চক্রটি এমন: ক্ষমতাসীন দল সমর্থিতরা বলে, ‘আমরা নির্বাচন চাই’, বিরোধী দল সমর্থিতরা বলে, ‘নির্বাচন চাই, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে সহাবস্থান জরুরি’, প্রশাসন বলে, ‘সবার এগিয়ে আসা জরুরি।’
Published : 28 Apr 2024, 06:56 PM
পাঁচ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু নির্বাচনের ‘সুফল’ দেখে আবার ভোট দেওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ইয়াসিন আল শাহীন। কিন্তু তিনি এই সুযোগ পাবেন কি না, তা নিশ্চিত নয়।
ডাকসু নিয়ে ৯০ দশক থেকে যে প্রশ্নটি বারবার উঠেছে, সেটি হল, কবে হবে নির্বাচন? ২৮ বছর পর ২০১৯ সালে জট খোলার পরেও প্রশ্ন সেই রয়ে গেছে।
পাঁচ বছর আগে হওয়া সেই নির্বাচনে পর গঠিত ডাকসুর মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে চার বছর হয়ে গেল। কিন্তু ভোটের নাম নেই। ফলে পুরনো প্রশ্নই উঠছে নতুন করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে ৩৭ বার। এর মধ্যে ২৯বারই হয়েছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের ৫০ বছরে। স্বাধীন দেশে ৫৩ বছরে ৮ বার নির্বাচন দেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়।
অথচ ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুসারে, প্রতি বছর ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। ডাকসু মনোনীত পাঁচজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিনেটের সদস্য হন। সিনেটে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা ও সুযোগের বিষয় তুলে ধরেন প্রতিনিধিরা।
নির্বাচন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে থাকছে না শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় শিক্ষার্থীদের মতামত দেওয়ার আনুষ্ঠানিক কোনো প্ল্যাটফর্ম থাকছে না।
নিয়মিত নির্বাচন না হওয়ার ‘চক্রটি’ মোটামুটি এ রকম: ক্ষমতাসীন দল সমর্থকরা বলে, ‘আমরা নির্বাচন চাই’, বিরোধী দল সমর্থকরা বলবে, ‘নির্বাচন আমরাও চাই, তবে হল আর বিশ্ববিদ্যালয়ে সহাবস্থান জরুরি’, কর্তৃপক্ষ বলবে, ‘নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করা হবে। তবে সবার এগিয়ে আসা জরুরি।’
কিন্তু এই তিন ‘শর্ত’ কবে মিলবে বা আদৌ মিলবে কি না, সেই প্রশ্নের সুরাহা হয় না, ভোট আটকে থাকে বছরের পর বছর।
বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ইয়াসিন আল শাহীন এত জটিলতা শুনতে চান না। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী সমিতির নির্বাচন নিয়মিত হচ্ছে। আমরা চাই, অন্যান্য সকল নির্বাচনের মত ডাকসু নির্বাচনও নিয়মিত হোক। এটি ক্যালেন্ডার ইভেন্টে পরিণত হোক।”
নির্বাচন ‘চায়’ সব পক্ষই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি কিছুদিন আগে ‘শিক্ষাঙ্গনে সংকট: ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রাসঙ্গিকতা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল। সেখানে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দ্রুত ডাকসু নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানায়।
ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদসহ দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বদ্ধপরিকর।
“আমরা চাই, এ ব্যাপারে যাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমেই যাতে বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন সূচিত হয়, সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।”
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর দেশে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফেরে। এরপর থেকে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের বক্তব্যে সব সময় সাদ্দামের সুরই বেজেছে।
অন্যদিকে বিরোধী দল সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের বক্তব্যে উঠে আসে ‘ক্যাম্পাসে সহাবস্থান’ এর দাবি, যা এবারও উঠে এল বিএনপি সমর্থক ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বক্তব্যে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, “আমরা সব সময় ডাকসু নির্বাচনের পক্ষে। আজকে দেশে ‘ফ্যাসিস্ট ও অগণতান্ত্রিক’ সরকার ক্ষমতায় । তারপরও আমরা ডাকসু নির্বাচন চাই। তবে নির্বাচনের আগে ক্যাম্পাসে সব ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। সহাবস্থান গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার।”
সহাবস্থানের দাবিতে আন্দোলনে নামার ঘোষণাও দিয়েছেন রাকিব, যে বক্তব্যগুলো বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আসত।
ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি দীপক শীলের দাবিও একই। তিনি বলেন, “অবশ্যই আমরা ছাত্র সংসদ নির্বাচন চাই। তার আগে আমরা ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ চাই। সকল ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান চাই। সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ‘দখলদারত্বের’ অবসান ঘটাতে হবে। ক্যাম্পাসটাকে ওই সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে ‘মিনি ক্যান্টনমেন্ট’ করে রেখেছে।”
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের (বাসদ) সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে দল-মত নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থীর মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য ডাকসু নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি।”
সর্বশেষ ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক ও গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির সভাপতি আখতার হোসেন বলেন, “দীর্ঘ ২৮ বছরের অচলায়তন ভেঙে ডাকসু নির্বাচন হওয়ার পর আবারও নির্বাচনহীন ৪ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে, এটা দুঃখজনক। আমরা মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ চালু থাকলে শিক্ষার্থীদের একটা বৈধ প্ল্যাটফর্ম থাকে।”
ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মশিউর রহমান রিচার্ড বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণে ডাকসুর ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত।”
সহাবস্থান না থাকাই সংকট?
২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান।
উপাচার্য হিসেবে তার মেয়াদের মধ্যে আবার কেন ভোটের ব্যবস্থা করা গেল না- এই প্রশ্নে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বললেন সহাবস্থানের কথা, যে প্রসঙ্গটি সরকার বিরোধী ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা বারবার বলে থাকেন।
আখতারুজ্জামান বলেন, “নির্বাচনের জন্য ছাত্রদের একটা সহাবস্থান প্রয়োজন হয়। ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের উন্নয়ন হওয়া জরুরি। এ কাজটি হলে অনেক ধাপ এগিয়ে যাওয়া যায়। জাতীয় রাজনীতিতেও সংহতির জায়গাগুলো শক্তিশালী করা প্রয়োজন। দুই জায়গা থেকেই সাপোর্ট প্রয়োজন।”
এরশাদ সরকারের পতনের পর থেকে দেখা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সব সময় ক্ষমতাসীন দল সমর্থক ছাত্র সংগঠনের দাপট থাকে। হলগুলো থাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে আর ভোট নেওয়া হয় হলে। সেখানে বিরোধী দল সমর্থকরা কর্মীরা না থাকলে ভোটের সময় ক্ষমতাসীন দল সমর্থকরাই থাকে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায়।
প্রায় তিন দশক পর ডাকসু নির্বাচনের বেশ কিছু সুফল দেখেছেন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, “এতে ছাত্রদের মধ্যে একটি প্রাণচাঞ্চল্য চলে আসে। ছাত্রদের প্রতিনিধি থাকে।
“যখন ছাত্রদের প্রতিনিধিরা থাকে, তাদের একটা বক্তব্য থাকে। এটা গ্রহণযোগ্য হয় এ কারণে যে, ছাত্র প্রতিনিধি কথা বলেছে শিক্ষার্থীদের জন্য। তখন অন্যরা সংঘবদ্ধ হয়।
“শিক্ষার্থীদের ভোটে যখন কোনো প্রতিনিধি হয়, তখন সেটির গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা এবং কার্যকারিতা একটি ভিন্ন মাত্রা পায়।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের এখানে দুর্ভাগ্য, সহাবস্থানের পরিবেশ গড়ে উঠেনি। মানুষের সঙ্গে মানুষের মত পার্থক্য থাকবেই। তা সত্ত্বেও সৃজনশীল কাজ করতে প্রয়োজন হয় পারস্পরিক সহযোগিতা। এই মূল্যবোধ গড়ে উঠতে হবে।”
তিনি বলেন, “নির্বাচন করতে গেলে ছাত্রদের মধ্যে যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য থাকা দরকার, ওইটা ‘নাই’ হয়ে গেছে। এই বাস্তবতার মধ্যে সবার মত বিবেচনা করে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আওয়ামী লীগ সরকার সরকারের কাছেও আমরা প্রত্যাশা করব, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের যাতে উদ্যোগ নেওয়া হয়।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলছেন, “সুন্দর পরিবেশ পেলে আমরা নির্বাচনের আয়োজন করতে পারি। এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। এই দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা কোনো ছাত্রসংগঠনের একার নয়। এতে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে সহযোগিতা করতে হবে।”
নির্বাচনের কী সুফল
২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচন এবং সেই ছাত্র সংসদের মেয়াদের এক বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী ইয়াসিন আল শাহীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অল্প সময়ে এই ডাকসু বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। মাঝখানে মহামারীর কারণে অনেক কাজই করতে পারেননি নেতারা। তারপরও অনেক কাজ হয়েছে, সেটা অস্বীকার করা যাবে না।”
পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আফসানা জামান সাদিয়া বলেন, “শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হয়েছিল। তারা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের জিম্মি দশা থেকে বের হয়েছে ভয়েস রেইজ করতে পেরেছিল। গেস্টরুম ও গণরুমের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পেয়েছিল। কিন্তু এখন ডাকসু না থাকাতে আমাদের আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে হয়েছে।
“ডাকসু নেতারা বেশ কিছু কাজ করেছেন, যা প্রশংসার দাবি রাখে। হলের খাবারের মূল্য নির্ধারণ, ক্যান্টিন স্থাপনের উদ্যোগ, ছাত্রীদের কমনরুমের সংস্কার, বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের জন্য ভেন্ডিং মেশিন স্থাপন, বিশ্ববিদ্যালয়ে জো-বাইক চালু ইত্যাদি অনেক কাজই করেছেন।”
সবশেষ ডাকসু নির্বাচনে জয়ী সদস্য ও বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা শিক্ষার্থীদের জন্য যথাসাধ্য কাজ করেছি। ডাকসুর ৫ জন নেতা সিনেটে প্রতিনিধিত্ব করেছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়ার বিষয়ে কথা বলেছে।
“আমরা অনেকগুলো উদ্যোগ নিয়েছিলাম। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম, ভেন্ডিং মেশিনের উদ্যোগ, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, ডিপার্টমেন্টের ফি ও ফরমের মূল্য হ্রাস, খেলাধুলার আয়োজনসহ অনেক কাজ ডাকসুতে হয়েছে। কালচারালি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ভালো মুভমেন্ট হয়েছে। এটার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা দরকার।”
সর্বশেষ ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক ও গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির সভাপতি আখতার হোসেন বলেন, “শিক্ষার্থীদের কথা বলার একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিয়েছিল ডাকসু। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ও হলের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে পারছিলেন। হলগুলোতে গেস্টরুম নির্যাতন কমে এসেছিল।”
ফি দিয়েই যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা
ডাকসু সচল না থাকলেও প্রতি বছরই ফি দিতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব পরিচালকের দপ্তর থেকে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর ভর্তির সময় ডাকসুর জন্য ৬০ টাকা ও হল সংসদের জন্য ৬০ টাকা করে জমা দিতে হচ্ছে তাদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী আছেন। সে হিসেবে প্রতিবছর ডাকসু ও হল সংসদের জন্য মোট ৪২ লাখ টাকা করে জমা দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
ডাকসু নির্বাচনের পর চারটি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সে হিসেবে গত চার বছরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দেড় কোটি টাকার বেশি ফি আদায় করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
ডাকসুর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা বাবদ প্রতি বছর খরচ করা হচ্ছে কম বেশি ৩০ লাখ টাকা । যদিও তারা বলতে গেলে ‘অলস’ সময় কাটাচ্ছেন।
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, “ডাকসুর জন্য যে ফি নেওয়া হচ্ছে, সেটা সংরক্ষিত থাকছে। ডাকসু হলে সেটা ব্যয় করা হবে।”
অকার্যকর পরিবেশ পরিষদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থান ও ক্যাম্পাসে মৌলবাদী ছাত্র সংগঠনকে প্রতিহত করতে আশির দশকে গঠন করা হয়েছিল ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ পরিষদ'।
পদাধিকারবলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এর প্রধান এবং ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এ পরিষদের সদস্য।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই বছরই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের সামনে ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষের পর ক্যাম্পাস ত্যাগ করে ছাত্রদল। ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচনের আগে পরিবেশ পরিষদের সভার সিদ্ধান্তে ১০ বছর পর ফের ক্যাম্পাসে ফেরে তারা। তবে ডাকসুর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারছে না ছাত্রদল। ঢুকলেই তাদের উপর হামলা হয়।
দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ পরিষদ অকার্যকর বলে অভিযোগ ছাত্রনেতাদের। সবার সহাবস্থান নিশ্চিত করতে দ্রুত পরিবেশ পরিষদের সভা ডাকার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, ক্যাম্পাসের পরিবেশ ঠিক রয়েছে। এই মুহূর্তে পরিবেশ পরিষদের সভা ডাকার প্রয়োজন দেখছেন না তারা।
ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। ২০২২ সালের ২৪ ও ২৬ মে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এবং পরে দোয়েল চত্বর এলাকায় ছাত্রলীগ আমাদের উপর হামলা চালায়।… আমরা এসবের অবসান চাই। দ্রুত পরিবেশ পরিষদের মিটিং ডেকে ক্যাম্পাসে সব ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।”
ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি দীপক শীল বলেন, “প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপন উপলক্ষে পরিবেশ পরিষদের মিটিং ডাকা হত। গত দুই বছর ধরে তা-ও হচ্ছে না। ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাদের নিয়ে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ কাণ্ডকীর্তি করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।”
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ বলেন, “সরকারের ‘আজ্ঞাবহ’ প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছে। পরিবেশ পরিষদ অকার্যকর। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের পছন্দের সংগঠনের নেতাদের নিয়ে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন, এটা অগণতান্ত্রিক।”
ডাকসু থাকলে পরিবেশ পরিষদের দরকার পড়ে না বলে মনে করেন ছাত্র সংসদের সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন।
তিনি বলেন, “ডাকসু বিশ্ববিদ্যালয়ের যেমন একটা আনুষ্ঠানিক বিষয়, পরিবেশ পরিষদ কিন্তু অনানুষ্ঠানিক। সেটা করা হয়েছিল ডাকসু না থাকার প্রেক্ষাপটে। কিন্তু আমরা চাই, ডাকসু চালু থাকুক।”
উপাচার্য মাকসুদ কামাল এ প্রসঙ্গে বলেন, “আদতে পরিবেশ পরিষদ বলতে কী ছিল, কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে কি না, কীভাবে অনুমোদিত হয়েছে, এগুলো নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। বিষয়টা দেখে আমরা কার্যকর পদক্ষেপ নেব।”