্ভাবনায় সম্ভবত সবচেয়ে এগিয়ে তিনিই। আগে থেকেই তিনি ছিলেন ক্রিকেট বিশ্বের মহাতারকা। এই বিশ্বকাপে হয়ে উঠেছেন আরও দীপ্তিময়। অর্জনে সমৃদ্ধ ক্যারিয়ারে তার রেকর্ড-কীর্তি কম নেই। এই বিশ্বকাপেও গড়েছেন একগাদা রেকর্ড। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যটি নিঃসন্দেহে, প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে এক বিশ্বকাপে ৭০০ রান স্পর্শ করা।
ভিরাট কোহলির এটি চতুর্থ বিশ্বকাপ। প্রতিবারই ছাড়িয়ে গেছেন নিজেকে। ২০১১ বিশ্বকাপে ৯ ম্যাচে ৩৫.২৫ গড়ে করেছিলেন ২৮২ রান। পরের বিশ্বকাপে ৫০.৮৩ গড়ে ৩০৫ রান করেন ৮ ইনিংসে। গত বিশ্বকাপে ৯ ইনিংসে করেন ৪৮২ রান ৫৫.৩৭ গড়ে। এবার শুধু নিজেকেই নয়, ছাড়িয়ে গেছেন বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবাইকেই।
ফাইনালের প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়াই ছিল এবারের আসরে ভারতের প্রথম প্রতিপক্ষ। সেই ম্যাচে চাপের মধ্যে ৮৫ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংস দিয়ে কোহলির শুরু। আফগানদের বিপক্ষে অপরাজিত থাকেন ৫৫ রানে, বাংলাদেশের বিপক্ষে করেন অপরাজিত সেঞ্চুরি, নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে শতরান ছুঁতে পারেননি ৫ রানের জন্য, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে থমকে যান সেঞ্চুরির ১২ রান দূরে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেই ছাড়েন, তিন অঙ্ক স্পর্শ করেন সেমি-ফাইনালে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে। মাঝে নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে করেন ফিফটি।
সব মিলিয়ে ১০ ইনিংসে ৩ সেঞ্চুরি ও ৫ ফিফটিতে রান ৭৭১, গড় ১০১.৫৭। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শূন্য রানে না ফিরলে রেকর্ড তার সমৃদ্ধ হতো আরও। ফিফটি পাননি আর কেবল পাকিস্তানের বিপক্ষে (১৬)।
এক বিশ্বকাপে আগের সর্বোচ্চ ছিল ২০০৩ আসরে সাচিন টেন্ডুলকারের ৬৭৩ রান। সেটি তো ছাড়িয়ে গেছেনই কোহলি, নিজের নায়কের ৪৯ ওয়ানডে সেঞ্চুরির রেকর্ড ছাড়িয়ে শতকের অর্ধশতক ছুঁয়েছেন এই বিশ্বকাপেই।
বয়স তার পেরিয়ে গেছে ৩৫ বছর। অথচ ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে আছেন যেন! অবশ্য, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে গত এক যুগ ধরেই চলছে তার সেরা সময়।
বিশ্বকাপে রানের রেকর্ড আরও সমৃদ্ধ করার সুযোগ তার আছে ফাইনালে। সেক্ষেত্রে টুর্নামেন্ট সেরা হওয়ার সুযোগও বাড়বে।
রোহিত শার্মা
বিশ্বকাপ শুরু করেছিলেন তিনি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শূন্য রানে আউট হয়ে। পরের ম্যাচেই আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলেন ১৩১ রানের ইনিংস। এরপর আর সেঞ্চুরি পাননি, তবে রান করেছেন নিয়মিত। ফাইনালের আগে তার রান ৫৫ গড়ে ৫৫০। রান স্কোরারদের তালিকায় তিনি আছেন পাঁচ নম্বরে।
তারপরও রোহিত শার্মা টুর্নামেন্ট সেরার বিবেচনায় থাকবেন বেশ ভালোভাবেই। মূলত দুটি কারণে, প্রথম তার স্ট্রাইক রেট, দ্বিতীয় তার নেতৃত্ব।
এই বিশ্বকাপে তার স্ট্রাইক রেট ১২৪.১৫। এবারের আসরে অন্তত ৪০০ রান করা বাকি ১০ ব্যাটসম্যানের কারও স্ট্রাইক রেট তার ধারে কাছে নেই। এই বিশ্বকাপে নিজেকে নতুন করে চিনিয়েছেন তিনি। এমনিতে বরাবরই আগ্রাসী হলেও সাধারণত শুরুতে একটু সময়ে নিয়ে পরে হাত খুলতেন তিনি। কিন্তু এই বিশ্বকাপে তার ভূমিকা বদলে যায়। শুরু থেকেই প্রতিপক্ষের ওপর চড়াও হওয়ার দায়িত্ব তার। সেই দায়িত্ব তিনি পালন করে আসছেন ম্যাচের পর ম্যাচ। শুরুতেই যেভাবে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলে দিচ্ছেন, এতেই ম্যাচের লাগাম অনেকটা নিয়ে নিচ্ছে ভারত। সেমি-ফাইনালে যেমন, নিউ জিল্যান্ডের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ট্রেন্ট বোল্টকে স্রেফ তুলাধুনা করে ছাড়েন তিনি।
তার নেতৃত্ব নিয়ে সমালোচনা ছিল কিছু। এবার বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত এখানেও তিনি প্রায় নিখুঁত। মাঠের ক্রিকেটে দারুণ কুশলী ও কৌশলী তিনি। মাঠের বাইরে গোটা দলকে করে তুলেছেন একটা সুখী পরিবারের মতো। ভারতের অপ্রতিরোধ্য পথচলায় যা রেখেছে বড় ভূমিকা।
ফাইনালে যদি জিতে যায় ভারত আর রোহিত যদি খেলতে পারেন একটি ভালো ইনিংস, টুর্নামেন্ট সেরার ট্রফিও উঠতে পারে তার হাতে।
অ্যাডাম জ্যাম্পা
এবারের বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হওয়ার লড়াইয়ে শামির সঙ্গে আছেন মূলত তিনিই। ১০ ম্যাচে তার উইকেট ২৩টি। কোনো ম্যাচে ৫ উইকেট না পেলেও ৪ উইকেট নিয়েছেন ৩ ম্যাচে।
খুব বিধ্বংসী বা জাদুকরি লেগ স্পিনার নন অ্যাডাস জ্যাম্পা। তবে দারুণ কার্যকর ও ধারাবাহিক। মাঝের ওভারগুলিতে উইকেট নেওয়া বা জুটি ভাঙায় তার জুড়ি নেই।
প্রথম দুই ম্যাচে হারের পরও যে অস্ট্রেলিয়া দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়াল, তাতে বড় অবদান তার। প্রথম দুই ম্যাচে তিনি উইকেট নিয়েছিলেন মোটে একটি। পরের তিন ম্যাচেই শিকার করেন ৪টি করে উইকেট। পরের দুই ম্যাচে ৩টি করে।
সেমি-ফাইনালটা অবশ্য তার ভালো কাটেনি। তবে ফাইনালে তো নিজেকে ফিরে পেতেই পারেন। সম্ভাব্য ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে তার ওপর দলের ভরসাও থাকবে অনেক।
অস্ট্রেলিয়াকে জিততে হলে ফাইনালে জ্যাম্পার ভালো করা জরুরি। আর এই দুটি যদি এক বিন্দুতে মিলে যায়, তাহলে তো জ্যাম্পা হতেই পারেন আসরের সেরা!
রাচিন রবীন্দ্র
সেমি-ফাইনাল থেকেই ছিটকে গেছে নিউ জিল্যান্ড। কিন্তু রাচিন রবীন্দ্রকে রাখতে হচ্ছে টুর্নামেন্ট সেরার বিবেচনায়। এটিই বলে দিচ্ছে, এবারের আসরটি কেমন কেটেছে নিউ জিল্যান্ডের তরুণ এই অলরাউন্ডারের।
কেন উইলিয়ামসন ফিট থাকলে হয়তো তিনি একাদশেই সুযোগ পেতেন না। হঠাৎ আসা সেই সুযোগটাই তিনি কাজে লাগান দারুণভাবে। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে তিনি টপ অর্ডারে ব্যাট করতেন। নিউ জিল্যান্ডের হয়ে টেস্ট ও ওয়ানডেতে সেই সুযোগ তার মিলছিল না। উইলিয়ামসন না থাকায় বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ এবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনে ব্যাট করার সুযোগ পান তিনি প্রথমবার। ম্যাচটি তিনি এমনভাবে রাঙিয়ে তোলেন যে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
ওই ম্যাচে করেছিলেন ৯৬ বলে অপরাজিত ১২৩। পরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১১৬ রানের ইনিংস খেলেন তিনি ১৩০ স্ট্রাইক রেটে, পাকিস্তানের বিপক্ষেও সেঞ্চুরি করেন প্রায় ১১৫ স্ট্রাইক রেটে।
সব মিলিয়ে ৬৪.২২ গড় ও ১০৬.৪৪ স্ট্রাইক রেটে ৫৭৮ রান তার। ফাইনালের আগ পর্যন্ত তা তৃতীয় সর্বোচ্চ। প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে আসা কোনো ব্যাটসম্যানের সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড তো গড়ে ফেলেছেন আগেই।
ব্যাটিংয়ে এমন পারফরম্যান্সের সঙ্গে বাঁহাতি স্পিনে নিয়েছেন ৫ উইকেট। ক্যাচ নিয়েছেন ৩টি। সব মিলিয়ে দারুণ অলরাউন্ড পারফরম্যান্স।
শেষ পর্যন্ত হয়তো অস্ট্রেলিয়া-ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিদের সঙ্গে তিনি পেরে উঠবেন না। তবে বিশ্বকাপ যে তার স্মরণীয় হয়ে থাকবে, সেই সংশয় নেই একটু্ও।