বেতন বাড়ানোর দাবিতে গাজীপুর, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক বিক্ষোভের মধ্যেই এ ঘোষণা এল।
Published : 07 Nov 2023, 03:04 PM
মূল মজুরি ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে পোশাক শ্রমিকদের জন্য সাড়ে ১২ হাজার টাকা সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করেছে সরকার, যা আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে।
শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান মঙ্গলবার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে পোশাক শ্রমিকদের নতুন মজুরি ঘোষণা করেন। তার আগে শ্রম ভবনে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণে গঠিত বোর্ডের ষষ্ঠ সভায় এই মজুরি চূড়ান্ত করা হয়।
মালিকপক্ষ এদিন তাদের আগের প্রস্তাব ১০ হাজার ৪০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা করার প্রস্তাব দেয়। মজুরি বোর্ডের বৈঠকে সেই প্রস্তাবই গৃহীত হয়। পরে শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি বলেন, এই মজুরি তারা মেনে নিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে আসার আগে শ্রম প্রতিমন্ত্রী সচিবালয়ে তার দপ্তরে মালিক ও শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধিদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন।
সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মালিক ও শ্রমিক পক্ষ এবং নিরপক্ষে প্রতিনিধিদের নিয়ে দ্রুত নতুন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। যে মজুরি আছে তার ওপর মূল মজুরি ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। আট হাজার থেকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা করা হয়েছে। ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টও বহাল আছে।”
সবশেষ ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে পাঁচ বছরের জন্য পোশাক শ্রমিকদের নতুন মজুরি ঘোষণা করে সরকার। সে অনুযায়ী আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে নতুন মজুরি ঘোষণা করার দাবি ছিল শ্রমিকদের।
পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ঠিক করতে গত এপ্রিলে নিম্নতম মজুর বোর্ড গঠন করে সরকার। গত ২২ অক্টোবর এই বোর্ডের চতুর্থ সভায় শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাব করেন। আর মালিকপক্ষ ১০ হাজার ৪০০ টাকা মজুরির প্রস্তাব দেয়।
ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে– এমন কথা ছড়িয়ে পড়লে ২৩ অক্টোবর থেকে গাজীপুরে আন্দোলন শুরু করেন পোশাক শ্রমিকরা। পরে তা আশুলিয়া, সাভার ও ঢাকার মিরপুরে ছড়িয়ে পড়ে।
অনেক জায়গায় শ্রমিকরা ভাংচুর শুরু করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। সংঘাতে এবং এক কারখানায় আগুন দেওয়ার ঘটনায় প্রাণ যায় অন্তত দুইজনের। পরিস্থিতি সামাল দিতে পর্যায়ক্রমে পাঁচ শতাধিক কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বেতন বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনরত পোশাক শ্রমিকরা মঙ্গলবারও গাজীপুরে দুই বাসে আগুন দিয়ে বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করেন।
মজুরি বাড়ানোর দাবিতে শ্রমজীবীদের ওই আন্দোলনের কথা তুলে ধরে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, “মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে মালিক ও শ্রমিক পক্ষকে নিয়ে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। মজুরির যদি কোনো তারতম্য হয়ে যায়, আমরা শেষ সম্বল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বারস্থ হই সবসময়। উনার মৌখিক নির্দেশে আজকে পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি ঘোষণা করছি।
“এখানে শ্রমজীবী মানুষ ও রাষ্ট্রের স্বার্থ আছে। শিল্প বাঁচলে শ্রমিক বাঁচবে। শ্রমিকের সাথে শিল্পও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উভয় দিক লক্ষ্য রেখেই মজুরি ঘোষণা করা হচ্ছে।”
শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, “শ্রমিকদের রেশনের দাবি আছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, একটি পরিবারের জন্য একটি ফ্যামিলি কার্ডের মধ্যেই নির্ধারিত থাকবে কতগুলো সদস্য কার্ডটি ব্যবহার করতে পারবে। পরবর্তীতে এই কার্ডের মাধ্যমে রেশনিং ব্যবস্থা চালুর কথা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন।
“শ্রমিক নেতা ও মালিকরা যারা আছেন, আমি প্রত্যেকের কাছে আহ্বান জানাব, আপনারা ফ্যাক্টরি খুলে দেবেন, শ্রমিক ভাইদের বলব কাজে যোগদান করতে। উভয় পক্ষের কাছে আমি আবেদন করব মালিকদের সহনশীল ভূমিকা রাখার জন্য, তার কারণ এই আন্দোলনে ভুল করুক, ক্রটি করুক, যেটিই করুক, পেটের দায়েই তো মানুষ অনেক কিছু করে। তাদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে কর্মে যেন তারা সঠিকভাবে যোগ দিতে পারে।”
এক সময় শ্রমিক আন্দোলন করে আসা মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, “শ্রমিক ভাই-বোনদের বলব, শিল্পই আপনার জীবন, এই শিল্প বন্ধ হয়ে গেলে আগে ক্ষতিগ্রস্ত আপনি হবেন, মালিক কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হবে পরে। সুতরাং সেদিকে লক্ষ্য রেখে শান্তিপূর্ণভাবে যার যার কাজে গিয়ে ফ্যাক্টরিকে কর্মচঞ্চল করে তুলবেন। অর্থনীতির চাকা হল আপনাদের কাছে। সেই চাকা যেন বন্ধ না হয়।”
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশের জিডিপিতে এ খাতের অবদান ১০ শতাংশের বেশি। ৩২ লাখের বেশি শ্রমিক এ খাতে কাজ করেন, যাদের ৫৮ শতাংশ নারী।
দেশের উন্নতিতে পোশাক শ্রমিকদের এই অবদানের কথা তুলে ধরে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, “কোনো প্রকার উসকানিমূলক কোনো কথায় না গিয়ে আপনারা বিপথে না হাঁটেন, এটা আমাদের আবেদন।”
শিল্প অঞ্চলে যেসব শ্রমিক বসবাস করেন, তাদের বাড়িভাড়া মওকুফ করতে মালিকদের প্রতি আহ্বান জানান প্রতিমন্ত্রী।
‘খুশিও না, বেজারও না’
নিম্নতম মজুরি সাড়ে চার হাজার টাকা বাড়িয়ে পোশাক শ্রমিকদের নতুন মজুরিকে ‘গ্রহণযোগ্য’ বলে মানছে শ্রমিক পক্ষ।
সংবাদ সম্মেলনে মজুরি বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, “আমি চল্লিশ বছর ধরে এই শিল্প খাতে কাজ করছি। আমাদের বাস্তব অবস্থাকে বিবেচনায় নিতে হবে। শ্রমিকরা যাতে কর্মচ্যুত না হয়, তাদের যেন বাড়ি ফিরে যেতে না হয়, তাদের অবস্থা আমাদের দেখতে হবে।
“প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশনা দিয়েছেন, সে অনুসারে আমরা মনে করি এটা বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বেঁচে থাকার জন্য মোটামুটি একটা অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াবে। এটা গ্রহণযোগ্য।”
রনি বলেন, “রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন পরিস্থিতি মিলিয়ে আমরা এটা (নতুন বেতন) মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমরা খুশিও না, বেজারও না। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকলেও আমরা আপাতত এটা মেনে নিয়েছি।”
মজুরি বোর্ডে মালিক পক্ষের প্রতিনিধি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, “মালিকপক্ষ সব সময় সহনশীল। মালিকপক্ষের সামনে দিয়ে যখন শ্রমিকরা ভাঙচুর করে, আমরা কিন্তু কখনও আমাদের শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাই না। আমরা যথেষ্ট সহনশীল।”
আগামী ডিসেম্বর মাস থেকে নতুন বেতন কার্যকর হবে জানিয়ে সিদ্দিকুর বলেন, আগামী ১৪ দিনের মধ্যে গেজেট হবে।
মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী মোল্লা, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান, বিকেএমইএর সভাপতি সেলিম ওসমান সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।