পোশাকের দাম বাড়াতে রাজি বিদেশি ক্রেতা, মজুরি কি বাড়বে?

আন্দোলনকারীরা বলছেন, পোশাকের মূল্য ৭ থেকে ১০ সেন্টে বাড়ালেই শ্রমিকদের ২৫ হাজার টাকা মজুরির দাবি পূরণ করা সম্ভব।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Nov 2023, 07:32 PM
Updated : 10 Nov 2023, 07:32 PM

বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের চলমান বেতন বৃদ্ধির আন্দোলনের কথা বিবেচনায় রেখে পোশাকের ক্রয়মূল্য ৫ থেকে ৬ শতাংশ বাড়াতে রাজি থাকার কথা জানিয়েছে এক হাজার পশ্চিমা ফ্যাশন ব্র্যান্ডের জোট আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন।

ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা করার দাবিতে আন্দোলনে থাকা শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, ক্রেতাদের এমন আশ্বাস তাদের প্রত্যাশা পূরণে সহায়ক হতে পারে।

ক্রেতারা দাম বাড়ালে তা যে বিভিন্ন রকম খরচের চাপে থাকে পোশাক খাতে কিছুটা ‘স্বস্তি’ এনে দেবে, রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ এর সভাপতি ফারুক হাসানও তা মানছেন। তবে তাতে শ্রমিকদের মজুরি বাড়বে কি না, সেই প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে গেছেন।

পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে গঠিত মজুরি বোর্ডের ষষ্ঠ সভায় সর্বনিম্ন মজুরি ৫৬ শতাংশ বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা ধরে মোট ৫টি গ্রেডে মজুরি প্রস্তাব করে বিজিএমইএ। পরে সেই প্রস্তাবই গ্রহণ করা হয়।

তবে তা প্রত্যাখ্যান করে সাভার, গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে ২৩ থেকে ২৫ হাজার টাকা মজুরি দাবি করা শ্রমিক সংগঠনগুলো।

প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে চলা মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে অন্তত চারজন শ্রমিকের মৃত্যুর খবর এসেছে। বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানায় ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ হয়েছে। আন্দোলনের কারণে বন্ধ রাখা হয়েছে অনেক কারখানা।

সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, আসন্ন নির্বাচনের আগেই ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে নতুন মজুরি কাঠামো। আর তাতে পোশাক কারখানাগুলোর খরচ ৫ থেকে ৬ শতাংশ বাড়বে বলে গার্মেন্ট মালিকদের ভাষ্য।

এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক ক্রেতারা বাংলাদেশের পোশাক কেনার সময় ৫ থেকে ৬ শতাংশ বেশি দাম দিতে রাজি কি না, সেই প্রশ্ন করা হয়েছিল আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী স্টেফেন ল্যামারের কাছে।

উত্তরে তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, “অবশ্যই! আমরা এবং আমাদের সদস্য ব্র্যান্ডগুলো আগেও বার বার বলে এসেছে যে, মজুরি বৃদ্ধির কারণে খরচ বাড়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা দিতে আমরা দায়িত্বশীল কেনাকাটার চর্চার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

“পরিবর্তিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে শ্রমিকরা যেন খাপ খাইয়ে নিতে পারে, সেজন্য বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধির একটি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে আমরা আবারও বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাব।”

কম মজুরির সুবিধাকে কাজে লাগিয়েই বাংলাদেশের পোশাক শিল্প গত চার দশকে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করে এখন বিশ্বের তৃতীয় অবস্থানে এসেছে। বাংলাদেশের মোট জিডিপিতে পোশাক শিল্পের অবদান ১৬ শতাংশ।

রয়টার্স বলছে, প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামে পোশাক খাতের গড় মজুরি ২৭৫ ডলার আর কম্বোডিয়ায় ২৫০ ডলার। আর বাংলাদেশে ৬০ শতাংশ বাড়িয়ে ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা করার যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তা ১১৩ ডলারের সমান।

বাংলাদেশে পোশাক উৎপাদনে যে খরচ হয়, তার ১০ থেকে ১৩ শতাংশ যায় শ্রমিক মজুরি বাবদ। বর্তমানে যে হারে মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে, তা আরও ১০ থেকে ১৩ শতাংশ খরচ বাড়াতে পারে।

‘স্বস্তির খবর’

ক্রেতাদের এমন ঘোষণা শিল্প মালিকদের জন্য কাঙ্খিত ছিল জানিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি নিজে ক্রেতাদেরকে পোশাকের মূল্য বাড়াতে পরপর দুই বার চিঠি দিয়েছি। এখন ক্রেতারা এ ধরনের উদ্যোগ নিলে সেটা ডেফিনেটলি এই শিল্পকে স্বস্তি দেবে। কিন্তু একজন দুইজন ক্রেতা দাম বাড়ালে তো হবে না। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

“কারণ হচ্ছে বর্তমানে শুধু বেতনের ইস্যুই একমাত্র ইস্যু নয়। গত এক বছরে গ্যাসের দাম বেড়েছে, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, পরিবহন খরচ বেড়েছে। সব কিছুরই খরচ বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে এখন বেতনের বিষয়টি যুক্ত হয়েছে। গত এক বছর ধরে ক্রয়াদেশও অনেক কমে গেছে।”

বিদেশি পোশাক ব্র্যান্ডগুলো ক্রয়মূল্য বাড়ালে শ্রমিকদের মজুরি আরও বাড়ানোর দাবি পূরণ করা হবে কিনা সেই প্রশ্নও রাখা হয়েছিল পোশাক শিল্প মালিকদের এই নেতার কাছে।

এর সরাসরি উত্তর না দিয়ে ফারুক হাসান বলেন, “তারা (ক্রেতারা) শ্রমিকদের জন্য ন্যায্য মজুরির কথা বলে, এথিক্যাল সোর্সিং, ফেয়ার প্রাইসের কথা বলে। এখন আমরা নিজেরাই আমাদের শ্রমিকদের জন্য মজুরি বাড়িয়েছি। আমি নিশ্চিত যে এখন তাদের পক্ষ থেকেও পোশাকের দাম নিয়ে একটা উদ্যোগ আসবে।

“আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনকে এই উদ্যোগের জন্য চিঠি দিয়ে ধন্যবাদ জানাব। সব ক্রেতা যেন বিষয়টিতে দৃষ্টি দেয় সেই আহ্বান থাকবে।”

ঘোষিত হারে মজুরি বৃদ্ধি ঘটলে পোশাকের উৎপাদন খরচ ৭ থেকে ১০ শতাংশ বাড়বে বলে মনে করেন বিজিএমইএ সভাপতি।

শ্রমিকের দাবি পূরণ ‘সম্ভব’

কয়েকটি শ্রমিক সংগঠনের জোট ‘মজুরি বৃদ্ধিতে গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন’ এর সমন্বয়ক ও গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যদি ক্রেতারা পোশাকের মূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তাহলে আমরা মনে করি, মজুরির দাবি আদায়ে একটা নতুন পথ তৈরি হবে। এখন যে মজুরি প্রস্তাব করা হয়েছে সেটা থেকে বাড়িয়ে বিবেচনার পথটা আরও প্রশস্থ হবে।

“মালিকরা তাদের সামর্থ্যের সংকটের কথা বলেন, সেই জায়গায় মালিক, সরকার ও বায়ার যদি সম্মিলিতভাবে দায়িত্ব নেয়, তাহলে শ্রমিকরা এখন যে মজুরি পুনর্বিবেচনার দাবি করছে, সেই সুযোগটা তৈরি হয়। আমরা মনে করি খুব দ্রুতই সেই কাজে যাওয়া উচিত।”

তিনি বলেন, “মালিকদের পক্ষ থেকে ক্রেতাদের সঙ্গে দর কষাকষি করে কত বেশি সিএম (কস্ট মেকিং প্রাইস) নেওয়া যায় এবং সেটা শ্রমিকদের মাঝে বিতরণ করা যায়, সেই চেষ্টাটা থাকা উচিত। অন্য দেশের পণ্য বেশি দামে বিক্রি হবে, আমাদের দেশের পণ্য কম দামে বিক্রি হবে আর শ্রমিকরা কম মজুরি পাবে– এমনটি হওয়া উচিত নয়।”

এই শ্রমিক অধিকার কর্মী বলেন, মজুরি বৃদ্ধির দাবির সঙ্গে ক্রেতাদের কাছে তাদের দাবি ছিল, যেন পোশাকের মূল্য কিছুটা বাড়িয়ে ধরা হয়।

“আমরা হিসাব করে দেখেছি, পোশাকের মূল্য ৭ থেকে ১০ সেন্টে বাড়ালেই শ্রমিকদের ২৫ হাজার টাকা মজুরির দাবি পূরণ করা সম্ভব হয়।”

বাড়তি দাম যাবে কার পকেটে?

বিদেশি ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর ক্রয়মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা চলমান মজুরি আন্দোলনে মালিক-শ্রমিকের জন্য ‘একটি স্বস্তির খবর’ বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ও ন্যূনতম মজুরি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশাও।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখন দেখার বিষয় হচ্ছে ব্র্যান্ডের বাড়তি দাম কি সরাসরি শ্রমিকদের জন্য যাবে? নাকি সেটা মালিকপক্ষের মুনাফার খাতায় যুক্ত হবে?”

বিদিশা বলেন, “এই ঘোষণাটা আসার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, শ্রমিকদের যেন উপকার হয়। বায়ারদের ঘোষণা থাকা উচিত যে, আমরা পোশাকের মূল্য বাড়াব এবং এর সুফল যেন শ্রমিকরা পায়। শ্রমিকরা তাদের স্বার্থ দেখবে, মালিকরা তাদের স্বার্থ দেখবে। কিন্তু এই দুইয়ের মাঝখানে আছে ক্রেতা ও সরকার। এই দুই পক্ষের কাজ হচ্ছে শ্রমিকদের স্বার্থটাকে বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও প্রণোদনামূলক পদক্ষেপগুলো নেওয়া।”

সাড়ে ১২ হাজার টাকার যে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা ‘বাস্তবসম্মত নয়’ বলেই মনে করছেন এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।

তিনি বলেন, “সব সময় আমরা যেটা চাইব, সেটা হচ্ছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান প্রস্তাবের চেয়ে আরও কিছু বৃদ্ধি হওয়া দরকার। সেটা হয়ত এখনও বাড়ানোর সুযোগ আছে। যে প্রক্রিয়ায় দর কষাকষি হয়, সেখানে শ্রমিকদের ভয়েস কীভাবে আরও শক্ত করা যায়, সেই ব্যবস্থা করা। গবেষণার ভিত্তিতে মজুরি ঠিক করা, বাইরের পর্যবেক্ষকদের মতামত নেওয়া। এই কাজগুলো কিন্তু করা যেতে পারে। শ্রমিকদের চাওয়া হয়ত পুরোপুরি পূরণ হবে না, কিন্তু তাদের চাওয়ার কাছাকাছি যেন আমরা যেতে পারি।”

মজুরি বোর্ডে দর কষাকষি আর আন্দোলনকারীদের দাবির পার্থক্য নিয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, শ্রমিকরা বেশি চাইবে, মালিকরা কম দিতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক।

“কিন্তু মালিকদেরকে চাপ দেওয়াটা ‍গুরুত্বপূর্ণ। সিপিডি যেটা গবেষণা করেছে, তারা কিন্তু মালিক-শ্রমিকদের দাবির মাঝামাঝি জায়গায়।  এখন অনেকে ১৭ হাজার টাকা মজুরি নিয়েও সমালোচনা করছে। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, কেউ যদি ১৭ হাজার টাকাও পায়, সেটা তো ১২ হাজার টাকার চেয়ে ভালো। শ্রমিকদের চাওয়ার কাছাকাছি যাওয়া হল।”

পুরনো খবর

Also Read: কঠোর হচ্ছেন পোশাক কারখানা মালিকরা, নিয়োগ বন্ধ

Also Read: যে বেতন বাড়ানো হয়েছে, তা নিয়েই কাজ করতে হবে: প্রধানমন্ত্রী

Also Read: ‘রাজনৈতিক প্রলেপ দিয়ে শ্রমিক আন্দোলন থামানো যাবে না’

Also Read: নতুন কাঠামোয় বেতন আসবে ‘১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা’: বাণিজ্যমন্ত্রী

Also Read: ৫৬.২৫% বাড়িয়ে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১২,৫০০ টাকা নির্ধারণ