সরকার শিগগিরই এই দাবি মেনে নেবে বলে আশা করছেন শিক্ষক সমিতির নেতারা।
Published : 30 Jun 2024, 04:29 PM
বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিম’ বাতিল না হওয়ায় সারাদেশে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন।
রোববার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলন করে এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, পেনশন সংক্রান্ত ‘বৈষম্যমূলক’ প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের দাবিতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে আসছে।
“১৩ মার্চ ২০২৪ অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে বিবৃতি প্রদান, গণস্বাক্ষর সংগ্রহ, মানববন্ধন, প্রতীকী কর্মবিরতি, স্মারকলিপি প্রদান এবং অবস্থান কর্মসূচি মতো শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়। এ সময়ে সরকারের তরফ থেকে কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় গত ২৫, ২৬ ও ২৭ জুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালিত হয় এবং শনিবার ৩০ জুন পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালিত হচ্ছে। সোমবার থেকে আমরা সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে যাব।”
সরকার শিগগিরই এই দাবি মেনে নেবে বলে আশা করছেন শিক্ষক সমিতির এই নেতা।
তিনি বলেন, “না হলে ১ জুলাই থেকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সারাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালিত হবে।”
গত মার্চ মাসে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে আগের চারটি স্কিমের সঙ্গে ‘প্রত্যয় স্কিম’ নামের একটি প্যাকেজ চালু করে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এতে অন্তর্ভুক্ত থাকবেন সব ধরনের স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীনস্থ অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ২০২৪ সালের ১ জুলাই পরবর্তী সময়ে যোগ দেওয়া কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা।
শিক্ষক সমিতির দাবি, এ স্কিম ‘বৈষম্যমূলক’। এতে আগামী ১ জুলাই এবং এর পরে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি চলবে: ঢাবি শিক্ষক সমিতি
প্রত্যয় স্কিমকে ‘বৈষম্যমূলক’ আখ্যায়িত করে তা বাতিলের দাবিতে সোমবার থেকে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ সর্বাত্মক কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও।
রোববার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি থেকে ঘোষণা দেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া এবং সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জিনাত হুদা।
লিখিত বক্তব্যে তারা বলেছেন, ‘বৈষম্যমূলক ও মর্যাদাহানিকর’ প্রত্যয় স্কিম থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহার, শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন, প্রতিশ্রুত সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তির দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালিত হবে।
সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়, কর্মবিরতির মধ্যে
সব বিভাগের সব ক্লাস বন্ধ থাকবে। অনলাইন, সান্ধ্যকালীন ক্লাস, শুক্র ও শনিবারের প্রফেশনাল কোর্সের ক্লাসও বন্ধ থাকবে।
এছাড়া শিক্ষকরা মিডটার্ম, ফাইনাল ও ভর্তি পরীক্ষাসহ সব পরীক্ষা বর্জন করবেন। এ সময়ে বিভাগীয় চেয়ারম্যান বিভাগীয় অফিস, সেমিনার, কম্পিউটার ল্যাব ও গবেষণাগার বন্ধ রাখবেন। একাডেমিক কমিটি, সমন্বয় ও উন্নয়ন কমিটি, প্রশ্নপত্র সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হবে না।
অনুষদের ডিনবৃন্দ ডিন অফিস, ভর্তি পরীক্ষাসহ সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম বন্ধ রাখবেন। নবীন বরণ অনুষ্ঠানের কর্মসূচি গ্রহণ করা যাবে না। কোন সিলেকশন বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হবে না।
বিভিন্ন ইন্সস্টিটিউটের পরিচালকরা ইন্সস্টিটিউটের অফিস, ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রাখবেন। সান্ধ্যকালীন, শুক্র ও শনিবারের ক্লাস বন্ধ থাকবে।
বিভিন্ন গবেষণাধর্মী সেন্টারের পরিচালকরা সেমিনার, কনফারেন্স ও ওয়ার্কশপ কর্মসূচি গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবেন।
বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষরা প্রাধ্যক্ষ অফিস বন্ধ রাখবেন এবং বন্ধ থাকবে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি।
এর আগে সকাল ১০টার দিকে প্রশাসনিক ভবনের সামনে এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতারা অবস্থান নেন। পরে বেলা ১১টার দিকে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে সমাবেশ করেন তারা।
পরিষদের আহ্বায়ক মো. আব্দুল মোতালেব বলেন, “আমরা সকাল থেকে কর্মসূচি শুরু করেছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।”
উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ শিক্ষকদের যৌক্তিক আন্দোলনে আমাদের সমর্থন রয়েছে। তবে ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে। তাই আমরা আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছি।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও কর্মসূচি পালন
'প্রত্যয় স্কিম' প্রত্যাহার না করায় সর্বাত্মক কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিও।
এদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে পেনশন স্কিমের আওতামুক্ত করার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা সমিতি এবং কর্মকর্তা, কর্মচারী ও সহায়ক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করেছে রোববার। বিশ্ববদ্যালয়ের শহীদ মিনারে প্রাঙ্গনের ওই সমাবেশ থেকেই সর্বাত্মক কর্মবিরতির ঘোষণা আসে।
বিশ্ববিদ্যালয় রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক একেএম লুৎফর রহমান বলেন, “সোমবার থেকে কোনো ক্লাস হবে না, কোনো পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না। চেয়ারম্যানরা নিজ নিজ বিভাগ বন্ধ করে দেবেন। হলের হাউজ টিউটররা এখন থেকে হলে যাবেন না। কোনো ইনস্টিটিউটের পরিচালক আর ইনিস্টিটিউটে যাবেন না। এমনকি শিক্ষকদের অনলাইন ক্লাসও না নেয়ার জন্য আহ্বান করবো।”
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মাশরিক হাসান বলেন, “এ বৈষম্যমূলক স্কিমে বলা আছে ৭৫ বছর পর্যন্ত সরকার আমাদের পেনশন দিবে। কিন্তু এর পরে যদি রোগ-শোক হয়, তখন আমাদের কি হবে? বিভাগগুলোকেও আমরা জানিয়ে দিয়েছি কোনো কাজ কেউ করবে না।”
এর আগে একই দাবিতে গত ২৬ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে মানববন্ধন ও কর্মবিরতি কর্মসূচি পালন করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মসূচি
সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালার প্রজ্ঞাপন থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্তি প্রত্যাহারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা সমিতি এবং কর্মকর্তা, কর্মচারী ও সহায়ক কর্মচারী সমিতি সদস্যরা কর্মবিরতি ও প্রতিবাদ সভা করেন রোববার।
এদিন বেশিরভাগ দপ্তরে তালা ঝুলিয়ে প্রকৌশলী দপ্তর, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর, ডিন অফিসসহ বিভাগগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্যাম্পাসের ভাস্কর্য চত্বরের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।
কর্মবিরতিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি মো. আব্দুল কাদের বলেন, “সর্বজনীন পেনশন স্কিম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাদ দিতে হবে। আমাদের দাবি না মানা হলে আমরা বিভাগ তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কার্যক্রম থেকে বিরত থাকব।”
সহায়ক কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. আবু সাঈদ বলেন, “বাংলাদেশ আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সহায়ক কর্মচারী কল্যাণ সমিতির ঘোষিত কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আমরা কর্মসূচি পালন করছি।”
‘প্রত্যয়’ স্কিমে যা বলা হয়েছে
সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আগের চারটি স্কিমের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে সরকারি চাকরিজীবীদের।
গত ২০ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে প্রত্যয় ঘোষণা করে তার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে।
এর আগে গত ১৩ মার্চ ‘প্রত্যয় স্কিম’কে যুক্ত করে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন ২০২৩ এর ২৯ ধারার ক্ষমতাবলে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এসআরও আকারে প্রকাশ করা হয়।
সংশোধনী অনুযায়ী, সব ধরনের স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ২০২৪ সালের ১ জুলাই পরবর্তী সময়ে যোগদানকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত হবেন। এই স্কিমের নাম হবে ‘প্রত্যয়’ ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রত্যয় স্কিম চালুর ফলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদ্যমান কর্মকর্তা/কর্মচারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে না এবং তাদের বিদ্যমান পেনশন বা আনুতোষিক সুবিধা অক্ষুণ্ণ থাকবে।
তবে, যাদের ন্যূনতম ১০ বছর চাকরি অবশিষ্ট আছে তারা আগ্রহ প্রকাশ করলে প্রত্যয় স্কিমে অংশ নিতে পারবেন।
প্রত্যয় স্কিমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অবসর জীবনে মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন বিধায় ২০২৪ সালের ১ জুলাই এর পরবর্তী সময়ে নতুন যোগদান করা কর্মকর্তা/কর্মচারীদের ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।