নবজাগরণের আগে ক্রিকেটের কথা ভুলতে বসেছিল নামিবিয়ার মানুষ।
Published : 17 Oct 2022, 11:12 AM
“এবার শুধু পাশার দান উল্টে গেছে। এক বছর আগে যে অবস্থায় ছিলাম সেখান থেকে যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে ব্যাটিং-বোলিংয়ে নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি,” শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ইতিহাসগড়া জয়ের পর বলছিলেন নামিবিয়ার অধিনায়ক গেরহার্ড এরাসমাস।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের গত আসরে প্রথমবারের মতো খেলে নামিবিয়া। সে আসরেও তাদের প্রথম ম্যাচ ছিল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। তবে এবারের মতো জয় নিয়ে ফেরা হয়নি। মাত্র ৯৬ রানে অলআউট হয়ে ম্যাচ হেরেছিল ৭ উইকেটে। বছর ঘোরার আগেই সেই শ্রীলঙ্কাকে ৫৫ রানে হারিয়ে দেশের মানুষকে ঐতিহাসিক দিন উপহার দিল নামিবিয়া ক্রিকেট দল।
অথচ বছর পাঁচেক আগেও নামিবিয়ার ক্রিকেটের অবস্থা ছিল সঙ্গীন। কোনো পর্যায়েই ছিল না কোনো সাফল্য। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকেও তারা ছিল অনেক দূরে। বিশ্বকাপ বহু দূরে, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি মর্যাদাও ছিল না নামিবিয়ার। দেশের মানুষও ভুলতে বসেছিল ক্রিকেট খেলাটি কী!
সেখান থেকে সাবেক দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটারদের নিয়ে সাজানো কোচিং প্যানেলের হাত ধরে ক্রমেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে নামিবিয়ার ক্রিকেট। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে হেড কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেন পিয়েরে ডে ব্রুইন। নামিবিয়ার সাম্প্রতিক উত্থানের পেছনে বড় অবদান ধরা হয় তার।
ডে ব্রুইনে দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় একই সময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে নামিবিয়ার পরামর্শক হিসেবে যোগ দেন সাবেক প্রোটিয়া অলরাউন্ডার অ্যালবি মর্কেল। এখন তিনি রয়েছেন সহকারী কোচ হিসেবে। চলতি বিশ্বকাপের আগে বোলিং পরামর্শক হিসেবে যোগ দিয়েছেন আরেক দক্ষিণ আফ্রিকার তারকা মর্নে মর্কেল। নামিবিয়ার ক্রিকেটে এখন তাদের প্রভাব অনেক বেশি।
দলের তারকা অলরাউন্ডার ডেভিড ভিসা ও বাঁহাতি পেসার রুবেন ট্রাম্পলম্যানকে দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট থেকে বের করে নামিবিয়ায় খেলানোর পেছনে বড় অবদান রেখেছেন অ্যালবি মরকেল। দলকে এক সুতোয় গেঁথে রাখার কাজটি করেছেন ডে ব্রুইন আর মর্নে মরকেলের উপস্থিতি আধুনিক ক্রিকেটের সঙ্গে আরও পরিচিত করেছে নামিবিয়ার ক্রিকেটারদের।
২০০৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলেছিল নামিবিয়া। দীর্ঘ ১৮ বছরের বিরতির পর ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দিয়ে আইসিসি আয়োজিত টুর্নামেন্টে ফেরে তারা। শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে যাত্রা শুরু করলেও নেদারল্যান্ডস ও আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে জিতে প্রথম আসরেই সুপার টুয়েলভে জায়গা করে নেয় দলটি। যার সুবাদে এবারের আসরে সরাসরি খেলার সুযোগ পেয়েছে ‘ঈগলস’ নামে পরিচিত দলটি।
অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথমবারের মতো খেলতে নেমেই অভাবনীয় সাফল্য পেল এরাসমাসের দল। গত আসরে ৯৬ রানে গুটিয়ে যাওয়ার প্রতিশোধ নিয়ে এবার তারা শ্রীলঙ্কাকে অলআউট করেছে ১০৮ রানে। শুধু জয়ের ব্যবধান ৫৫ রানের দেখেই বোঝা যাবে না কতটা দুর্দান্ত পারফরম্যান্স ছিল নামিবিয়ার।
ব্যাটিংয়ে নেমে পাওয়ার প্লের মধ্যে ৩ উইকেট হারায় তারা। ইনিংসের ১৫ ওভারের মধ্যে ৯৫ রানে সাজঘরে ফিরে যান ছয় জন ব্যাটসম্যান। তবুও দমে না গিয়ে শেষ ৫ ওভারে ৬৮ রান এনে দেন ইয়ান ফ্রাইলিঙ্ক ও জেজে স্মিট। তাদের থামিয়ে রাখতে গতি কমিয়ে স্লোয়ার বোলিংয়ের দিকে মন দেয় শ্রীলঙ্কা।
জিলংয়ের অদ্ভুত আকৃতির মাঠে স্লোয়ার বোলিংয়ে বাউন্ডারি হাঁকানো দূরহ হয়ে যাওয়ায় সিঙ্গেলস-ডাবলসে মন দেন ফ্রাইলিঙ্ক। ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতা এ অলরাউন্ডার ২৮ বলে ৪৪ রান করার পথে চার মারেন মাত্র চারটি। বাকি ২৪ বল থেকে দৌড়েই ২৮ রান নেন তিনি। অন্যদিকে, নামিবিয়ার পরীক্ষিত পাওয়ার হিটার স্মিট দুইটি করে চার-ছয় হাঁকিয়ে করেন ১৬ বলে অপরাজিত ৩১ রান।
এ দুজনের ব্যাটে ১৬৩ রানের সংগ্রহ দাঁড় করায় নামিবিয়া। পরে বোলিংয়ে নেমে ৪০ রানের মধ্যে তুলে নেয় শ্রীলঙ্কার ৪ উইকেট। শুরুতে কোণঠাসা হয়ে পড়েও পাল্টা আক্রমণে ম্যাচ জেতার নজির সবশেষ এশিয়া কাপেও দেখিয়েছে শ্রীলঙ্কা। তা করার পথে উইকেট যতোই পড়ুক, বাউন্ডারি হাঁকিয়ে রানের চাকা সচল রাখার পথে হাঁটে লঙ্কানরা।
ঠিক সেই জায়গাটিতেই আঘাত করে নামিবিয়া। শ্রীলঙ্কারই দেখানো স্লোয়ার বোলিংয়ের পথে হেঁটে ৯.৪ থেকে ১৭.৩ ওভার পর্যন্ত টানা ৪৭ বল লঙ্কানদের কোনো বাউন্ডারি মারতে দেননি নামিবিয়ার বোলাররা। যা শ্রীলঙ্কার ওপর চাপ আরও বাড়ায়। এ সময়ের মধ্যে মাত্র ২৮ রান তুলতে পাঁচ উইকেট হারিয়ে ফেলে তারা, যা প্রায় নিশ্চিত করে দেয় নামিবিয়ার জয়।
ম্যাচ শেষে এরাসমাস বলছিলেন শ্রীলঙ্কার দেখানো পথে হেঁটেই সাফল্য পাওয়ার কথা।
“হ্যাঁ আমরাও শ্রীলঙ্কার ট্যাকটিকস অনুসরণ করেছি বলা যায়। তারা ভেবেছিল এটি কার্যকর হবে। কিন্তু ফ্রাইলিঙ্ক ও স্মিট অসাধারণ ব্যাট করেছে। পরে আমরা দেখলাম এই পরিকল্পনায় বোলিং করলে বাউন্ডারি হাঁকানো খুব কঠিন। তো আমাদের পরিকল্পনার বাস্তবায়নটা তাদের চেয়ে ভালো ছিল এবং লম্বা সময় ধরে করতে পেরেছি।”
লঙ্কানদের হারিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পূর্ণ সদস্য দেশের বিপক্ষে দ্বিতীয় (প্রথমটি আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে) জয় তুলে নিয়েছে তারা। যা এতদিন খেলেও করতে পারেনি বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের মতো দল। এক বছর আগে যে শ্রীলঙ্কার কাছে পাত্তাই পায়নি, এবার তাদেরকে হারিয়েই যাত্রা শুরুর বিষয়টি পাশার দান উল্টে যাওয়ার মতোই বলেছেন নামিবিয়ার অধিনায়ক।
“আমি মনে করি, গত বছরের সঙ্গে তুলনা করলে এবার পাশার দান উল্টে গেছে। এই ১২ মাসের ব্যবধানে আমরা নিজেদেরকে যথাযথভাবে প্রস্তুত করেছি। মাঠের ২০ ওভারের জন্য আমরা কঠোর পরিশ্রম করেছি। অস্ট্রেলিয়ার মাঠে কীভাবে খেলতে হবে তা বোঝার চেষ্টা করেছি। বাড়তি গতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পরিশ্রম করেছি। গত আসরের অভিজ্ঞতাও আমাদের কাজে লেগেছে।”
পাশার দান উল্টে জয় পেলেও এই আনন্দের জোয়ারে ভেসে যেতে রাজি নন এরাসমাস। বরং এই সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে আরও একবার বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভে খেলার ব্যাপারে আশাবাদী তিনি।
“এমন ঐতিহাসিক সাফল্যের পর আনন্দের আতিশয্যে খেই হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে। তাই এখান থেকে আমরা আবার নতুন শুরু করব। অবশ্যই সবাই এ সাফল্যে খুশি। শ্রীলঙ্কার মতো দেশকে বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে হারানো অনেক বড় বিষয়। তবে এখন উদযাপনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে পরের ম্যাচগুলোতে নজর দিতে চাই। আপাতত সুপার টুয়েলভই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।"