চার মাস ধরে কাজ শুরুর অপেক্ষায় একটি কারখানা

এ সংকট শুধু এক কারখানার নয়; উদ্যোক্তারা বলছেন, মহামারীর সময়ও তাদের এতটা ক্ষতির মুখে পড়তে হয়নি।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Nov 2022, 10:03 PM
Updated : 27 Nov 2022, 10:03 PM

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় বিসিক শিল্প নগরীতে এমএস ডায়িং, প্রিন্টিং অ্যান্ড ফিনিশিং লিমিটেডের নতুন কারখানাটি গত জুলাই মাসে যখন উৎপাদনে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হল, তখনই দেশে গ্যাস সংকট বাজে চেহারা নিল। ফলে শুরুতেই যাত্রানাস্তি।

প্রায় দুই বছরের চেষ্টায় সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬০ টন উৎপাদন সক্ষমতার ওই ডায়িং প্ল্যান্টটি স্থাপন করেছে এমএস ডায়িং। সেখানে এখনও কাজ শুরু করা যায়নি।

নতুন ওই কারখানার পাশেই ৩৫ টন উৎপাদন সক্ষমতার আরেকটি পুরোনো ডায়িং ইউনিট রয়েছে এমএস ডায়িংয়ের। স্বল্প চাপের গ্যাস দিয়ে পুরোনো ইউনিটে সক্ষমতার ১৫ শতাংশ কাজ করা যাচ্ছে।

এমএস ফিনিশিংয়ের মত একই দশা এমবি ফ্যাশন, ফোর ডিজাইন লিমিটেডসহ শিল্প নগরীর অন্য কারখানাগুলোর। শিল্প মালিকরা অভিযোগ করছেন, নারায়ণগঞ্জের অন্যান্য শিল্প এলাকা, গাজীপুর আর চট্টগ্রাম– সবখানেই শিল্প কারখানাগুলো গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে ধুঁকছে।

এমএস ডায়িং, প্রিন্টিং অ্যান্ড ফিনিশিং লিমিটেডের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার কবির আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দুই বছরের প্রাণান্তকর পরিশ্রমের পর আমাদের নতুন ডায়িং ইউনিটটি জুলাই মাসে উৎপাদনের জন্য রেডি করা হল। কিন্তু গ্যাস সংকটে একদিনের জন্যও কাজে লাগানো গেল না।

“গ্যাসের চাপ কম হওয়ায় কোনো রকমে রেশনিং করে ৩৫ টনের পুরোনো ইউনিটে দিনে মাত্র ৫ টন উৎপাদন করত পারছি।”

Also Read: উত্তরাঞ্চলে ফিলিং স্টেশনে গ্যাস সংকট, ভোগান্তি

Also Read: চিনির মজুদ আছে, তবে গ্যাসের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত: টিপু মুনশি

Also Read: চেষ্টা করছি যাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ না হয়: বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী

কবির আহমেদ জানালেন, ডায়িংয়ের পাশাপাশি ফিনিশিংয়ের (কাপড় শুকানো) কাজও একপ্রকার বন্ধ। গ্যাস রেশনিং করে মাঝে মধ্যে সেখানে কাজ হচ্ছে শুধু।

“প্রতি কেজি ডায়িংয়ের জন্য ১৩০ টাকা হিসাবে দুই ইউনিটে দৈনিক প্রায় পৌনে এক কোটি টাকা সমমূল্যের উৎপাদন সক্ষমতা এখন অলস পড়ে আছে। ডায়িং, ফিনিশিং ও অন্যান্য ইউনিটে আড়াই হাজার শ্রমিক কাজ করে। কাজ না থাকায় ৭০ শতাংশ শ্রমিক অলস বসে থাকে।”

২০০৭ সালে প্রথম ডায়িং ইউনিট স্থাপন করে এমএস। তারপর বেশ ভালোই এগোচ্ছিল সব। প্রতি বছরই বাড়ছিল কাজের পরিধি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ায় ৩৫ টন ডায়িং ক্যাপাসিটির পুরনো ইউনিটের পাশে ৬০ টনের নতুন ইউনিটটি স্থাপনের কাজ শুরু হয় মহামারীর মধ্যেই।

আন্তর্জাতিক খোলা বাজারে এলএনজির ঊর্ধমুখী দাম ও দেশে ডলার সংকটের কারণে সরকার এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দেয়। এর প্রভাবে দেশে চাহিদার বিপরীতে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প উৎপাদন দুটোই ব্যাহত হতে থাকে।

রাষ্ট্রীয় তেল-গ্যাস কোম্পানি পেট্রোবাংলার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশীয় গ্যাসকূপ ও এলএনজি মিলিয়ে দৈনিক মোট ৩৭৬০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি) গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা থাকলেও এখন সরবরাহ করা যাচ্ছে ২৫৯৩ এমএমসিএফডি।

এর মধ্যে ১০০০ এমএমসিএফডি এলএনজি সরবরাহ সক্ষমতার বিপরীতে ৩৮০ এমএমসিএফডি সরবরাহ করা যাচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে, সার কারখানা, শিল্প কারখানা, আবাসিক গ্রাহক মিলিয়ে দেশে মোট দৈনিক চাহিদা ৩৮০০ এমএমসিএফডির কিছু বেশি।

Also Read: বিল বকেয়া: ৩০০০ গ্রাহকের সংযোগ কাটছে তিতাস

Also Read: জ্বালানি নিয়ে কঠিন সময় পার করছি: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

Also Read: গ্যাস সঙ্কটে গতিহারা পোশাক খাত

Also Read: গ্যাস সংকটে নাকাল নারায়ণগঞ্জ, বাড়ি-কারখানায় ভোগান্তি চরমে

Also Read: ‘গ্যাস সঙ্কটের’ আঁচ বিদ্যুতে, বাড়ছে লোডশেডিং

শীত চলে আসায় নভেম্বরের মাঝামাঝি বিদ্যুৎ সংকট অনেকটা কেটে গেছে বলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে। তবে গত জুলাই থেকে শুরু হওয়া গ্যাস সংকট এখনও ভোগাচ্ছে শিল্প কারখানাগুলোকে।

সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে, যোগান বাড়িয়ে গ্যাস সংকট কাটানোর মত পরিস্থিতি আপাতত নেই। তবে আগামী বছরের শুরুতে একাধিক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলে গ্যাস সমস্যার কিছুটা সমাধান হতে পারে বলে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী আশা প্রকাশ করে আসছেন।

ফতুল্লা বিসিকে আরেক পোশাক কারখানা এমবি ফ্যাশনের বিভিন্ন ফ্লোরে গিয়ে দেখা যায়, সেলাই ইউনিটগুলো সচল থাকলেও আয়রন বা ফিনিশিং ইউনিটগুলোতে প্রচুর পণ্য জমা হয়েছে আছে। কিছু কিছু ফ্লোরে সেলাই মেশিনের ১০টি লাইন থাকলেও ৪/৫টি লাইন বন্ধ থাকায় কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।

এ কারখানার সিনিয়র ম্যানেজার (প্রোডাকশন) মামুন রহমান বলেন, “গ্যাসের অভাবে কারখানা প্রায় বন্ধের পথে। বিদ্যুতের ঘাটতিতে ডিজেল জেনারেটর দিয়ে চালাচ্ছি। ফলে খরচ বেড়ে গেছে অনেক বেশি।”

বন্ধ লাইনগুলো দেখিয়ে তিনি বলেন, প্রতিটি ফ্লোরে ৩/৪টি করে লাইন বন্ধ করে রাখা হয়েছে। প্রতিদিন ২০ হাজার পোশাক উৎপাদন সক্ষমতার এই কারখানায় আড়াই লাখ পোশাক পড়ে আছে, কারণ ফিনিশিংয়ে গিয়ে কাজ আর এগোচ্ছে না।

“বিদ্যুৎ আসা যাওয়ার মধ্যেও জেনারেটর চালিয়ে যতটুকু পোশাক তৈরি করা যায়, গ্যাসের অভাবে এসব কাপড় আয়রন বা ফিনিশিং করা যায় না। আয়রনের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা সারাদিন মেশিন হাতে অলস দাঁড়িয়ে থাকে। দুপুরের দিকে গ্যাসের চাপ বাড়লে কিছুক্ষণ বয়লার চলে। আবার বিকালে কারখানা ছুটি হওয়ার আগেই গ্যাস চলে যায়। এই পরিস্থিতিতে গত তিন মাস ধরে চলছে।”

এমবি ফ্যাশনের সাপ্লাই লাইনে প্রচুর পরিমাণে তৈরি পোশাক স্তূপ দেখা যায়, যেগুলো আয়রনের জন্য অপেক্ষমাণ। একজন কর্মী জানালেন, সেখানে প্রায় দুই লাখ পোশাক জমে গেছে, অথচ দৈনিক ২০ হাজার পোশাক আয়রন করার সক্ষমতা রয়েছে তাদের।

গ্যাস-বিদ্যুতের আসা যাওয়ায় এসব কারখানায় একদিকে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে জ্বালানি খরচ যাচ্ছে বেড়ে। অবশ্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দৈনিক উৎপাদন প্রতিবেদনে ৫ নভেম্বরের পর থেকে দেশে আর লোডশেডিং হচ্ছে না বলে দেখানো হয়েছে।

ফোর ডিজাইন নামের আরেকটি কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের ডায়িং সেকশন একপ্রকার বন্ধ। কয়েকগুণ বেশি টাকা খরচ করে সিলিন্ডারের গ্যাস দিয়ে বয়লার চালিয়ে মাঝেমধ্যে কাজ হয়। 

“সিলিন্ডারেও ঠিকমত গ্যাস পাই না, বাতাসে ভরা থাকে। হয়ত দেখা গেছে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে আড়াই হাজার টাকার গ্যাস দিচ্ছে। আমরা হিসাব করে দেখলাম যে গ্যাস কিনছি তা দিয়ে বিকাল ৫টা পর্যন্ত আয়রন চালানো যাবে, অথচ দেখা যায় বিকাল ৩টার মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে সিলিন্ডারের গ্যাস,” বলেন আতাউর।

গ্যাস-বিদ্যুতের সমস্যার কারণে কারখানার উৎপাদন ৫০ শতাংশ কমে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “দূরে অন্য কোথাও গ্যাস থাকলে সেখান থেকে ডায়িংয়ের কাজটা করে আনতেছি। এতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

“কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে আমরা তেমন কথা বলি না। কারণ, তাহলে ক্রেতারা বাংলাদেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে যাবে। আমরা ক্রেতাদের বলেছি, গ্যাসের কিছু সমস্যা আছে, এটা সলভ হয়ে যাবে। কিন্তু কবে সমাধান হবে আমি নিজেও জানি না।“

 ফোর ডিজাইনের এমডি জানান, লাইনের গ্যাস দিয়ে যখন তারা বয়লার চালাতেন, তখন খরচ হত মাস এক লাখ টাকা। এখন সিলিন্ডারের পেছনে চার লাখ টাকা খরচ করেও প্রয়োজনীয় গ্যাস পাচ্ছেন না।

“কোভিডের সময় আমরা একটা সংকট পার করেছি। কিন্তু তখনকার আয়-ব্যয় এখনকার চেয়ে ভালো ছিল। এবার একেবারে ধরা খেয়ে গেছি। তখন কাজ বন্ধ ছিল, কিন্তু হাতে অর্ডার ছিল। এখন তো কাজও নেই, দুই মাস পর অর্ডারও থাকবে না।”

পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক নেতা ক্রোনি গ্রুপের কর্ণধার এ এইচ আসলাম সানি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম যতই বেশি হোক, সরকার গ্যাস আমদানি করে সরবরাহ নিশ্চিত করলে সেটা দিন শেষে দেশের রপ্তানি শিল্পের জন্য ও অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হবে।

“কারখানা মালিকরা প্রয়োজনে বেশি দাম দিয়ে হলেও গ্যাস কিনতে রাজি আছে। সরকারের উচিৎ অন্য খাতে কমিয়ে দিয়ে হলেও রপ্তানিমুখী শিল্পে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা। তা না হলে আগামী দিনে রপ্তানি কমে গিয়ে রিজার্ভের ওপর আরও বেশি চাপ পড়বে। কারখানাগুলোতে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হলে বেকারত্ব বাড়বে।”

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের সামগ্রিক রপ্তানির ৮০ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। সর্বশেষ ২০২১-২০২২ অর্থবছরে মোট ৫২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ, যার মধ্যে ৪২ বিলিয়ন ডলার এসেছে পোশাকপণ্য থেকে।