বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের আত্মপর্যালোচনা জরুরি, বললেন প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন।
Published : 18 Oct 2022, 04:46 PM
কবি শেখ ফজলুল করিম সেই কবে লিখে গেছেন, “রিপুর তাড়নে যখনই মোদের বিবেক পায় গো লয়, আত্মগ্লানির নরক-অনলে তখনি পুড়িতে হয়।” বাংলাদেশ দলের জন্য এখন যেন সেটিই বাস্তবতা। নাহ, ক্রিকেটে পাপ-পূণ্য বা জীবন-মরণের মতো ব্যাপার নেই। দিনশেষে এটি স্রেফ একটি খেলা আর বিনোদন। তবে ভুল এখানেও হয়, নিবেদন ও মানসিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অনেক সময় এখানেও নিজেদের দাঁড় করাতে হয় কাঠগড়ায়। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের এখন সেই সময় হয়েছে বলেই মনে করেন প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন।
টি-টোয়েন্টিতে ক্রমাগত ধুঁকতে থাকা দল আরেকটি ধাক্কা খেয়েছে সোমবার আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে। ১৬১ রান তাড়ায় পুরো ২০ ওভার খেলে বাংলাদেশের সংগ্রহ ছিল স্রেফ ৯৮। এমনিতে প্রস্তুতি ম্যাচকে খুব গুরুত্ব দেওয়ার কারণ নেই। তবে বাংলাদেশ দলের বাস্তবতা ভিন্ন। এই সংস্করণে টানা ব্যর্থতার বলয়ে থাকা দল যখন চাপহীন ম্যাচেও এমন আত্মসমর্পণের পথ বেছে নেয়, তখন প্রমাদ গুনতে হয় বৈকি।
দলের অন্দরে তাই আরও একবার বেজে উঠেছে জরুরি বার্তা। ডাক উঠছে জেগে ওঠার।
ক্রিকেট মানেই তো শুধু ক্রিকেটাররা নন, পুরো সিস্টেমের অংশ আরও অনেকে। দল পারফর্ম করতে না পারলে সেই উত্তাপ স্পর্শ করে সংশ্লিষ্ট সবাইকেই। প্রধান নির্বাচক হিসেবে মিনহাজুলকেও যেমন অনেক সমালোচনা শুনতে হয় নিত্যই। তবে তার দায়িত্বের পরিধি তো কেবল দল নির্বাচন পর্যন্তই। মঙ্গলবার ব্রিজবেনের টিম হোটেলের পাশে দাঁড়িয়ে প্রধান নির্বাচক অসহায় কণ্ঠে বললেন, মাঠে নেমে কাজটা করতে হবে ক্রিকেটারদেরই!
মাঠের সাফল্যের পেছনে দল নির্বাচনেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে অবশ্যই। বাংলাদেশের মতো জায়গায়, যেখানে ক্রিকেট স্রেফ একটি খেলাই নয়, অনেকটাই হয়ে গেছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ, সেখানে দল নির্বাচন করে সবাইকে খুশি করা অসম্ভবের কাছাকাছি। স্কোয়াড নিয়ে নানা প্রশ্ন এখানে সবসময়ই ওঠে, আলোচনা-সমালোচনা হয় তীব্র। তবে এবার বিশ্বকাপের স্কোয়াড নিয়ে আঙুল তোলার লোক আছে সম্ভবত সামান্যই।
টুকটাক যা প্রশ্ন ছিল, বিশ্বকাপের দলে দুটি পরিবর্তন আনার পর সেসবও অনেকটা দূর হয়েছে। তারপরও প্রশ্ন কিছু আছে বা থাকতে পারে। এই দলেরও ক্রিকেটারদের অনেকেরই পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন ও সংশয় আছে বেশ। তবে সেটা বাংলাদেশ ক্রিকেট ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এই দেশের সার্বিক বাস্তবতার ব্যাপার। তুমুল ক্রিকেট উন্মাদনার ১৭ কোটি মানুষের দেশে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে যথেষ্ট বিকল্প ক্রিকেটার নেই। বিশ্বকাপের ১৫ জনের দলই যে এই মুহূর্তে দেশের সম্ভাব্য সেরা স্কোয়াড, এই মতের পক্ষে লোকই বেশি।
সেদিক থেকে মিনহাজুল আবেদিন তার কাজে অন্তত এই ক্ষেত্রে সফল। কিন্তু ক্রিকেটীয় বাস্তবতাই এমন যে, দল পারফর্ম করতে না পারলে ব্যর্থ বলতে হবে নির্বাচক কমিটি, কোচিং স্টাফ, বোর্ড, সবাইকেই।
মিনহাজুল ও সবাই তাই এখন তাকিয়ে ক্রিকেটারদের দিকে। নির্বাচকরা তাদের কাজ করেছেন। কোচিং স্টাফরা তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন নেটে, অনুশীলনে আর দলকে প্রস্তুত করায়। ঘাটতি সেখানেও কিছু থাকতে পারে। কিন্তু এই সংস্করণে পারফরম্যান্স যতটা খারাপ, দল নির্বাচন আর কোচিং নিশ্চয়ই এতটা খারাপ নয়! দিনশেষে তাই মূল দায় ক্রিকেটারদের। ব্যর্থতার বৃত্ত ভাঙার দায়িত্বও তাদেরই।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে সোমবার প্রস্তুতি ম্যাচে বিধ্বস্ত হওয়ার পর সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে অলরাউন্ডার মোসাদ্দেক হোসেনও নিজেদের দায় মাথা পেতেই নিয়েছেন। এই যে আত্ম-পর্যালোচনা, আত্মসমালোচনা, নিজেদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো, এসবকেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল।
“টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট কিন্তু স্বল্প পরিসরের খেলা। এখানে সেলফ অ্যাসেসমেন্ট খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ। টিম ম্যানেজমেন্ট, ব্যাটিং কোচ, হেড কোচ সবাই ক্রিকেটারদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে যেন ভালো ব্যাটিং করতে পারে। তার পরও সবকিছুর উর্ধ্বে কিন্তু সেলফ অ্যাসেসমেন্ট। ওদেরই সেই পরিকল্পনা করে ব্যাটিং করতে হবে। কারণ, কম সময়ের খেলা। যত তাড়াতাড়ি যে কটি বল পাওয়া যায়, মানিয়ে নিয়ে ব্যাটিং করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
“ক্রিকেটারদের যতটুকু টিপস দেওয়ার, আমাদের টিম ম্যানেজমেন্ট, ব্যাটিং কোচ, হেড কোচ সবাই দিচ্ছে এবং মাঠে কাজে লাগানোর দায়িত্ব পুরোপুরি ক্রিকেটারদের। আশা করি, বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে সবাই নিজেদের পুরোপুরি প্রস্তুত করেই নামবে।”
দলকে নিয়ে সাম্প্রতিক যে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়, সেসবকে ব্যর্থতার অনুসঙ্গই মনে করছেন মিনহাজুল। আলোচনা থামিয়ে দেওয়া আর সমালোচনার জবাব হতে পারে কেবল মাঠের পারফরম্যান্স। প্রধান নির্বাচক এখানেও দায়িত্বটা ক্রিকেটারদের ওপরই ছেড়ে দিলেন।
“দলে অনেকগুলো খেলোয়াড়কে চেষ্টা করা হচ্ছে ওপরে-নিচে। দল যদি ভালো না খেলে, তাহলে অনেক কথা আসে। ধারাবাহিকভাবে ভালো না খেললে এই জিনিসটা আসে। আমি মনে করছি যে, ক্রিকেটারদেরও পারফরম্যান্স বিশ্লেষণ করতে হবে। টিম ম্যানেজমেন্ট চিন্তা-ভাবনা করে দল দেয়। আমরা দল দেই। মাঠের পারফরম্যান্স তো ক্রিকেটারদেরই।”
“এখন যে অভিজ্ঞতা তাদের আছে, অনেকগুলো ম্যাচ কিন্তু ওরা খেলে এসেছে। অস্ট্রেলিয়ার মাঠে যদিও অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। বিগ ব্যাশেও ওভাবে কেউ খেলেনি, সেই হিসেবে আমরা পিছিয়ে আছি। তার পরও আমি মনে করি, ক্রিকেটাররা পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে মানিয়ে নিয়ে, পরবর্তী প্র্যাকটিস সেশনগুলো যদি ভালোভাবে কাটাতে পারে, আশা করি নিজেদের প্রস্তুত করে ভালো ক্রিকেট খেলতে পারে।”