লাল জার্সি গায়ে গ্যালারি ঠাসা সমর্থকদের উল্লাসে ভাসিয়ে শেষ ওভারের ফয়সালায় চিটাগং কিংসকে হারিয়ে বিপিএলে টানা দ্বিতীয় শিরোপা জিতল ফরচুন বরিশাল।
Published : 07 Feb 2025, 10:12 PM
গ্যালারিকে মনে হচ্ছিল যেন লাল সমুদ্র। ২৪ হাজার দর্শকের মধ্যে বরিশালের সমর্থকই সম্ভবত হাজার বিশেক। প্রায় সবার গায়ে দলের লাল জার্সি। ঝড়ের ঠিক আগে প্রকৃতি যেমন থাকে শান্ত, শেষ ওভার শুরুর আগে সেই গ্যালারিও তেমন থমথমে। কিন্তু প্রথম বলটি যখন ছক্কায় উড়িয়ে দিলেন রিশাদ হোসেন, সেই লাল সমুদ্র হয়ে উঠল উত্তাল। গর্জনে প্রকম্পিত চারপাশ। একটু পর এলো কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি। আবারও বিপিএলের চ্যাম্পিয়ন বরিশাল।
গ্যালারি ঠাসা সমর্থকদের উল্লাসে ভাসিয়ে বিপিএলের শিরোপা ধরে রাখল ফরচুন বরিশাল। ফাইনালে শেষ ওভারের ফয়সালায় চিটাগং কিংসকে ৩ উইকেটে হারাল তামিম ইকবালের দল।
মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে শুক্রবার চিটাগং ২০ ওভারে তোলে ১৯৪ রান। বরিশাল ম্যাচ শেষ করে চার বল বাকি রেখে।
বিপিএলের ফাইনালে সবচেয়ে বেশি রান তাড়ায় জয়ের নজির এটিই।
১২১ রানে জুটিতে চিটাগংকে দারুণ ভিত গড়ে দেন খাওয়াজা নাফে ও পারভেজ হোসেন। বিপিএলের ১১ আসরে ফাইনালে শতরানের উদ্বোধনী জুটি এটিই প্রথম।
রান তাড়ায় বরিশালকে উড়ন্ত সূচনা এনে দেন তামিম। অধিনায়কের পথ ধরে পরে কাইল মেয়ার্স ও অন্যরা মিলে দলকে পৌঁছে দেন জয়ের ঠিকানায়।
অষ্টাদশ ওভারে কাইল মেয়ার্স ও মাহমুদউল্লাহর বিদায়ে একটু কঠিন হয়ে ওঠে বরিশালের কাজ। শেষ দুই ওভারে প্রয়োজন পড়ে ২০ রানের। ১৯তম ওভারে বিনুরা ফার্নান্দোর বলে রিশাদের ছক্কায় আবার সহজ হয়ে ওঠে সমীকরণ।
শেষ ওভারে প্রয়োজন পড়ে ৮ রানের। হুসাইন তালাতের প্রথম বলেই ছক্কায় ম্যাচ কার্যত শেষ করে দেন রিশাদই।
তৃতীয় দল হিসেবে বিপিএলে টানা দুটি ট্রফি জিতল বরিশাল। এর আগে এই কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্স ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। অধিনায়ক হিসেবে টানা দুবার ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে পেরেছিলেন তামিমের আগে শুধু মাশরাফি বিন মুর্তজা ও ইমরুল কায়েস।
নাফে-পারভেজের ধুন্দুমার শুরু
টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামার সময় ভালো একটা শুরুর ভাবনা নিশ্চয়ই ছিল চিটাগংয়ের। কিন্তু এত ভালোর প্রত্যাশা কি তাদেরও ছিল? পারভেজ হোসেন ইমন ও খাওয়াজা নাফে অভাবনীয় এক জুটিই এনে দেন দলকে।
প্রথম তিন ওভারে চার বাউন্ডারি এলেও রান ছিল ২৩। এরপর পারভেজ তোলেন ঝড়। চতুর্থ ওভারে তানভির ইসলামের বাঁহাতি স্পিন পেয়ে একটি চারের পর দুটি বিশাল ছক্কা মারেন তিনি।
নতুন বলে কাইল মেয়ার্সের সুইং এ দিন কার্যকর হয়নি। বরিশালের অন্য বোলাররাও বাধ দিতে পারেননি রানের গতিতে।
পাওয়ার প্লেতে ৫৭ রান তোলে চিটাগং, এবারের আসরে যা তাদের সর্বোচ্চ।
পারভেজের রান তখন ১৫ বলে ৩২, চারটি চার মারলেও নাফের রান ছিল ২১ বলে ২২।
পাওয়ার প্লের পর রানের গতি বাড়ান নাফেও। রিশাদ হোসেনকে স্বাগত জানান তিনি ছক্কায়। এই লেগ স্পিনারের পরের ওভারেই টানা দুই বল তিনি উড়িয়ে দেন মাঠের বাইরে।
একাদশ ওভারে দলের রান স্পর্শ করে একশ।
পরের ওভারে ইবাদতকে একটি বাউন্ডারি মারার পর বেশ বাইরের বলে আউট হন নাফে (৪৪ বলে ৬৬)।
একই পথে ক্লার্ক
নাফে যেখানে শেষ করে, সেখান থেকেই যেন শুরু করেন গ্রাহাম ক্লার্ক। ক্রিজে যাওয়ার পরপরই মোহাম্মদ নাবিকে চার ও মেয়ার্সকে ছক্কায় গা গরম করে নেন তিনি। পরে আরেকটি ছক্কা মারেন তানভিরকে। দ্বিতীয় স্পেলে ফেরা বাঁহাতি স্পিনারের ওই ওভারে টানা দুই ডেলিভারিতে বল গ্যালারিতে আছড়ে ফেলেন পারভেজ।
এই জুটিতে ৭০ রান আসে ৪০ বলে।
শেষ চারে আলির দুর্দান্ত দুই
শেষ চার ওভারে প্রত্যাশিত ঝড় তাণ্ডব চালাতে পারেনি চিটাগং। বলা ভালো, সেটা হতে দেননি মোহাম্মদ আলি। শেষ দিকে দুটি অসাধারণ ওভার করেন পাকিস্তানি এই পেসার।
১৭তম ওভারে চারটি সিঙ্গেলের বেশি নিতে দেননি আলি। ইনিংসের শেষ ওভারে রান দেন স্রেফ ৬টি, আউট করেন শামীম হোসেনকে।
এর আগেই ২৩ বলে ৪৪ রান করে রান আউট হয়ে যান ক্লার্ক।
আগের ম্যাচে ৫ উইকেট শিকার করা আলি এবার ৪ ওভারে রান দেন ২১।
শেষ চার ওভারে চিটাগং তুলতে পারে ৩১ রান। এই সময়টায় কোনো বাউন্ডারি মারতে পারেননি পারভেজ। ৩০ বলে ফিফটি করা ব্যাটসম্যান পরের ২৯ বলে করেন ২৮ রান।
বিধ্বংসী তামিম
প্রায় দুইশ রান তাড়ায় যে ধরনের শুরু দরকার, বরিশালকে সেই শুরু এনে দেন তামিম ইকবাল। ইনিংসের প্রথম ওভারে তিনটি চার মারেন তিনি বিনুরা ফার্নান্দোকে, তৃতীয় ওভারে টানা তিন ডেলিভারিতে বাউন্ডারিতে পাঠান শরিফুল ইসলামকে।
পাওয়ার প্লেতে ঠিক চিটাগংয়ের সমান ৫৭ রান তোলে বরিশাল।
তামিমের অবদান তাতে ছিল ৩৯। পরের ওভারে আরাফাত সানিকে চার ও ছক্কায় বরিশাল অধিনায়ক ফিফটিতে পা রাখেন ২৫ বলে।
জোড়া ধাক্কা
ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা তামিমকে বিদায় করে উদ্বোধনী জুটি ৭৬ রান রানে থামান শরিফুল ইসলাম। ছক্কার চেষ্টায় সীমানায় ধরা পড়েন বরিশাল অধিনায়ক (২৯ বলে ৫৪)।
দুই বল পর শরিফুল ফিরিয়ে দেন দুর্দান্ত ফর্মে থাকা দাভিদ মালানকে।
দুই রানের মধ্যে বরিশাল হারায় গুরুত্বপূর্ণ দুটি উইকেট।
নাঈম-চমক
কোয়ালিফায়ারে দুর্দান্ত ইনিংস খেলা তাওহিদ হৃদয় এ দিন খোলসে ঢুকে ছিলেন অনেকটা সময়। ৯ ওভার শেষে তার রান ছিল ২২ বলে ২০।
পরে হুসাইন তালাতের বলে দুটি বাউন্ডারিতে ডানা মেলার চেষ্টা করেন। কিন্তু নাঈম ইসলাম বোলিংয়ে এসেই ছেটে দেন সেই ডানা। হৃদয়ের ইনিংস থামে ২৮ বলে ৩২ রান করে।
আলিস আল ইসলাম ফিট থাকলে নাঈমের খেলার সুযোগই হতো না। সেই তিনি আরও একটি মহামূল্য উইকেট নেন নিজের পরের ওভারে। টানা দুটি বাউন্ডারির পর মুশফিক (৯ বলে ১৬) আউট হন স্লগ সুইপে।
আবার মেয়ার্স
গত বিপিএলের ফাইনালে ব্যাট-বলে অবদান রেখে ম্যাচ-সেরা হয়েছিলেন কাইল মেয়ার্স। এবারও ফাইনালে দলের বিপদের সময় দারুণ খেলে দলকে এগিয়ে নেন ক্যারিবিয়ান অলরাউন্ডার।
মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে ২৯ বলে ৪২ রানের জুটি গড়েন তিনি। সেখানে মাহমুদউল্লাহর রান ছিল ১০ বলে ৭। আলগা বল পেলেই চার-ছক্কা মেরে দলকে লক্ষ্যে রাখেন মেয়ার্স ।
গত ফাইনালে তিনি করেছিলেন ৩০ বলে ৪৬। এবার করেন ২৮ বলে ৪৬।
শেষের নায়ক রিশাদ
দারুণ খেললেও কাজ শেষ করতে পারেননি মেয়ার্স। শরিফুলের বলে আউট হন তিনি সীমানায় ক্যাচ দিয়ে। ওই ওভারে বিদায় নেন মাহমুদউল্লাহও। ১১ বলে ৭ রান করে দলকে বিপদে ঠেলে ফেরেন অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান।
আরেক অভিজ্ঞ মোহাম্মদ নাবিও (৪ বলে ৪) পারেননি দলকে ভরসা দিতে। তবে তরুণ রিশাদ পথ হারাতে দেননি দলকে। শেষ দুই ওভারে তার দুই ছক্কা ফয়সালা করে দেয় ম্যাচের।
হুসাইন তালাতের ওয়াইড থেকে বরিশালের জয় নিশ্চিত হতেই ডাগআউট থেকে ক্রিকেটার ও সাপোর্ট স্টাফের অনেকে ছুটে গিয়ে কাঁধে তুলে নেন রিশাদকে। বরিশালের কর্ণধার মিজানুর রহমান আনন্দে একাই ছুটতে থাকেন মাঠময়। একটু পর পুরো মাঠ প্রদক্ষিণ করে সমর্থকদের ভালোবাসার জবাব দেয় গোটা দল।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
চিটাগং কিংস: ২০ ওভারে ১৯৪/৩ (নাফে ৬৬, পারভেজ ৭৮*, ক্লার্ক ৪৪, শামীম ২*, তালাত ০*; মেয়ার্স ৪-০-৩৫-০, আলি ৪-০-২১-১, তানভির ২-০-৪০-০, ইবাদত ৪-০-৩৫-১, নাবি ৪-০-৩৪-০, রিশাদ ২-০-৩৪-০)।
ফরচুন বরিশাল: ১৯.২ ওভারে ১৯৫/৭(তামিম ৫৪, হৃদয় ৩২, মালান ১, মেয়ার্স ৪৬, মুশফিক ১৬, মাহমুদউল্লাহ ৭, নাবি ৪, রিশাদ ১৮*, তানভির ০*; ফার্নান্দো ৪-০-৪২-১, সানি ২-০-১৯-০, শরিফুল ৪-০-৩৪-৪, খালেদ ৪-০-২৯-০, তালাত ৩.৩-০-৪৪-০, নাঈম ২-০-১৮-২)।
ফল: ফরচুন বরিশাল ৩ উইকেটে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: তামিম ইকবাল।
ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট: মেহেদী হাসান মিরাজ।