সেই ওলোঙ্গা, এই ওলোঙ্গা

জিম্বাবুয়ের এক সময়ের আলোচিত ক্রিকেটার, এখন পেশাদার গায়ক হেনরি ওলোঙ্গার সঙ্গে আড্ডায় উঠে এলো তার ক্রিকেট, তার জীবন, জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট ও চমকপ্রদ আরও অনেক অধ্যায়।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিঅ্যাডিলেইড থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Nov 2022, 02:39 PM
Updated : 11 Nov 2022, 02:39 PM

“আপনার চুলের এই অবস্থা কেন? সেই চুল কোথায়…!” অস্ফুটে মুখ থেকে এটুকু বেরিয়ে গেল হেনরি ওলোঙ্গাকে দেখেই। তার কথা ভাবলেই তো সেই বাহারি চুল আর স্টাইলিশ অবয়ব ভেসে ওঠে মনে! প্রশ্ন শুনে তার মুখে মৃদু হাসি, “চুল আছে তো, তবে রঙ বদলে গেছে। অনেকটা ধূসর এখন। বয়স হয়েছে না…!” 

বয়স হয়েছে বটে। তাকে দেখে আসলে নব্বই দশকের শেষভাগের নস্টালজিয়া পেয়ে বসেছিল মুহূর্তের জন্য। ওই সময়ের ক্রিকেটের যে রস আর রোমাঞ্চ, তখনকার প্রজন্ম তা এখনও হৃদয়ে লালন করে যত্ন নিয়ে। সেখানে ওলোঙ্গার জায়গাও আছে আলাদা করে। কিন্তু সময় তো আর থেমে নেই। ওলোঙ্গার বয়স এখন ৪৬। বেড়ে গেছে সবার বয়সই। 

তবে ওলোঙ্গার সেই উচ্ছ্বল ও প্রাণবন্ত চরিত্র মরে যায়নি। টুকটাক কুশলাদি বিনিময়ের পর সাবেক জিম্বাবুয়ে পেসারের সঙ্গে প্রায় ১ ঘণ্টা আনন্দময় হাবুডুবু চলল বর্তমান থেকে অতীতের স্রোতে। 

সৈকতে সঙ্গী 

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দুটি ম্যাচ ছাড়াও একটি সেমি-ফাইনাল অ্যাডিলেইডে। বাংলাদেশের সংবাদকর্মী হিসেবে এখানেই তাই ঠিকানা গড়তে হয়েছে বেশ কয়েক দিনের জন্য। ওলোঙ্গাও এই অঞ্চলের বাসিন্দা সাত বছর ধরে। 

ফোনে বার্তা চালাচালি চলছিল তার সঙ্গে। কয়েকদিনের নানা আলাপ শেষে তিনি সময় দিলেন একটি রেস্টুরেন্টে। 

অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে সুন্দর সৈকতগুলোর বেশ কয়েকটিকে ধারণ করে আছে রূপসী অ্যাডিলেইড। ওলোঙ্গার বাছাই করা ওই রেস্টুরেন্টও তেমনি একটি সৈকতে। শহরের কেন্দ্র থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে পোর্ট নোয়ালুঙ্গা। চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যের ছোঁয়ায় মন উদাস মুহূর্তেই। 

সম্বিত ফিরল তার ম্যাসেজ পেয়ে, “চলে আসছি, আর মিনিট পাঁচেক।” এবার নীল জলরাশি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বারবার পথের দিকে তাকানোর পালা। একটু পরই তার দেখা মিলল। 

‘এই এলাকার মধ্যে এই রেস্টুরেন্টই সম্ভবত সবচেয়ে ভালো’, বলতে বলতে তিনি রেস্টুরেন্টে ঢুকলেন, “আমি একটি লেমনেড নেব…।” এরপর লাঞ্চের প্রস্তাব দেওয়া হতেই তিনি সানন্দে রাজি। শুরুতে বেছে নিলেন সি ফুড প্ল্যাটার। পরে মত বদলে অর্ডার করলেন ফিশ অ্যান্ড চিপস। 

ঠিক সৈকত ঘেঁষেই সেই সি ফুড রেস্টুরেন্ট। ব্যালকনিতে বসে সাগরের তাজা হাওয়া আর আরামদায়ক রোদের উষ্ণতায় শুরু হলো আড্ডা। 

সুরের টানে তার নেশা 

১৯৯৮ সালে আইসিসি নক আউট বিশ্বকাপ খেলতে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন ওলোঙ্গা। পরে যে টুর্নামেন্ট পরিচয় বদলে হয়ে গেছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। পরের বছর আবার গিয়েছিলেন ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলতে। তিনি অবশ্য মনে করিয়ে দিলেন আরেক সফরের কথা। 

“এরপরও আরেকটি সফরে আমি গিয়েছি বাংলাদেশে। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় খেলেছি ২ টেস্ট। ব্রায়ান মার্ফি ছিল অধিনায়ক। নেটে আমি ওর হাত ভেঙে দিয়েছিলাম। ম্যাচের আগে গা গরমের সময় আমি বাউন্সার করি, ওর হাতে লাগে বল। বেচারা ছিটকে যায়। অনেক জোরে বল করতাম তখন। এখন আর পারি না…।” 

নিজের কৌতুকে হেসে উঠলেন নিজেই। এই মধ্য চল্লিশ পেরিয়ে তার জোরে বল করতে পারার কথাও নয়। তবে শুধু বয়সের কারণেই নয়, তিনি পারবেন না বাস্তবতার কারণেও। ক্রিকেটের জগত থেকেই যে এখন তিনি যোজন যোজন দূরে! 

এক সময়ের আলোচিত ফাস্ট বোলার, গতি ও বাউন্সে যিনি ব্যাটসম্যানদের কাঁপিয়ে দিতেন, প্রায়ই আবার লাইন-লেংথ হারিয়ে হয়ে যেতেন এলোমেলো, সেই তিনি এখন অন্য ভূবনের বাসিন্দা। জিম্বাবুয়েতে ‘গণতন্ত্রের মৃত্যুর’ প্রতিবাদ করে ২০০৩ সালে তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যায় ২৭ বছর বয়সেই। প্রাণের ভয়ে ছাড়তে হয় নিজ দেশ। এরপর ইংল্যান্ডে ক্লাব ক্রিকেটে খেলেছেন বটে। পরে হয়ে গেছেন পুরোপুরি কণ্ঠজীবি। সুরের জাদু ছড়িয়ে দেন। নিজের কথাও বিক্রি করেন! 

এখনকার পরিচয় কণ্ঠে উচ্ছ্বাস নিয়েই তুলে ধরলেন তিনি। 

“আমি গান গাই। ইউটিউবে ঢুকলেই আমার অনেক গান দেখতে পাবেন। পাবলিক স্পিকিং করি। বেশ ব্যস্তই বলতে পারেন। ক্রিকেটে সম্পৃক্ত নই কোনোভাবে।”  

“আমার বেশির ভাগ বক্তৃতাই মোটিভেশনাল নয়। নিজের জীবনের কথা বলি, ক্রিকেটের কথা বলি, গানের কথা বলি, জিম্বাবুয়ের রাজনীতির কথা বলি, আরও অনেক কিছু। জীবনের এই অধ্যায় ভালোই চলছে। বছরে ৩০টি এরকম বক্তৃতার ডাক পেলে আর কোনো কাজ করতে হতো না। একসময় বছরে গোটা বিশেক পেতম। এখন প্রায় হয়ই না। তবে বিভিন্ন স্কুলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, চার্চে, রিটায়ামেন্ট ভিলেজে বক্তৃতা দেই, গান করি।” 

গান গাওয়ার শখ ছিল তার ছেলেবেলা থেকে। পেশাদার শিল্পী হওয়ার স্বপ্নও দেখতেন। পরে ক্রিকেটার হলেও গানের সঙ্গে সখ্য রয়ে গেছে বরাবরই। ২০০১ সালে তার গান ‘আমাদের জিম্বাবুয়ে’ দারুণ সাড়া জাগায়। ‘সিঙ্গিং সিমার’ নামে পরিচিতি পেয়ে যান তিনি। 

এখন সেই স্বপ্নের জগতেই আছেন। ক্রিকেট বলের জায়গায় হাতে গিটার তুলে নিয়েছেন অনেক দিনই হয়ে গেল। 

২০০৬ সালে ইংল্যান্ডের চ্যানেল ফাইভ-এর ‘দা অলস্টার ট্যালেন্ট শো’-তে চ্যাম্পিয়ন হয়ে তিনি তাক লাগিয়ে দেন। একটি অ্যালবামও প্রকাশিত হয় ওই বছর। অস্ট্রেলিয়ায় তার সঙ্গীতাভিষেক হয় ২০১৬ সালে, সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে একটি শো-তে। ২০১৯ সালে ‘দা ভয়েস অস্ট্রেলিয়া’ শো-তে অংশ নেন। এবার অবশ্য খুব বেশি দূর যেতে পারেননি। তবে আছেন গানের জগতেই। 

ততক্ষণে ফিশ অ্যান্ড চিপস চলে এসেছে। ‘ফ্ল্যাটহেড’ নামক সামুদ্রিক এক মাছের ফ্রাই। ‘মাছটি দেখতে কুৎসিত, কিন্তু খেতে মজা’, প্লেটে ছুরি চালাতে চালাতে বললেন তিনি। 

খেতে খেতেই আবার ডুব দিলেন তার গানের সাগরে। মঞ্চে তার কণ্ঠে ইতালিয়ান গান ‘নেস্সুন দরমা’ নাকি প্রবল দর্শকপ্রিয়। 

“এটা একটা ইতালিয়ান গান। লোকে এটা পছন্দ করে, কারণ এটা ভিন্ন অফ ট্র্যাকের। এছাড়া ‘রেইজ মি আপ’ গানও অনেক গাই, এটাও জনপ্রিয়। ইউটিউবে গেলেই অনেক ভিডিও দেখবেন আমার।” 

কোভিড লকডাউনের সময়টা অবশ্য খুব কঠিন গেছে তার। সব ধরনের শো, বক্তৃতা, অনুষ্ঠান বন্ধ ছিল। ঘরবন্দি সময়টা কথা মনে করে এখনও বিরক্তি প্রকাশ করছিলেন বারবার। 

এখন সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। তবে আগের অবস্থা ফেরেনি। আক্ষেপ করে তিনি বলছিলেন, আরও বড় তারকা হলে হয়তো বৃক্ততা দিয়ে আয় আরেকটু বেশি হতো তার। 

“যা আয় হয়, বাচ্চাদের স্কুলে ফি হয়ে যায়! হাহাহাহাহা… । সত্যি বলতে, সংসারের সব খরচ যদি আমাকে বহন করতে হতো, এই আয়ে চলত না। তবে আমার স্ত্রী ভালো চাকরি করে। কর্পোরেট কোনো অনুষ্ঠানে বা ভালো আয়োজনে বক্তৃতা দিলে ৩ হাজার ডলার পাই। স্টিভ ওয়াহ (সাবেক অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক) একই কাজ করে হয়তো ৫০ হাজার ডলার পায়!” 

“আমি যদি বছরে এরকম ৩০টি বক্তৃতা পাই, তাহলে খুব ভালো চলে যায় আমার। কিন্তু ৩০টা তো পাই না। বড়জোর ১০টা পাই। ভাগ খুব ভালো থাকলে, কোনো অনুষ্ঠানে ৫ হাজার ডলার পাই।” 

তার স্কুল শিক্ষিকা স্ত্রী পরিবারের বড় সহায়। ব্রাইটন হাই স্কুলে পড়ান তিনি। স্ত্রীর কারণেই অস্ট্রেলিয়াকে আপন করে নিয়েছেন ওলোঙ্গা। 

অ্যাডিলেইডের মেয়ে টারা রিডের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া ইনস্টিটিউট অড স্পোর্টসের একটি ক্রিকেট প্রোগ্রামে। ২০০৪ সালে তারা বিয়ে করেন। তবে জিম্বাবুয়ে ছেড়ে ওলোঙ্গা তখন থাকেন ইংল্যান্ডে। চাকরির কারণে টারা রয়ে যান অ্যাডিলেইডেই। চার বছর দূরবর্তী সম্পর্কের পর ২০০৮ সালে টারা চলে যান ইংল্যান্ডে। দুজনের ঘর আলোকিত করে আসে দুটি মেয়ে। 

তবে টারার আবার মন পোড়ে দেশের জন্য। ২০১৫ সালে গোটা পরিবার ফিরে আসে অ্যাডিলেইডে। তখন থেকে এখানেই থিতু তারা ৭ বছর ধরে। 

ক্রিকেট জীবন ও কালো ফিতার প্রতিবাদ 

জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে ওলোঙ্গাকে মনে রাখার কারণ আছে অনেকগুলোই। ১৭ বছর বয়সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকে ৫ উইকেট নেওয়া থেকেই সাড়া জাগানোর শুরু। চোখের পলকে ঘুরতে থাকে তার ক্রিকেট ভাগ্যের চাকা। ১৯৯৫ সালে টেস্ট ক্যাপ পেয়ে যান মাত্র ১৮ বছর বয়সেই। 

জিম্বাবুয়ের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার হিসেবে তার নাম খোদাই হয়ে আছে চিরদিনের জন্য। সেই সময় দেশের সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট ক্রিকেটারও ছিলেন তিনি। অভিষেক টেস্টে প্রথম ওভারেই আউট করেন সাঈদ আনোয়ারের মতো ব্যাটসম্যানকে। তবে বোলিং অ্যাকশন প্রশ্নবিদ্ধও হয় ওই টেস্টেই। পরে অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি ডেনিস লিলির সঙ্গে কাজ করে অ্যাকশন শুধরে নেন। 

চমকপ্রদ তেমন কিছু অবশ্য করতে পারেননি শুরুতে। তবে ইতিহাসের অংশ হয়ে যান অষ্টম টেস্টে। হারারেতে ভারতের বিপক্ষে টেস্টের প্রথম ইনিংসে নেন ৫ উইকেট। পরাশক্তি ভারতের বিপক্ষে জিম্বাবুয়ের প্রথম টেস্ট জয়ে তিনিই ম্যান অব দা ম্যাচ। 

খুব গোছানো বোলার তিনি ছিলেন না। ওয়াইড-নো করতেন প্রচুর। পরিসংখ্যানও খুব সমৃদ্ধ নয়। ৩০ টেস্টে উইকেট ৬৮টি, ৫০ ওয়ানডেতে ৫৮টি। তবে ছন্দে থাকলে নিজের দিনে তিনি ছিলেন ভয়ঙ্কর। ওয়ানডেতে দুই দফায় নিয়েছেন ম্যাচে ৬ উইকেট।

১৯৯৬ বিশ্বকাপের জিম্বাবুয়ে স্কোয়াডে জায়গা পান তিনি বয়স ২০ হওয়ার আগেই। শেষ ম্যাচে খেলার সুযোগও আসে। তবে একাদশ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি যথেষ্ট প্রস্তুত নন বলে। পরে ১৯৯৯ ও ২০০৩ বিশ্বকাপেও খেলেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০০৩ বিশ্বকাপ থেকেই তার ক্যারিয়ার ও জীবনের মোড় যায় বদলে। 

জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট অধ্যায়ে তিনি চিরস্থায়ী জায়গা পেয়ে গেছেন ক্রিকেট পারফরম্যান্সে নয়। প্রবল সাহসিকতার নজির দেখিয়ে। 

সেই সময়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের বিতর্কিত বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে জিম্বাবুয়েতে তখন তুমুল অস্থিতিশীলতা চলছে। রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্রান্তিকাল। জিম্বাবুয়ের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট তারকা অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও ওলোঙ্গা মিলে সিদ্ধান্ত নেন, বিশ্বকাপকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব নেতৃত্বকে নিজেদের দেশের অবস্থা জানাবেন। ‘জিম্বাবুয়েতে গণতন্ত্রের মৃত্যুর শোক’ পালন করতে নামিবিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে তারা দুজন মাঠে নামে হাতে কালো আর্মব্যান্ড বেধে। 

নিজেদের সেই ভাবনার পেছনের প্রেক্ষাপট এতদিন পরে আবার তুলে ধরলেন ওলোঙ্গা। 

“জিম্বাবুয়ের নেতৃত্বস্থানীয়রা ওই সময় অনেক দুর্নীতিগ্রস্থ ছিল। খুব নিষ্ঠুরও ছিল নিজেদের জনগণের প্রতি। আমি ও অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ঠিক করি, এটার প্রতিবাদ করব। আরও অনেক ব্যাপারও ছিল সেখানে। তবে মূল ব্যাপার এটিই ছিল। নিজেদের জনগণের সঙ্গে ওই সময় সরকার যা করছিল, তা ভয়ঙ্কর। আমরা সেসবের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে চেয়েছি।” 

“আমাদের ধারণা ছিল জাতিসংঘ বা বিশ্ব সংস্থাগুলি জিম্বাবুয়ের পাশে দাঁড়াবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে। কিন্তু কিছুই হয়নি। মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকল। একসময় জিম্বাবুয়ের ট্রিলিয়ন ডলারের নোট ছিল, ভাবতে পারেন! সবই দূর্নীতির জন্য ও অর্থনীতির অব্যবস্থাপনার জন্য। সব কৃষকের জমি কেড়ে নিয়েছিল মুগাবে। বিদেশিদের পছন্দ করত না সে। এমন অনেক কিছুই করেছে, দেশের জন্য যা ভালো ছিল না।” 

তাদের এই পদক্ষেপ সাহসী হিসেবে তুমুল প্রশংসিত হয়। ক্রিকেটে সীমানা ছাড়িয়ে সাড়া জাগায় বিশ্বজুড়ে। কিন্তু তাদের জীবনে নেমে আসে আঁধার। ক্যারিয়ার তো শেষ হয়ে যায় বটেই, নানারকম হুমকি-ধামকিতে দেশও ছাড়তে হয় দুজনকে। 

গত ১৯ বছরে আর দেশে পা দেওয়া হয়নি ওলোঙ্গার। তার বাবা ও ভাই থাকে সেখানেই। তাদের সঙ্গে দেখা হয় না যেন অন্ততকাল ধরে। বয়স্ক বাবার এখন আর ভ্রমণ করার অবস্থা নেই। হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলতে পারাই স্বান্ত্বনা । তার মা অবশ্য থাকেন সিডনিতে, দেখা হয় মাঝেমধ্যেই। 

বরার্ট মুগাবে মারা গেছেন তিন বছর আগেই। তবু জিম্বাবুয়েতে ফেরার সাহস বা তাগিদ, কোনোটাই অনুভব করেন না তিনি। 

“২০০৩ বিশ্বকাপে কালো আর্ম ব্যান্ড পরার পর মৃত্যুর হুমকি দেওয়া হয় আমাকে। এখন মুগাবে নেই, কিন্তু তার সব দোসররা সেখানে আছে। আমি জানি না, এখন আবার জীবনের ঝুঁকি আছে কী নেই। তবে দেশে ফেরার কোনো ভাবনা নেই। যদি তারা আমাকে আমন্ত্রণ জানায় ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়, তাহলে ভেবে দেখতে পারি।” 

“দেশের কিছু কিছু ব্যাপার মিস করি। তবে অনেক কারণেই সেই মিস করাটা চাপা পড়ে যায়। আমি দুর্নীতি পছন্দ করি না। জিম্বাবুয়েতে দুর্নীতির শেষ নেই। ওই সময়টায় মূল্যস্ফীতি ছিল ভয়ঙ্কর। ছোট ছোট আরও অনেক কিছু ছিল, যা জীবনটা কঠিন করে তুলেছিল। ধরুন, আপনার কোনো স্বপ্ন আছে, হয়তো গায়ক হতে চান… ওই দেশে সম্ভব ছিল না। এখন ইন্টারনেট, ইউটিউব, ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রামের যুগে অনেকটা সহজ হয়ে উঠেছে। কিন্তু ওই সময়ে ক্যারিয়ার গড়ার উপায় ছিল না। দেশ ছাড়ায় সেই সুযোগটা পেয়েছি। আমার নিজে ক্যামেরা, স্টুডিও আছে, গান গাই, মিউজিক ভিডিও বানাই। জিম্বাবুয়েতে এসব সম্ভব ছিল না।” 

মুগাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অন্য সতীর্থ পাশে না পেলেও কোনো অভিযোগ তার ছিল না তখন। নেই এখনও। 

“যার যার নিজস্ব ভাবনা থাকে, পছন্দ থাকে। অ্যান্ডির এক বন্ধুর খামার কেড়ে নিয়েছিল সরকার। এটা তাকে স্পর্শ করে থাকতে পারে। নিজের দেশ নিয়ে আমার গভীর ভাবনা ছিল। সবসময় ন্যায্যতায় বিশ্বাস করতাম। সবসময় মনে করি, এই বিশ্ব সমতায় চলা উচিত।” 

পুরনো সতীর্থদের বেশির ভাগের সঙ্গেই তার যোগাযোগ নেই। বছরে এক-দুবার কথা হয় অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের সঙ্গে। এছাড়া লুলেকি এনকালা, পমি এমবাংওয়ার সঙ্গে কথা হয় মাঝেমধ্যে। টাটেন্ডা টাইবু এখন বাংলাদেশে কোচিং করাচ্ছেন জেনে অবাক হলেন। তাকে ‘হ্যালো’ জানাতেও অনুরোধ করলেন। 

সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড আর টেন্ডুলকারের সঙ্গে দ্বৈরথ 

বল হাতে ওলোঙ্গার বিধ্বংসী চেহারার সেরাটা দেখা গিয়েছিল ২০০০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ত্রিদেশীয় সিরিজে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। প্রথম স্পেলেই নাসের হুসেইন, নিক নাইট, গ্রায়েম হিকসহ উইকেট নিয়েছিলেন ৫টি। শেষ পর্যন্ত ১৯ রানে তার শিকার ছিল ৬ উইকেট। 

২২ বছর পরও ওয়ানডেতে জিম্বাবুয়ের সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড হয়ে এটি টিকে আছে। 

তবে ওই ম্যাচের চেয়েও স্মরণীয় হয়ে আছে তার আগের এক ম্যাচের বোলিং। ১৯৯৮ সালে, শারজায়। সেটি ছিল কেবল তার পঞ্চম ওয়ানডে। ভারতের বিপক্ষে জিম্বাবুয়েকে দারুণ এক জয় এনে দিয়েছিলেন তিনি। সেদিন তার চার শিকার ছিল সৌরভ গাঙ্গুলি, শচিন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড় ও অজয় জাদেজা। 

টেন্ডুলকারকে আউট করা ডেলিভারিটি ভুলে যাওয়ার মতো নয়। তাকে বেশ কবার ভোগান্তিতে ফেলার পর শেষ পর্যন্ত আউট করেন অফ স্টাম্প ঘেঁষা এক গোলায়, লেংথ থেকে আচমকা লাফিয়ে যা চমকে দেয় টেন্ডুলকারকে। 

ওলোঙ্গা মনে করতে পারলেন ম্যাচের প্রেক্ষাপটও। 

“ওই ম্যাচে আমার খেলার কথা ছিল না। দুই দলের ফাইনাল আগেই নিশ্চিত। ডেড রাবার ছিল, তাই ওরা একাদশে নিল। আসলে ওই সফরেই আমার থাকার কথা ছিল না। কিন্তু ভারতের বিপক্ষে টেস্টে ভালো করায় ওই সফরে নিয়ে যায়।” 

ওই ম্যাচকে মনে রাখার কারণ পরের ম্যাচে টেন্ডুলকারের প্রতিশোধ পর্বও। ওলোঙ্গার খ্যাপাটে উদযাপন খুব ভালো লাগার কথা নয় তার। ফাইনালের আগে ‘টেন্ডুলকার বনাম ওলোঙ্গা’ আলোচনাও উত্তেজনা ছড়ায় তুমুল। ভারতীয় ব্যাটিং গ্রেটের কাছে এসব আত্মমর্যাদায় লাগার কথা। ফাইনালে ম্যাচ জেতানো বিধ্বংসী সেঞ্চুরির পথে (৯২ বলে অপরাজিত ১২৪) ওলোঙ্গাকে তুলাধুনা করে ছাড়েন টেন্ডুলকার। 

টেন্ডুলকারের সেই শটগুলো এখন আর যন্ত্রণা দেয় না ওলোঙ্গাকে, বরং হাসির উৎস হয়ে আসে, “ফাইনালে শচিন আমাকে বেধড়ক পিটিয়েছিল। খুব রেগে ছিল সে…।” 

পরের বছর অবশ্য আবার ভারতের হন্তারক হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। এবার বিশ্বকাপের মঞ্চে জিম্বাবুয়েকে এনে দেন তিনি অভাবনীয় এক জয়। 

ওলোঙ্গার বোলিংয়ের চূড়ান্ত দুটি রূপই দেখা যায় সেদিন। প্রথম ৩ ওভারে ৬টি ওয়াইড দেওয়ায় তাকে আর বোলিংয়েই আনেননি অধিনায়ক অ্যালেস্টার ক্যাম্পবেল। ৪৬ ওভারে ২৫৩ রান তাড়ায় ভারত চলে যায় জয়ের খুব কাছে। ২ ওভারে যখন প্রয়োজন স্রেফ ৯ রান, উইকেট তখনও আছে ৩টি। ৩৩ রান নিয়ে টিকে ছিলেন রবিন সিং। 

হুট করে আবার ওলোঙ্গার হাতে বল তুলে দেন ক্যাম্পবেল। এরপরই নাটকীয়তা। ওই ওভারের প্রথম বলে রবিন দুই রান নিলেও পরের বলে আউট হয়ে যান শর্ট কাভারে ক্যাচ দিয়ে। পরের দুই বলে আসে তিন রান। ৮ বলে যখন প্রয়োজন ৪ রান, পরপর দুই বলে জাভাগাল শ্রীনাথ ও ভেঙ্কটেশ প্রসাদকে আউট করে দলকে অবিস্মরণীয় জয় এনে দেন ওলোঙ্গা। 

ওই ম্যাচের স্মৃতি আলাদা জায়গা নিয়ে আছে ওলোঙ্গার হৃদয়েও। 

“৫ বলে ৩ উইকেট নেওয়া, বিশ্বকাপের ম্যাচে, অন্যরকম ব্যাপার। ভারতীয় সমর্থকেরা আমাকে গালিগালাজ করছিল। ওরা আমাকে পছন্দ করত না মনে হয়। আমার প্রথম স্পেল ভালো ছিল না। ওরা চিৎকার করে বলছিল, ‘ওলোঙ্গাকে বোলিংয়ে ফিরিয়ে আনো, আমরা খেলা শেষ করে দেব।” আমি ফিরে আসলেই খেলা শেষ করে দিলাম!” 

“ওই ম্যাচে শচিন খেলেননি, বাবার মৃত্যুতে দেশে ফিরে যায়। স্লো ওভাররেটের কারণে ভারতের ৪ ওভার কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এসব আমাদের পক্ষে এসেছিল। আমি ঠিক জায়গায় বল রাখতে পারি ওই ওভারে। রবিন সিংয়ের উচিত ছিল খেলা শেষ করে আসা। শেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান ছিল সে। আমি রাউন্ড দা উইকেট এসে রিভার্স সুইং চেষ্টা করছিলাম। তাতেই রবিন আউট হয়। সে আউট না হলে আমরা জিততাম না। সে আউট হওয়ার পর দুয়ার খুলে গেল।” 

তবে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দুটি আলোড়ন বেশি তুললেও তার নিজের কাছে প্রিয় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৬ উইকেটই। 

“তবে ১৯ রানে ৬ উইকেটের ম্যাচটিই আমার সেরা। কারণ দুই দিকেই সুইং করাতে পেরেছিলাম, যা খুশি করতে পারছিলাম। নিখুঁত বোলিং করেছিলাম। এরকম দিন খুব বেশি আসে না ক্যারিয়ারে।” 

আপন ক্রিকেট, পর ক্রিকেট 

ভিনদেশি সাংবাদিকে কৌতূহলের খোরাক মেটাতে স্মৃতির সরণিতে তিনি হেঁটে চললেন বটে। তবে এমনিতে ওই সময়গুলো খুব একটা টানে না তাকে। ক্রিকেট খেলাটাকেই যে তার এখন আর এতটা আপন মনে হয় না! 

টিভিতে ক্রিকেট খুব একটা দেখেন না। অ্যাডিলেইড ওভালে টেস্ট হলে অবশ্য মাঝেমধ্যে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এক দিনের খেলা হয়তো দেখে আসেন। তবে সেটাও কালেভদ্রে। এবার বিশ্বকাপ বলে অবশ্য অ্যাডিলেইড ওভালে গিয়েছিলেন। নেদারল্যান্ডস-জিম্বাবুয়ে ও বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ ছিল সেদিন। ডাচদের সঙ্গে নিজ দেশের পরাজয় দেখে খারাপ লেগেছে তার। তবে খুব হতাশ হওয়ার মতো কিছু হয়নি বলেই দাবি করলেন। ক্রিকেটই যে তাকে এখন আর সেভাবে নাড়া দেয় না! 

খেলোয়াড়ী জীবনে দেশ-বিদেশে ঘোরা, মানুষের সঙ্গে মেশা, ভিন্ন সব সংস্কৃতি ও খাবারের স্বাদ পাওয়া, এসব অবশ্য তিনি খুব মিস করেন। তবে পেশাদার ক্রিকেটারদের তো স্রেফ এসবে জীবন চলে না! সেই সময়ের নড়বড়ে আর্থিক নিরাপত্তায় তার কণ্ঠে যেমন হাহাকার যেমন ফুটে ওঠে, তেমনি ঝরে পড়ে প্রশাসকদের বিপক্ষে ক্ষোভও। 

“জিম্বাবুয়ে এত ভালো দল ছিল না। প্রচুর হারতাম আমরা। জব স্যাটিসফ্যাকশনের কথা বললে, খুব বেশি তৃপ্তি ছিল না। আরেকটা ব্যাপার হলো, আর্থিক প্রাপ্তিও যথেষ্ট ছিল না। ভারতের হয়ে ১ বছর ক্রিকেট খেলেই জীবন বানিয়ে ফেলা যায়। জিম্বাবুয়েতে ৮ বছর খেলেও তা সম্ভব নয়।” 

“জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে একসময় টাকা যে কম ছিল, তা নয়। তবে ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক কম দেওয়া হতো। অনেক টাকাই ভুল মানুষদের কাছে যেত। ক্রিকেটাররা পেত না।” 

শুধু অর্থই নয়, ক্রিকেটের অন্য সব অনিশ্চয়তার কথা ভাবলেও তার এখনকার জীবনকেই মনে হয় অনেক গোছানো ও সুন্দর। 

“এছাড়াও ব্যাপার আছে। ক্রিকেট ক্যারিয়ার অনেক কঠিন। শরীরের ওপর ধকল যায়। ইনজুরি আসে। ফর্ম হারাতে হয়। নির্বাচকরা বাদ দিয়ে দেয়। দলের ভেতরও সতীর্থরা অনেকে পছন্দ করে না অনেককে। এখন আমি যা করি, পারফর্মার হিসেবে স্টেজে উঠি, পারফর্ম করি, বেশির ভাগ লোকে পছন্দ করে। এখানে কোনো নির্বাচক নেই যে আমাকে বলবে, ‘পরের গান গাইতে পারবে না।’ কোনো অধিনায়ক নেই যে বলবে, ‘তোমাকে শেষ ওভার বোলিং করতে হবে হাবিবুল বাশারের সামনে!’ সত্যি বলতে, যা করছি এখন, তা খুব ভালোবাসি আমি।” 

হাবিবুল বাশারের কথায় বুঝিয়ে দিলেন, বাংলাদেশকে ভালোই মনে আছে তার। সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবালদের কথাও জানেন বলে জানিয়ে দিলেন। হুট করেই জানতে চাইলেন, “বাংলাদেশের যে অধিনায়ক ছিল, পেসার… এখনও খেলে সে?” 

যখন বলা হলো, মাশরাফি বিন মুতর্জা এখন সংসদ সদস্য, ওলোঙ্গার বিস্ময় যেন আকাশ ছুঁতে চাইল, “এমপি? সত্যিই? ওয়াও…!” পরমুহূর্তেই আবার তার জিজ্ঞাসা, “সে কেমন এমপি? ভালো? দুর্নীতিগ্রস্থ নয় তো…?” 

টেইলরের শাস্তিতে বিস্ময়, স্ট্রিকের শাস্তিতে নয় 

জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে আর্থিক নিরাপত্তার ঘাটতি তার কথায় উঠে আসতে থাকে বারবার। তাদের সময়ে যেমন, তেমনি পরেও মাসের পর মাস বেতন পাননি ক্রিকেটাররা। ম্যাচ ফি পাননি সময়মতো। অবধারিত প্রসঙ্গটিও তাই উঠে যায়। জুয়াড়িদের সঙ্গে ব্রেন্ডন টেইলের সম্পর্ক গড়ে ওঠায় আর্থিক অনিশ্চয়তার প্রভাব কতটুকু! 

আইসিসির দুর্নীতি বিরোধি ধারা ভঙ্গের কারণে গত জানুয়ারিতে সাড়ে তিন বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় জিম্বাবুয়ের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন টেইলরকে। তাদের আরেক গ্রেট ও সাবেক অধিনায়ক হিথ স্ট্রিক আরও বড় শাস্তি পান গত বছর। ৫টি ধারা ভঙ্গের জন্য তার নিষেধাজ্ঞা ৮ বছরের। 

আর্থিক দুর্ভাবনার প্রভাব কিছুটা থাকতে পারে বলে ধারণা ওলোঙ্গার। তবে পরমুহূর্তে আবার নিজেই বলেছেন, এটাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানোর সুযোগ নেই কোনো। 

“যথেষ্ট পরিমাণে পারিশ্রমিক যদি কাউকে দেওয়া হয়, তাহলে বুকির প্রস্তাব উপেক্ষা করা যায়। কিন্তু যদি পরিশ্রমের মূল্য খুব বেশি না পাওয়া যায়, তাহলে বুকি এসে যখন বলে, ‘হেই ব্রেন্ডন, লেটস হ্যাভ আ ড্রিঙ্ক…’, এভাবেই হয়ে যায়। ব্রেন্ডনকে তো ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছিল, তাই না? সে নিজে অন্তত এরকমই বলেছে। সত্যিটা জানি না।” 

“তবে কোনো কিছুই আসলে অজুহাত হতে পারে না। হিথ স্ট্রিক ও ব্রেন্ডন টেলর, দুজনই জানে যে প্রস্তাব পাওয়া মাত্র রিপোর্ট করতে হবে। এমনকি আমি যখন খেলতাম, তখনও তো এসব জানতাম। কাজেই যথেষ্ট পারিশ্রমিক পাচ্ছেন কী পাচ্ছেন না, এটা বিবেচনায় থাকার কারণ নেই। নিজের বিবেকই আপনাকে বলবে যে কাজটা ঠিক নয়। আমি যদিও ওদের খুব রূঢ়ভাবে বিচার করতে চাই না। সবাই মানুষ। সবারই নিজের দৃষ্টিভঙ্গি আছে। তবে হ্যাঁ, পারিশ্রামিক ভালো হলে হয়তো তারা এটা করত না।” 

কিন্তু স্ট্রিকের ক্ষেত্রে তো আর্থিক ঝুঁকির ব্যাপারটি খুব একটা খাটে না। পারিবারিকভাবেই তারা সম্পদশালী অনেক। মুগাবে সরকারের বিতর্কিত নীতির কারণে যদিও অনেক জায়গা-জমি তাদেরও হারাতে হয়েছিল, তার পরও স্ট্রিক পরিবারে কিছুর কমতি ছিল না। তাহলে তিনি কেন? ওলোঙ্গা নিজেও যেন উত্তর খুঁজলেন। 

“অবশ্যই ওর অনেক ছিল… (তার পরও কেন চেয়েছে) আমি জানি না…জানি না। রাজনীতিবিদরা কেন এত চায়? ১ মিলিয়নে কেন তারা সন্তুষ্ট থাকে না? ৩ মিলিয়ন কেন চায়? লোভের কারণে। আরও বেশি পেতে চায়…।” 

শেষ নয় সেখানেই। চমকে দেওয়া কথাটি বললেন তিনি এরপরই। স্ট্রিক-টেইলরকে দুর্নীতিতে জড়াতে দেখে অবাক হয়েছিলেন কিনা, এই প্রশ্নে চোখ নাচিয়ে বললেন, “আমি শুধু বলতে পারি, ব্রেন্ডনের নাম দেখে অবাক হয়েছিলাম। আরেকজনের কথা বলতে পারি না… বুঝতে পারছেন তো, কি বলতে চাইছি?” 

বুঝতে না পারার কারণ নেই। তার ইঙ্গিত যে গুরুতর, সেটা বুঝতে পেরেই হয়তো আরেকটু বিশদ ব্যাখ্যা করলেন। 

“স্ট্রিকি আমার অনেক উপকার করেছে ক্যারিয়ারের শুরুতে। ওদের ফার্মে আমি থেকেছি, আমাকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে যেত। ওকে নিয়ে তাই বাজে কথা খুব একটা বলতে চাই না। তবে আমি অবাক হইনি ওর নাম দেখে, এটা বলতে পারি। হতে পারে তার ভুল, কিংবা হতে পারে অন্য কিছু…।”

“ব্রেন্ডনের যেটা আমাকে অবাক করেছে, ধারণা করতে পারিনি যে সে রিক্রিয়েশনাল ড্রাগ নিচ্ছিল। চমকে গেছি। দুটি দিক থেকে এটা সমস্যা। একটি হলো এটা অবৈধ। আরেকটি হলো, পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে ড্রাগ নেওয়া যায় না। পরীক্ষা করলেই তো ধরা পড়ত, ২ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হতো। ড্রাগ নিলে কীভাবে সেরা পারফর্ম করা যায়!” 

তার ফিশ অ্যান্ড চিপস ততক্ষণে শেষ হয়ে আসছে। শেষ টুকরোটা মুখে পুরে গ্লাসে হালকা চুমুক দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। একটু পর স্বগতোক্তির মতো বললেন ভিন্ন দর্শনের কথাও।   

“আসলে ধরা খাওয়ার আগ পর্যন্ত সবাইকেই মনে হয় যে তার সবকিছু ভালো। ধরা খাওয়ার ভয় না থাকলে সবাই সবকিছু করতে চাইবে বলেই আমার ধারণা। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটাররা যথেষ্ট টাকা পায় না, দেওয়া হয় না। যখন একটা খরুচে দেশে থাকতে হয়, পরিবার চালাতে হয়, বাচ্চা-কাচ্চা, অনেক বিল টিল দিতে হয়, তখন একটা পর্যায়ে গিয়ে লোকে সততার সঙ্গে আপোস করে ফেলে।” 

“অনেকে কোনো অবস্থায়ই এসব করবে না। তবে অনেকে আবার করবে। কাউকে হয়তো কিছু করার জন্য ১০০ ডলার দিতে চাইলেন, সে পাত্তা দেবে না। কিন্তু ১০ হাজার ডলার দিলে, কে জানে! তখন অনেকেই বিবেচনা করে সেটা। সবাই মানুষ। অজুহাত দিচ্ছি না। তবে বাস্তবতা বলছি।” 

যে জীবন তৃপ্তির 

লাঞ্চ শেষ হলেও আলোচনা শেষ নয়। তার নিজেরও কৌতূহল কম নয়। “চট্টগ্রামের মাঠটি (এমএ আজিজ স্টেডিয়াম) তেমন ভালো ছিল না, নতুন মাঠ কি হয়েছে? ঢাকার মাঠ অবশ্য খারাপ ছিল না (বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম)…।” ঢাকায় নতুন ক্রিকেট মাঠ হয়েছে জেনে শুনতে চাইলেন আরও বিস্তারিত, ‘কত দর্শক বসতে পারে মাঠে?’, “বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ের ম্যাচ কি এখনও ঘনঘন হয়?” 

জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট নিয়েও টুকটাক কথা বললেন। খেলা যদিও খুব বেশি দেখেন না বা খোঁজ তত রাখেন না। তবে সিকান্দার রাজাকে তার ভালো লাগে। রায়ার্ন বার্লকেও। 

তবে ক্রিকেটে তিনি বেশিক্ষণ থাকতেই পারেন না। “সামনেই আমার অডিও বুক বের হচ্ছে”, তার চোখ-মুখ ঝলমলে হয়ে উঠল আবার, “কয়েক বছর আগে বই লিখেছি। ‘ব্লাড, সোয়েট অ্যান্ড ট্রিজন’… ইংল্যান্ডে প্রকাশ করেছি। ভালোই বিক্রি হয়েছে। উইলিয়াম হিল বুক অ্যাওয়ার্ড ও ব্রিটিশ বুক অ্যাওয়াডের্র জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল। পুরস্কার পাইনি, কাছাকাছি গিয়েছি। এটাই অডিও বুক বানাচ্ছি, ক্রিসমাসের আগেই হয়তো রিলিজ হবে। কিছু গান বানাচ্ছি। কিছু আর্টওয়ার্কও রিলিজ করছি। সব মিলিয়ে অনেক ব্যস্ত।” 

ক্রিকেট এখন আর তার উচ্ছ্বাস-আবেগে নেই। যা আছে, তাতে তার জীবনে শান্তির কমতি নেই। এই জীবনকেই তিনি আলিঙ্গন করে নিয়েছেন পরম মমতায়। 

বিদায়ের আগে সেই সুখের বার্তাটুকু ছড়িয়ে গেলেন, “নিজের মতো করে থাকি। এখানেই আমার ছোট্ট, শান্তির জীবন।”