এক ওভারে ছয় ছক্কার কীর্তির পর তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগেছিল আইপিএলের নিলামে, টুর্নামেন্ট শুরুর আগে যাকে দেখে রিকি পন্টিং বলেছিলেন ‘স্পেশাল’, সেই ব্যাটসম্যান আবার ঝড় তুললেন ৩৯ বলের সেঞ্চুরিতে।
Published : 09 Apr 2025, 11:29 AM
আইপিএলের প্রতি ম্যাচ শেষেই একগাদা পুরস্কার থাকে। বোলিংয়ের জন্য বরাদ্দ পুরস্কারটি ছাড়া এ দিন বাকি সবকটি জিতলেন একজনই। সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি যেটি, ম্যান অব দা ম্যাচ, সেটি নেওয়ার সময় সঞ্চালক মুরালি কার্তিক বললেন, “প্রিয়ান্শ আরিয়া… দা বেবি-ফেসড বোম্বার ফ্রম দিল্লি…।” তাৎক্ষনিকভাবে মনে হতে বাধ্য, এর চেয়ে আদর্শ উপাধি বুঝি আর হয় না!
আরিয়ার বয়স ২৪। তবে দেখতে একদম যেন নিষ্পাপ শিশুসুলভ। কিংবা টেনেটুনে কিশোর বলা যায়। মিষ্টি হাসির ছেলেটিই ব্যাট হাতে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা এখন সবাই জানেন!
ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের নানা পর্যায়ে গত কয়েক মাসে নিজের সেই ভয়ানক রূপ দেখিয়েছেন আরিয়া। এবার দেখালেন আরেকটু বড় মঞ্চে। দিল্লির সন্তান আইপিএলে পাঞ্জাব কিংসের হয়ে আলোড়ন তুললেন ৪২ বলে ১০৩ রানের ইনিংস খেলে। ব্যাট হাতে যতটা খুনে ছিলেন তিনি, যেভাবে তার ব্যাট থেকে বল গোলার মতো আছড়ে পড়েছে গ্যালারিতে, ‘বোম্বার’ নামটা খুব মানিয়ে যায়!
চেন্নাই সুপার কিংসের বিপক্ষে বুধবার ইনিংসটির পথে ৩৯ বলে সেঞ্চুরি করেন আরিয়া। আইপিএলে যা চতুর্থ দ্রুততম সেঞ্চুরি, ভারতীয় কোনো ব্যাটসম্যানের দ্বিতীয় দ্রুততম শতরান। ৭টি চারের সঙ্গে ৯টি ছক্কা মারেন বাঁহাতি ওপেনার।
স্বীকৃত টি-টোয়েন্টিতে এর চেয়ে বেশি ছক্কা অবশ্য তিনি মেরেছেন কয়েক মাস আগেই। গত ২৩ নভেম্বর সৈয়দ মুশতাক আলি ট্রফিতে দিল্লির হয়ে ১০ ছক্কায় ৪৩ বলে ১০২ রানের ইনিংস খেলেছিলেন সেদিন উত্তর প্রদেশের বিপক্ষে।
এর চেয়ে সময়োচিত সেঞ্চুরি বুঝি আর হয় না! পরের দিনই যে ছিল আইপিএলের নিলাম!
ভারতীয় ক্রিকেটে তখনও তিনি খুব পরিচিত নন। কিন্তু আইপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো তো ঘরোয়া নানা টুর্নামেন্টে নজর রাখে বছরজুড়েই। নিলামে আরিয়াকে পেতে তাই কাড়াকাড়ি পড়ে যায় তিনটি ফ্র্যাঞ্চাইজির। দিল্লি ক্যাপিটালস ও রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর সঙ্গে লড়াই জিতে তাকে পায় পাঞ্জাব। ৩০ লাখ রুপি ভিত্তিমূল্যের ক্রিকেটারের পারিশ্রমিক ততক্ষণে হয়ে গেছে ৩ কোটি ৮০ লাখ রুপি!
নিলামের ঠিক আগের ওই সেঞ্চুরির তাতে বড় অবদান ছিল অবশ্যই। তবে তার দিকে দলগুলির চোখ ছিল আগে থেকেই। গত অগাস্টে দিল্লি প্রিমিয়ার লিগে তিনি খবরের শিরোণামে এসেছিলেন এক ওভারে ছয়টি ছক্কা মেরে। সেদিন ১০টি করে ছক্কা ও চারে ৫০ বলে ১২০ রানের ইনিংস খেলেছিলেন আরিয়া। তার বন্ধু ও দিল্লির আরেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার আয়ুশ বাদোনির সঙ্গে উদ্বোধনী জুটি গড়েছিলেন ২৮৬ রানের। বাদোনি করেছিলেন ৫৫ বলে ১৬৫। তাদের দল সাউথ দিল্লি সুপারস্টার্জ ২০ ওভারে তুলেছিল ৩০৮ রান।
ওই আসরে প্রায় দুইশ স্ট্রাইক রেটে ছয়শর বেশি রান করেন আরিয়া। ১০ ইনিংসে ছক্কা মারেন ৪৩টি। স্বীকৃত টি-টোয়েন্টি নয় বলে রেকর্ড বইয়ে জায়গা পায়নি ওই কীর্তিগুলো। তবে নিজের প্রতিভার ঝিলিক আর ব্যাটের ধার দেখিয়ে ঠিকই নজর কাড়েন আরিয়া।
সেই ফর্ম তিনি বয়ে আনেন সৈয়দ মুশতাক আলি ট্রফিতে। আগের মৌসুমেও এই টুর্নামেন্টে দিল্লির হয়ে ১৬৬ স্ট্রাইক রেটে ২২২ রান করেছিলেন তিনি। তবে চমকপ্রদ ইনিংস তেমন ছিল না বলে সেভাবে নজর কাড়েননি। আইপিএলের নিলামে তাকে নেয়নি কেউ। এবারের সৈয়দ মুশতাক আলি ট্রফিতে নিজেকে ছাড়িয়ে যান আরও দুর্দান্ত পারফর্ম করে। এবার প্রায় ১৭৭ স্ট্রাইক রেটে রান করেন তিনি ৩২৫।
আগের বছর নিলামে অবিক্রিত থাকা ক্রিকেটার এবার সাড়া জাগান নিলামে।
এরকম ধাক্কা খেয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প তার পথচলায় আছে বয়সভিত্তিক ক্রিকেট থেকেই। তার বাবা ও মা দিল্লির সরকারী স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা। ছেলেকে তারা বানাতে চেয়ে চেয়েছেন ক্রিকেটার। ৯ বছর বয়সেই তাকে ভর্তি করে দেওয়া হয় সাঞ্জায় ভারদ্বাজের একাডেমিতে। গৌতাম গাম্ভিরের মতো তারকা উঠে এসেছে এখান থেকে। এখান থেকেই উঠে এসেছেন উন্মুক্ত চাঁদ, নিতিশ রানাসহ আরও অনেক ক্রিকেটার।
কোচ তাদেরকে ট্রেনিং দেওয়ার পাশাপাশি গাম্ভির, রানাদের নেট সেশনে নিয়ে গিয়ে ব্যাটিং দেখতে বাধ্য করতেন। যারা উঠতি ছেলেগুলো কিছু শিখতে পারে, যাতে তাদের মনে গেঁথে যায় বড় ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন।
সেই স্বপ্নের পথ ধরেই ছুটতে থাকে কিশোর আরিয়া। দিল্লির অনূর্ধ্ব-১৪ দলে জায়গা হয় তার। তবে অনূর্ধ্ব-১৬ দলে সুযোগ হয়নি। সে সময় বয়সের পরীক্ষাও তার দেওয়া হয়নি। পরে আবার অনূর্ধ্ব-১৭ দলে ফিরে আসেন, চোখ তখন তার অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে পারফর্মও করেন। কিন্তু গোলমাল হয়ে যায় কড়া একটি নিয়মের কারণে।
বয়স চুরি কমানোর জন্য ভারতীয় ক্রিকেটে নিয়ম আছে, অনূর্ধ্ব-১৯ দলে শুধু তাদেরই বিবেচনা করা হবে, যারা অনূর্ধ্ব-১৬ পর্যায়ে বয়সের পরীক্ষায় উতরে এসেছে। আরিয়ার তো সেই পরীক্ষাই হয়নি! অনূর্ধ্ব-১৯ দলেও তাই আার খেলা হয়নি তার। যুব বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্নও শেষ হয়ে যায়।
সেখান থেকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দিল্লির মূল দলে জায়গা করে নিতে বছর তিনেক লেগে যায়। ভারতীয় ক্রিকেটে নজর কাড়তে সময় লাগে আরও কিছুটা। এর ফাঁকে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ গ্র্যাজুয়েশন সেরে নেন। তবে আসল পথ তো ক্রিকেটে। সেখানেও একটু করে এগোতে থাকেন। দিল্লি প্রিমিয়ার লিগ, সৈয়দ মুশতাক আলি ট্রফি হয়ে এখন তিনি আইপিএল তারকা।
মৌসুম শুরুর আগেই অবশ্য নেটে আরিয়াকে দেখে পাঞ্জাবের কোচ ও অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি রিকি পন্টিং বলেছিলেন, ‘খুবই স্পেশাল’ ও ‘দারুণ সম্ভাবনাময়’ ব্যাটসম্যান। মৌসুমের প্রথম ম্যাচেই সেই ঝলক কিছুটা দেখান। আইপিএল অভিষেকে চাপটাপ পাত্তা না দিয়ে ২৩ বলে করেন ৪৭ রান।
পরের দুই ম্যাচে তার ব্যাট ছিল ঝিমিয়ে। এরপর এবার সেই ব্যাট এমনভাবে জেগে উঠল যে, সবার চোখ ধাঁধিয়ে গেল।
একপ্রান্তে উইকেট পড়েছে নিয়মিত, আরেক প্রান্তে তিনি কচুকাটা করেছেন বোলারদের। পাওয়ার প্লেতে তিন উইকেট হারায় পাঞ্জাব। কিন্তু আরিয়া ফিফটি করেন ১৯ বলে।
পাওয়ার প্লের পরপর উইকেট পড়ে যায় আরও দুটি। আট ওভার শেষে পাঁচ উইকেট নেই দলের। কিন্তু আরিয়ার ব্যাট ঠিকই উত্তাল। পরিস্থিতি আর প্রতিপক্ষকে বুড়ো আঙিল দেখিয়ে চার-ছক্কার ঝড় তুলে পৌঁছে যান শতরানে।
ম্যাচের মাঝ বিরতিতে টিভি সাক্ষাৎকারের জন্য যখন মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়ালেন, তাকে দেখা পেলে বেশ নির্লিপ্ত। সঞ্চালক মুরালি কার্তিক বললেন, “আপনার চেহারায় তো কিছু ফুঠে উঠছে না। কেমন লাগছে, নিজের মতো করে একটু বলুন…।”
আরিয়া বললেন, ব্যাট হাতে তিনি যতটা সাবলীল, প্রতিক্রিয়ায় ততটা নন।
“আমি খুব অভিব্যক্তিপূর্ণ নই। তবে ভেতর থেকে খুব ভালো লাগছে। গত ম্যাচের পর (প্রথম বলে আউট) শ্রেয়াস ভাইয়া (অধিনায়ক শ্রেয়াস আইয়ার) বলেছিলেন যে, নিজের সহজাত প্রবৃত্তি ধরে রাখ। তোর নিজের যেমন লাগে, তেমনই খেলবি।’ আমি সেভাবেই খেলেছি।”
তা তিনি পেরেছেন বটে! আগের ম্যাচে জফ্রা আর্চারের দুর্দান্ত ডেলিভারিতে আউট হয়েছিলেন প্রথম বলেই। এবার তিনি ম্যাচ শুরু করেন প্রথম বলেই খালিল আহমেদকে ছক্কা মেরে! প্রথম ওভারে ছক্কা মারেন দুটি।
আরিয়া জানালেন, তার ক্রিকেট দর্শনই এমন, “আমার চেষ্টা থাকে, যতটা সম্ভব নিজের সহজাত খেলা মেলে ধরা, ঘাবড়ে গিয়ে না খেলা…।”
পরে ম্যান অব দা ম্যাচ হওয়ার পর নিজের অনুভূতি বোঝালেন আরেকটু ভালো করে। সেখানেও আবার বললেন অধিনায়ক শ্রেয়াসের কাছ থেকে পাওয়া প্রেরণার কথা।
“অনুভূতি… আউট অব দা ওয়ার্ল্ড! অনেক বেশি খুশি লাগছে। তবে আমার আশা, আরও বেশি অবদান রাখব দলের জন্য।”
“এভাবেই খেলতে চাই। শ্রেয়াস ভাইয়া (অধিনায়ক শ্রেয়াস আইয়ার) বলেছেন যে, ‘তুই ইন্টেন্ট নিয়ে ব্যাট কর। মারার মতো হলে প্রথম বলও মারবি।’ আগের ম্যাচে প্রথম বলে আউট হওয়ার পরও তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো ব্যাপার না। তোর মাথায় ভাবনা যেমন, সেভাবেই খেলবি।”
দল দ্রুত উইকেট হারানোয় একটু ভিন্ন ভাবনা অবশ্য এসেছিল তার। তবে সতীর্থের পরামর্শে ফিরে গেছেন আপন রূপে।
“আজকে নেহাল (পাঁচে নামা ব্যাটসম্যান) ক্রিজে যাওয়ার পর বলেছিলাম, ‘এখন এক-দুই নিয়ে খেলি, তিন উইকেট পড়ে গেছে।’ কিন্তু সে বলল, ‘দরকার নেই, প্রথম পরিকল্পনা যা, সেভাবেই খেলতে থাক।’ পরে চালিয়ে গেছি।”
আরিয়ার একেকটি শটে ডাগ আউটে থাকা শ্রেয়াসের উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। ম্যাচের পর সেই মুগ্ধতার কথা উঠে এলো পাঞ্জাব অধিনায়কের কণ্ঠেও।
“বাইরে থেকে প্রিয়ান্শকে ব্যাট করতে দেখাটা ছিল চোখধাঁধানো। ‘আউট অব দিস ওয়ার্ল্ড’ ধরনের ইনিংস এটি।”
“গত ম্যাচের পর তার সঙ্গে যখন কথা বলেছিলাম, আমার মনে হয় সিদ্ধান্ত গ্রহনের দিক থেকে সে একটু নড়বড়ে ছিল। আজকে সে সহজাত ব্যাটিং করেছে, নিজের জায়গায় বল পেলে ব্যাট চালিয়ে দিয়েছে। আজকে সে ছিল ভয়ডরহীন এবং আমার দেখা আইপিএলে সেরা ইনিংসগুলোর একটি।”