বিপিএলের গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ে খুলনা টাইগার্সকে বিধ্বস্ত করে শীর্ষ চারে থাকা নিশ্চিত করল চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স।
Published : 20 Feb 2024, 04:08 PM
লড়াই রূপ নিয়েছিল মূলত অলিখিত কোয়ার্টার-ফাইনালে। প্লে-অফে জায়গা করে নিতে জয় খুব জরুরি ছিল দুই দলের জন্যই। আগুনে এক ম্যাচের রসদ তাই মজুদ ছিল। কিন্তু সেই বারুদ দেখা গেল কেবল চট্টগ্রামের পারফরম্যান্সে। জ্বলে উঠলেন তাদের ওপেনার তানজিদ হাসান। বিধ্বংসী সেঞ্চুরিতে তার একের পর এক স্ট্রোকের তোপে ভস্মীভূত হলো খুলনার আশা।
বিপিএলের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে খুলনা টাইগার্সকে ৬৫ রানে হারিয়ে তৃতীয় দল হিসেবে প্লে অফ নিশ্চিত করল চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স।
চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে তানজিদের দুর্দান্ত ইনিংস চট্টগ্রামকে এনে দেয় ১৯২ রানের পুঁজি। রান তাড়ায় ম্যাচ জমাতেই পারেনি খুলনা। গুটিয়ে যায় তারা ১২৭ রানে।
৮টি করে চার ও ছক্কায় ৬৫ বলে ১১৬ রানের ইনিংস খেলেন তানজিদ। ২০ ওভারের ক্রিকেটে ২৩ বছর বয়সী ওপেনারের যা প্রথম শতরান। এবারের বিপিএলে এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ ব্যাক্তিগত ইনিংসও এটি।
টম ব্রুসের সঙ্গে তার শতরানের জুটি চট্টগ্রামের ইনিংসের মেরুদণ্ড। সেই জুটিতে দাপট ছিল মূলত তানজিদেরই। ৬১ বলে ১১০ রানের জুটিতে তার ব্যাট থেকেই আসে ৪১ বলে ৭৮।
তানজিদের ইনিংসে চোখে পড়ার মতো ব্যাপার ছিল বড় শট খেলার বল ও বোলার নির্বাচন। ইনিংসটি সাজিয়েছেন তিনি পরিকল্পিতভাবে। মূল হুমকি হতে পারতেন যে দুজন, সেই ওয়েইন পার্নেল ও জেসন হোল্ডারের সামনে খুব একটা ঝুঁকি তিনি নেননি। কিন্তু তাণ্ডব চালিয়েছেন দেশের বোলারদের ওপর। বিশেষ করে দুই বাঁহাতি স্পিনার নাসুম আহমেদ ও আরিফ আহমেদকে তুলাধুনা করে ছেড়েছেন তিনি। নিজের জোনে বল পেলে তার তার হাতের জোর ও বড় ছক্কা মারার সামর্থ্যও দেখিয়েছেন আরও একবার।
পার্নেলের ১২ বলে দুটি বাউন্ডারিসহ ১২ রান নিয়েছেন তিনি, হোল্ডারের ১৩ বলে একটি ছক্কাসহ নিয়েছেন ১৪ রান। কিন্তু নাসুম ও আরিফের ২৫ বলে নিয়েছেন ৫৮ রান!
তাকে আটকানোর জন্য কোনো বিশেষজ্ঞ অফ স্পিনারও ছিল না খুলনার একাদশে। মাহমুদুল হাসান জয়কে দিয়ে একটু চেষ্টা করেছিলেন খুলনা অধিনায়ক এনামুল হক। কিন্তু অনিয়মিত এই অফ স্পিনারকেও গ্যালারিতে আছড়ে ফেলেন তানজিদ।
টস হেরে বোলিং নামা খুলনার শুরুটা খারাপ ছিল না। প্রথম দুই ওভারে চট্টগ্রাম নিতে পারে চার রান। এর মধ্যেই নাসুম ফিরিয়ে দেন মুহাম্মাদ ওয়াসিমকে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আগ্রাসী ওপেনার এবারের বিপিএলে প্রথম খেলতে নেমে বিদায় নেন ১ রানেই।
তৃতীয় ওভারে পার্নেলকে দুটি চার মেরে আড়মোড়া ভাঙার ইঙ্গিত দেন তানজিদ। পরের ওভারেই ডানা মেলে দেন তিনি নাসুমকে এক ছক্কা দুই চারে উড়িয়ে। পরের সময়টা এটিই হয়ে থাকে নিয়মিত দৃশ্য। বিপিএল অভিষিক্ত জেসন হোল্ডারকে তিনি স্বাগত জানান প্রথম ওভারে মাথার ওপর দিয়ে ছক্কা মেরে।
আরেক প্রান্তে সৈকত আলি ঠিক তাল মেলাতে পারছিলেন না সেই গতির সঙ্গে। হোল্ডারের প্রথম বিপিএল উইকেট হয়ে তিনি আউট হন ১৭ বলে ১৮ রানে।
এরপরই ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেওয়া জুটি। টম ব্রুসের সঙ্গে যে জুটি মূলত তানজিদের স্ট্রোকের ফোয়ারার গল্প। ৩২ বলে ফিফটি স্পর্শ করার পর আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন তিনি। মুকিদুল ইসলামের ওভারের দুটি বাউন্ডারির মাঝে এক ছক্কা মারেন দাপুটে পুল শট। দুই বাঁহাতি স্পিনার নাসুম ও আরিফ তো যেন বল ফেলার জায়গাই পাচ্ছিলেন না।
সৈকতের মতো ব্রুসও একরকম দর্শক হয়েই থাকেন। জুটির রান যখন ৫০ স্পর্শ করেন, সেখানে ব্রুসের অবদান ছিল ৭, তানাজদের ৪৩!
পরে জুটি শতরান ছোঁয়ার সময়ও অনেকটা একই চিত্র। তানজিদের রান ছিল সেখানে ৭৭, ব্রুসের ২৩।
৭৫ থেকে ছক্কায় ৮০ পেরিয়ে যান তানজিদ। নব্বইয়েও তিনি নড়বড়ে হননি একটুও। ৯২ থেকে ছক্কায় পৌছে যান ৯৮ রানে। শতরানে পা রাখেন ৫৮ বলে।
সেঞ্চুরির পরও ছক্কা-চার আসে তার ব্যাট থেকে। শেষ পর্যন্ত ১৯তম ওভারের প্রথম বলে দুর্দান্ত ইয়র্কারে তাকে বোল্ড করে দেন পার্নেল।
রোমারিও শেফার্ডের দুই চার ও শুভাগত হোমের এক চারে শেষ ওভার থেকেও আসে ১৫ রান।
এত রান তাড়া করতে জরুরি ছিল বিস্ফোরক সূচনা। কিন্তু বিস্ময়করভাবে এভিন লুইসকে ওপেন করায়নি খুলনা। যদিও আগের কয়েকটি ম্যাচেও তাকে একটু নিচে খেলানো হয়েছে। তবে দুইশর কাছাকাছি রান তাড়া করতে যেমন দরকার, সেরকম ঝড়ো ও বড় ইনিংস খেলার সামর্থ্য এই দলের সবচেয়ে বেশি তো লুইসেরই।
কিন্তু তাকে চারে নামায় খুলনা। ওপেন করতে নেমে পারভেজ হোসেন করেন ৮ বলে ৬ রান।
দ্বিতীয় উইকেটে অর্ধশত রানের জুটি গড়েন এনামুল হক ও শেই হোপ। কিন্তু প্রত্যাশিত গতি ছিল না তাদের ব্যাটিংয়ে। ৮ ওভারে উইকেট ১টি হারালেও রান ছিল ৬৭।
তাদের ভেঙে পড়ার শুরু পরের ওভার থেকে। ২৪ বলে ৩৫ রান করে বিদায় নেন এনামুল। শর্ট ফাইন লেগ থেকে অনেকটা দৌড়ে লং লেগ সীমানায় উল্টো হয়েই অসাধারণ ক্যাচ নেন শেফার্ড।
ওই ওভারেই লুইসের রান আউটে আরেকটি বড় ধাক্কা খায় খুলনা। ফিল্ডার শাহাদাত হোসেন যখন নন স্ট্রাইক প্রান্তে থ্রো করলেন, বোলার শহিদুল তখন স্টাম্পের সামনে। সেখান থেকে স্টাম্প না দেখেই দুই পায়ের ফাঁক গলে হাত দিয়ে আলতো ফ্লিক করে বল স্টাম্পে লাগিয়ে দেন শহিদুল।
৬ রানে লুইসের বিদায়েই মূলত খুলনার আমার সমাপ্তি। পরের ওভারে শুভাগতকে একটি ছক্কা মারার পরের বলেই স্লগ করতে গিয়ে উইকেট হারান হোপ (২১ বলে ৩১)। পরের ব্যাটসম্যানরা পারেননি অভাবনীয় কিছু করতে। ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়ে তারা। সম্ভবত টুর্নামেন্ট থেকেও।
অঙ্কের হিসেবে সম্ভাবনা টিকে আছে এখনও। শুক্রবার তারা বিশাল ব্যবধানে সিলেট স্ট্রাইকার্সকে হারাতে পারলে এবং সেদিনই কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের কাছে ফরচুন বরিশাল বাজেভাবে হেরে গেলে খুলনার সুযোগ থাকবে। তবে দুই দলের রান রেটের ব্যবধান এতটাই যে (খুলনার -০.৪০০, বরিশালের +০.৪৩৪), খুলনার সম্ভাবনা একদমই ক্ষীণ।
ম্যাচ শেষে অধিনায়ক এনামুল হকও বললেন, "মনে হয় না আমাদের আর কোনো সুযোগ আছে।'
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স: ২০ ওভারে ১৯২/৪ (ওয়াসিম ১, তানজিদ ১১৬, সৈকত ১৮, ব্রুস ৩৬*, শেফার্ড ১০, শুভাগত ৭*; পার্নেল ৪-০-২৭-১, নাসুম ৩-০-৩৩-১, হোল্ডার ৪-০-২৯-১, মুকিদুল ৪-০-৪৫-১, জয় ১-০-১১-০, আরিফ ৪-০-৪৬-০)।
খুলনা টাইগার্স: ১৯.৫ ওভারে ১২৭ (এনামুল ৩৫, পারভেজ ৬, হোপ ৩১, লুইস ৬, আফিফ ৬, জয় ৭, হোল্ডার ১৮, পার্নেল ২, নাসুম ৩, মুকিদুল ৩, আরিফ ৬*; বিলাল ৪-০-১৩-২, শুভাগত ৪-০-২৫-৩, সাকিল ১.৫-০-১৫-১, শহিদুল ২-০-১৮-১, শেফার্ড ৪-০-২৫-১, নিহাদ ৪-০-২৯-১)।
ফল: চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স ৬৫ রানে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ: তানজিদ হাসান।