নতুন অর্থবছরের জন্য প্রায় আট লাখ কোটি টাকার বাজেট উত্থাপনের প্রস্তুতি চলছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন।
Published : 14 May 2024, 01:29 AM
উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের চতুর্থ মেয়াদের প্রথম বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির উপকারভোগী মানুষের সংখ্যা ও কর্মসূচির পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
এবারের বাজেটে এর সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গ্রামীণ অবকাঠামো খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকবে বলে জানিয়েছেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান।
পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, রপ্তানিপণ্যের বৈচিত্র্যকরণসহ একগুচ্ছ অর্থনৈতিক সংস্কারকে সামনে রেখে বাজেট সাজানো হচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জন্য প্রায় আট লাখ কোটি টাকার বাজেট উত্থাপনের প্রস্তুতি চলছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। এটি হবে বর্তমানে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রথম বাজেট।
আসন্ন বাজেট সামনে রেখে ব্যস্ত সময় পার করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। গত কয়েক দিন ধরে দফায় দফায় কর্মকর্তাদের বৈঠকের পাশাপাশি কর্মচারীদেরকে ফাইলবন্দি কাগজপত্র নিয়ে দৌঁড়ঝাপ করতে দেখা যাচ্ছে।
চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট বাস্তবায়নাধীন। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয় ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয় ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা।
আগামী ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি ব্যয় বরাদ্দ রেখে বাজেট পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে বলে কয়েকজন কর্মকর্তা ইঙ্গিত দিয়েছেন। বাজেট সামনে রেখে বেশ গোপনীয়তার সঙ্গে প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছেন তারা।
অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের বাজেট বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দুই প্রান্তিক মিলিয়ে (জুলাই-ডিসেম্বর) মোট ব্যয় হয়েছে এক লাখ ৯৪ হাজার ৮৯৮ কোটি টাকা, যা মোট বাজেট বরাদ্দের ২৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয় এক লাখ ৫৩ হাজার ৫৭ কোটি টাকা।
সার্বিকভাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় অর্থ খরচের পরিমাণ বেড়েছে ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয় এক দশমিক ০৯ শতাংশ বেড়েছে। আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন বেড়েছে ২৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তার কার্যালয়ে বাজেটের সর্বশেষ প্রস্তুতি তুলে ধরে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা নেন অর্থমন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা মঙ্গলবার কর রাজস্বসহ অন্যান্য সম্পদ আহরণের পরিকল্পনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যাবেন।
প্রধানমন্ত্রী বাজেট পরিকল্পনা নিয়ে কী নির্দেশনা দিয়েছেন জানতে চাইলে অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সংসদে বাজেট উত্থাপনের আগে এর কোনো সংখ্যাতাত্ত্বিক তথ্য প্রকাশ করা হবে না।
“তবে সামগ্রিকভাবে বলা যায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানিপণ্যের বৈচিত্র্যকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও প্রান্তিক মানুষের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি এবারের বাজেটের অগ্রাধিকারে থাকবে।”
আওয়ামী লীগের গত সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল চলতি অর্থবছরের জন্য যে বাজেট দিয়েছিলেন, তাতেও মূল্যস্ফীতি থেকে সাধারণের মুক্তি আর ‘স্মার্ট’ বাংলাদেশের স্বপ্নের কথা বলা হয়েছিল। সঙ্গে ছিল আইএমএফের দেখানো পথে একগুচ্ছ সংস্কারের ঘোষণা।
এবারের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়, যা বাজেটের ১৬.৫৮ শতাংশ এবং জিডিপির ২.৫২ শতাংশ।
সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়ানোর অংশ হিসেবে ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হয় ৮ লাখ ৫০ হাজার। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিভিন্ন পর্যায়ের ভাতাভোগীর ভাতা ৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয় বাজেটে।
সামাজিক নিরাপত্তা ও সেবার অংশ হিসেবে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাও চালু করা হয় গতবছর অগাস্টে।
নতুন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা আরো বাড়বে জানিয়ে অর্থ প্রতিমন্ত্রী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এবার বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি।”
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশে বেঁধে রাখার পরিকল্পনা নিলেও অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের বাজেট বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদনে তা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করার তথ্য জানানো হয়।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ছিল। গত জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ নতুন মেয়াদে সরকার গঠন করার পর থেকে সেজন্য বিভিন্ন উদ্যোগও নিতে দেখা যায়।
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিপু, খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, মৎস্য ও প্রাণি সম্পদমন্ত্রী আব্দুর রহমানসহ মন্ত্রিপরিষদের বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সদস্যকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন সরকারপ্রধান। তবুও মূল্যস্ফীতির হার সহনীয় মাত্রায় নামছে না।
সবশেষ এপ্রিল মাসেও পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
নতুন বাজেটেও সেই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে জানিয়ে অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, “প্রধানমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন যেন বাজেটে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়, সেই নির্দেশনা দিয়েছেন।”
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিসর বাড়াতে সরকারের পরিকল্পনাকে সাধুবাদ জানিয়ে অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন জিনিসপত্রের যে দাম, সেখানে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিসর না বাড়িয়ে অন্য কোনো উপায় দেখছি না। কারণ, মূল্যস্ফীতি সহসা কমে আসবে বলে মনে হচ্ছে না।
“সুতরাং যদি হয়, সেটা ভালো খবর। মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে এটা দরকার। এটার ব্যাপক প্রসার হওয়া উচিত। বেশ বড় সংখ্যক ভালনারেবল পুওর মূল্যস্ফীতির কারণে চাপে পড়ে গেছে। তাদের জন্য সেভাবে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নেই।”
তিনি বলেন, “কনভেনশনাল কর্মসূচিগুলো দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে টার্গট করে। শহরে যে অতি দ্ররিদ্র বা নতুন দরিদ্র, তাদের জন্য কোনো কর্মসূচি নেই। এবারের বাজেট কাভারেজে সেটাও থাকা উচিত। অনেক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারও চাপে আছে। টিসিবি বা ওপেন সেলের মাধ্যমে চাল ডাল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলো বিপণন করা গেলে কিছুটা রিলিফ পাওয়া যাবে।”
দরিদ্রদের মধ্যে স্বল্পমূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রির জন্য টিসিবির মাধ্যমে যে এক কোটি ফ্যামিলি কার্ড সরকার চালু করেছে, তা নিয়মিত হালনাগাদ করা দরকার বলে মনে করে সেলিম রায়হান।
তিনি বলেন, “যেভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হয়, সেখানে অনেক প্রতিষ্ঠানিক দুর্বলতা আছে। যার থাকার কথা না সে ঢুকে পড়ছে, আবার যার দরকার সে হয়ত কোনো কারণে কার্ডের অধীনে আসতে পারেনি। বাংলাদেশের মত জায়গায় এগুলো খুবই চ্যালেঞ্জিং।”
কর অবকাশ
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল আর্থিক খাতের সংস্কার। আইএমএফ এর ঋণ চুক্তির অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়াও হয়েছে।
নতুন বাজেট আর সংস্কারমূলক কী কী পদক্ষেপ থাকছে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “যেসব খাত দীর্ঘদিন কর অবকাশ সুবিধা পেয়ে আসছে, সেসব খাত থেকে কর অব্যাহতির সুবিধা উঠিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটি আমরা সুনির্দিষ্টভাবে খতিয়ে দেখছি।
“কয়েকটি খাত গত ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে কর অবকাশ সুবিধা পেয়ে আসছে। ইতোমধ্যে দেশীয় বাজারে তারা যথেষ্ট সক্ষমতা অর্জন করেছে। এ অবস্থায় তাদের রপ্তানির দিকে মনোযোগী হওয়া উচিত। কর অবকাশের বাড়তি সুবিধা উঠিয়ে নিলে এসব খাতের উদ্যোক্তারা রপ্তানির প্রতি মনোযোগী হবেন।”
ভিন্ন ধরনের ২৭টি খাতে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা এখন কর অবকাশ সুবিধা পায়। এই সুবিধার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে আগামী ৩০ জুন। সেই মেয়াদ আর না বাড়ানোর শর্ত দিয়ে রেখেছে আইএমএফ। আসন্ন বাজেটে ডজনখানেক খাতের কর অবকাশ সুবিধা উঠে যেতে পারে বলে ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে।
অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমাদের রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ করা প্রয়োজন। দেশীয় বাজারে বেশ ভালো সক্ষমতা অর্জন করেছে এমন কোম্পানি ও পণ্যগুলোকে এখন আন্তর্জাতিক বাজার খুঁজতে হবে।”