ম্যাচের প্রথম ভাগে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসের ‘টাইমড আউট’ এর রেশ শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের মধ্যে থাকল বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের পুরোটা সময়। এমনকি ম্যাচ শেষে মাঠ ছাড়ার সময়ও যেন ওই ঘটনা ভুলতে পারলেন না লঙ্কান ক্রিকেটাররা। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাত না মিলিয়েই ড্রেসিং রুমে চলে গেলেন কুশাল মেন্ডিস, ম্যাথিউসরা।
দিল্লির আরুন জেটলি স্টেডিয়ামে সোমবার নতুন এক ঘটনার সাক্ষী হয়েছে ক্রিকেট বিশ্ব। বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচে দেখা গেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম 'টাইমড আউট’ এর ঘটনা। যেটি ঘিরে ম্যাচের বাকি সময় তো বটেই, ম্যাচ শেষেও খানিকটা উত্তেজিত অবস্থায়ই দেখা গেছে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের।
রান তাড়ায় সাকিব আল হাসান ও নাজমুল হোসেন শান্তর গড়ে দেওয়া ভিতে দাঁড়িয়ে ম্যাচ শেষ করেন তাওহিদ হৃদয় ও তানজিম হাসান। ৪২তম ওভারে ম্যাথিউসের বলে লেগ বাই থেকে পাওয়া চারই ‘উইনিং শট’ হয়ে থাকে বাংলাদেশের। ম্যাচ হেরে মাঠ ছাড়ার সময় বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাত মেলাননি শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটাররা।
মাঠের বাইরে থাকা কোচিং স্টাফসহ অন্য ক্রিকেটাররা শুরুতে বাংলাদেশের কয়েকজন ক্রিকেটারের সঙ্গে হাত মেলান। ম্যাচ শেষ হওয়ার সময় ক্রিজে থাকা হৃদয়, তানজিমের সঙ্গেও হাত মেলাতে দেখা যায় লঙ্কানদের কয়েকজনকে। কিন্তু মাঠে থাকা বাকি ক্রিকেটাররা বাংলাদেশের বাকি কারও সঙ্গে হাত না মিলিয়েই ড্রেসিং রুমে চলে যান।
ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে এই বিষয়ে বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব বলেন, ‘(ম্যাচ শেষ হওয়ার পর) ওদের সঙ্গে কোনো কথাই হয়নি। আমরা (হাত) মেলাইনি না, ওরাই (ড্রেসিং রুমে) চলে গেছে।’
শ্রীলঙ্কার প্রতিনিধি হিসেবে সংবাদ সম্মেলনে আসেন ‘টাইমড আউট’ হওয়া ম্যাথিউস নিজেই। ম্যাচ শেষে হাত না মেলানোর বিষয়টি যে তাদের পরিকল্পিত ও দলীয় সিদ্ধান্ত, তা পরিষ্কার করেই জানান অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান।
“আপনি তাদেরই সম্মান করবেন, যারা আপনাকে সম্মান করে। তাদেরকে তো এই খেলাটিকে সম্মান করতে হবে। আম্পায়ারসহ আমরা সবাই এই সুন্দর খেলাটির শুভেচ্ছাদূত। তো আপনি যদি সম্মান না করেন এবং নিজের কান্ডজ্ঞান ব্যবহার না করেন, এর চেয়ে বেশি কী আশা করতে পারেন?”
বাংলাদেশের ৭ উইকেটে জয়ের ম্যাচে এমন উত্তেজনার শুরু শ্রীলঙ্কার ইনিংসের ২৫তম ওভারে। সাকিবের বলে আউট হন সাদিরা সামারাউইক্রামা। নতুন ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিজে যান ম্যাথিউস। প্রথম বল মোকাবিলা করার ঠিক আগ মুহূর্তে তার হেলমেট আঁটসাঁট করার চেষ্টায় একপ্রান্তের ফিতা ছিঁড়ে যায়।
এর মধ্যেই পেরিয়ে যায় ব্যাটিং শুরুর জন্য রাখা নির্ধারিত ২ মিনিট সময়। ফিতা ছিঁড়ে যাওয়ায় নিজ দলের ডাগ আউটে নতুন হেলমেট আনার জন্য বলেন ম্যাথিউস। ততক্ষণে বেশ কিছু সময় পেরিয়ে যাওয়ায় আম্পায়ারের কাছে টাইমড আউটের আবেদন করেন সাকিব। পরে নিয়মের মধ্যে থেকেই ম্যাথিউসকে আউট দেন আম্পায়ার।
ইনিংস বিরতিতে চতুর্থ আম্পায়ার আদ্রিয়ান হোল্ডস্টক ব্যাখ্যা করেন, হেলমেটের ফিতা ছেঁড়ার আগেই বেঁধে দেওয়া ২ মিনিট পার করে ফেলেন ম্যাথিউস। হেলমেট বদলাতে গিয়ে নষ্ট হয় আরও কিছু সময়। তাই সাকিবের আবেদনের ভিত্তিতে আউট দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সাকিবের কাছ থেকে আবেদনের ব্যাপারে নিশ্চয়তাও নেন মাঠের আম্পায়ার।
এমন আউটের পর স্বাভাবিকভাবেই ক্ষিপ্ত অবস্থায় মাঠ ছাড়েন ম্যাথিউস। সীমানা অতিক্রম করে তিনি মাটিতে আছড়ে ফেলেন নিজের হেলমেট। ড্রেসিং রুমে ঢোকার আগে বেশ উত্তেজিত অবস্থায়ই টিম স্টাফের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায় শ্রীলঙ্কার সাবেক অধিনায়ককে।
পরে বাংলাদেশের ইনিংসের শুরু থেকেই শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের শরীরী ভাষায় দেখা যায় বাড়তি ঝাঁজ। যে কোনো উইকেট বা ভালো ডেলিভারিতে যেন পুরো দল মিলেই শুরু করে স্লেজিং। দুই উইকেট পড়ার পর সাকিব ব্যাটিংয়ে নামলে আরও বেড়ে যায় স্লেজিংয়ের মাত্রা। এর নেতৃত্বে দেখা যায় ম্যাথিউসকে।
একাদশ ওভারে প্রথম আক্রমণে এসেই সাকিবকে আউটের সুযোগ তৈরি করেন ম্যাথিউস। তবে শর্ট কভারে ক্যাচ নিতে পারেননি চারিথ আসালাঙ্কা। পরে ঝড়ো ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশের জয়ের পথ সহজ করে সাকিব। শেষ পর্যন্ত সেই ম্যাথিউসের বলে আসালাঙ্কার হাতে ক্যাচ দিয়েই ফেরেন বাংলাদেশ অধিনায়ক।
সাকিবকে আউট করার পর ক্রিজে দাঁড়িয়ে নিজের হাতের দিকে ইঙ্গিত করেন ম্যাথিউস। নিজের টাইমড আউটের সঙ্গে মিলিয়েই যেন বোঝাতে চান, ‘এবার তোমার সময় শেষ হয়ে গেছে।’ এর বিপরীতে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি ৬৫ বলে ৮২ রানের ইনিংস খেলা সাকিব।
এর আগে-পরেও বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের স্লেজিং চালিয়ে যায় লঙ্কান ফিল্ডাররা। বেশ কয়েকবার উত্তরও দেন শান্ত-হৃদয়রা। আম্পায়ারের মধ্যস্থতায় কোনোবারই ঘটনা তেমন বড় হয়নি।
আর ম্যাচ শেষে হাত না মিলিয়ে অন্যরকম ঘটনার জন্ম দেয় শ্রীলঙ্কা। কেননা মাঠে যা কিছুই হোক না কেন, খেলা শেষ হওয়ার পর ক্রিকেটীয় ভদ্রতার খাতিরেই সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণে হাত মিলিয়ে নিজেদের বিবাদ মিটিয়ে নেন ক্রিকেটাররা। কিন্তু এবার তা করতে রাজি ছিল না শ্রীলঙ্কা।
অতীতেও ক্রিকেট মাঠে দেখা গেছে এই দুই দলের এমন উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা। ২০১৮ সালের নিদাহাস ট্রফিতে একটি বাউন্সারে নো বল না দেওয়াকে ঘিরে মাঠেই বিবাদে জড়ান দুই দলের ক্রিকেটাররা। এক পর্যায়ে সীমানার বাইরে থাকা অধিনায়ক সাকিব ক্ষিপ্ত অবস্থায় নিজ দলের দুই ব্যাটসম্যানকে চলে আসার জন্যও ডাকেন।
মাহমুদউল্লাহর শেষের ছক্কায় ওই ম্যাচ জিতে মাঠের মধ্যেই দলগত ‘নাগিন ড্যান্স’ দেন বাংলাদেশের ক্রিকেটার, টিম স্টাফরা। ওই ম্যাচের পর থেকে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার ম্যাচ সবসময়ই ছড়ায় বাড়তি উত্তেজনা। যা বিশ্বকাপে পেল নতুন মাত্রা।