চাল একই, ক্রেতা ধরতে বিক্রি আলাদা নামে

রশিদ এগ্রো জানায়, কুমিল্লা অঞ্চলে যা বিআর ২৮ নামে চলে, গাজীপুর অঞ্চলে সেটা জিরা শাইল নামে চলে। ‘ক্রেতা চাহিদার কারণে’ একই চাল ভিন্ন ভিন্ন নামে বিক্রি হয়।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Sept 2022, 03:53 PM
Updated : 27 Sept 2022, 03:53 PM

বাজারে ক্রেতার রুচি ও ক্রয় ক্ষমতাকে পুঁজি করে একই ধান থেকে উৎপন্ন চাল বাজারে ভিন্ন ভিন্ন নামে বিক্রির কথা উঠে এসেছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের এক মামলার শুনানিতে।

মঙ্গলবার কমিশন কার্যালয়ে চাল-আটাসহ বিভিন্ন পণ্য বাজারজাতকারী কয়েকটি কোম্পানির প্রতিনিধিরা মামলার শুনানিতে হাজির হলে তাদের আলোচনায় এ কথা উঠে আসে।

চাল বিপণন কোম্পানি রশিদ এগ্রো, নওগাঁর বেলকন গ্রুপ (রজনীগন্ধা ব্র্যান্ড), সিটি গ্রুপ (তীর ব্র্যান্ড) ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের (রূপচাঁদা ও ভেওলা) বিরুদ্ধে অভিযোগের শুনানির দিন ধার্য ছিল এদিন।

সব কোম্পানিই তাদের কাছে চাওয়া প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ না করে আইনজীবীর মাধ্যমে সময় বৃদ্ধির আবেদন করে। কমিশন পরে ১৩ অক্টোবর শুনানির পরবর্তী দিন ধার্য করে দেয়।

অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরিসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে চাল, আটা-ময়দা, ডিম-মুরগি, সাবান ও ডিটারজেন্ট পাউডার বাজারজাতকারী ও পাইকারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন কোম্পানির বিরুদ্ধে সম্প্রতি ৪৪টি মামলা করে প্রতিযোগিতা কমিশন। সেসব মামলার ওপর সোমবার থেকে ধারাবাহিক শুনানি শুরু হয়েছে।

মঙ্গলবার প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মফিজুল ইসলাম এবং সদস্য জিএম সালেহ উদ্দিন,  এএফএম মনজুর কাদির ও নাসরিন বেগম কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে শুনানি গ্রহণ করেন।

বাংলাদেশ এডিবল অয়েল

শুনানিতে বাংলাদেশ এডিবল অয়েল কোম্পানির প্রতিনিধি বলেন, বিআর ২৮, বিআর ২৯ ও কাটারি ধানকে চকচকে করে তারা মিনিকেট ব্র্যান্ড নামে বাজারজাত করেন। ক্রেতারা মিনেকেট চাল বেশি পছন্দ করার কারণেই তারা মিনেকেট নামে বিক্রি করেন।

রূপচাঁদা ও ভেওলা ব্র্যান্ড নাম দিয়ে তারা মিনেকেট চাল বিক্রি করেন। সাধারণ ক্রেতাদের কথা বিবেচনায় রেখে ভেওলা এবং উচ্চশ্রেণির ক্রেতাদের জন্য রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত চাল বাজারজাত করা হয়। এক্ষেত্রে দামেও কিছুটা পার্থক্য থাকে বলে তিনি জানান।

কমিশনের সদস্য জি এম সালেহ উদ্দিন তখন বলেন, “আপনারা কোন জাতকে কোন নামে কোন ব্র্যান্ডে বিক্রি করছেন তা তো নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না। দেখা যাবে, একই ভ্যারাইটির ধান থেকে উৎপাদিত চাল ভিন্ন ভিন্ন ব্র্যান্ড নাম দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দামে বিক্রি করছেন।”

এছাড়া বিদেশ থেকে আমদানি করা বাসমতি চাল ও দেশীয় চিনিগুড়া চাল বাজারজাত করার কথা কমিশনকে জানান এডিবল অয়েল কোম্পানির প্রতিনিধি।

নিজস্ব কোনো মিল না থাকলেও বিভিন্ন মিলের সঙ্গে চুক্তি করে উৎপাদিত চাল নিজস্ব ব্র্যান্ডের নামে বিক্রি করে এডিবল অয়েল কোম্পানি। তেলের কোম্পানি হলেও নিজেদের চাল বিক্রিরও লাইসেন্স আছে বলে তিনি কমিশনের কাছে দাবি করেন।

কমিশনের পক্ষ থেকে দেওয়া নোটিসে গত তিন মাসের উৎপাদন খরচ ও একক বিক্রয়মূল্যসহ বিভিন্ন তথ্য চাওয়া হলেও তা সরবরাহের জন্য সময় চায় এডিবল অয়েল। পরে আগামী ১৩ অক্টোবর পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করে এর মধ্যে তথ্য দিতে বলে কমিশন।

রশিদ এগ্রো

শুনানিতে রশিদ এগ্রো ফুডের ন্যাশনাল সেলস ম্যানেজার শেখ সহিদুজ্জামান বলেন, মূল্যবৃদ্ধি ও বাজারে সঙ্কট সৃষ্টির যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেটা ‘সত্য’। তবে পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি, লোডশেডিংয়ের কারণে বার বার ডিজেলচালিত জেনারেটর ব্যবহার ও ধানের দাম বৃদ্ধির কারণে তাদের মিলে চালের দাম বেড়েছে।

চালের বাজারে নিজেদের ৫ শতাংশ অংশীদারিত্ব রয়েছে স্বীকার করে অন্যান্য কোম্পানি যেমন জহুরা, এরফান ও মোজাম্মেল ব্র্যান্ডের মার্কেট শেয়ার রশিদের চেয়ে বেশি বলে দাবি করেন সহিদুজ্জামান।

তিনি জানান, বিআর ২৮ চাল কুমিল্লা অঞ্চলে বিআর ২৮ নামে চলে, আবার গাজীপুর অঞ্চলে সেটা জিরা শাইল নামে চলে। একই ধান থেকে উৎপাদিত চাল ক্রেতা চাহিদার কারণে ভিন্ন ভিন্ন নামে বিক্রি করলেও দামে পার্থক্য নেই বলে তার ভাষ্য।  

শুনানিতে প্রয়োজনীয় তথ্য উত্থাপন করতে না পারায় রশিদ এগ্রোকেও আগামী ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়।

বেলকন গ্রুপ

রজনীগন্ধা ব্র্যান্ড নামে মিনিকেট, কাটারি, মোটা ও সুগন্ধি চাল বাজারজাত করে নওগাঁর বেলকন গ্রুপ।

শুনানিতে বেলকন গ্রুপের মালিক বেলাল হোসেনকে ডাকা হলেও তিনি আসেননি। বেলালের প্রতিনিধি হিসাবে কোম্পানির এক্সিকিউটিভ অফিসার জাফরুল আলম শুনানিতে হাজির হন।

তবে এদিন তারা কমিশনের চাওয়া অনুযায়ী গত তিন মাসের উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রির হিসাব জমা দিতে ব্যর্থ হন। সেজন্য আইনজীবীর মাধ্যমে ৯০ দিন সময় চাইলে কমিশন আগামী ১৩ অক্টোবর প্রয়োজনীয় তথ্যসহ শুনানিতে ‍উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেয়।

বেলকন গ্রুপের বিরুদ্ধেও সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয়েছে প্রতিযোগিতা কমিশনের মামলায়।

বেলকন গ্রুপসহ সব চাল কোম্পানির কাছে তাদের বিপণন করা চালের এক কেজি করে একটি নমুনা কমিশনে জমা দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি বেলকন গ্রুপকে গত তিন বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাবও দিতে বলা হয়।

সিটি গ্রুপ

তীর ব্র্যান্ডের মিনিকেট, নাজির শাইল ও কাটারিভোগ চাল ২৫ কেজি, ৫০ কেজি ও ৫ কেজির প্যাকেটে বিক্রি করে সিটি গ্রুপ।

তবে কমিশনের পক্ষে থেকে চাওয়া তথ্য সিটি গ্রুপ উপস্থাপন করতে না পারায় এদিন বিস্তারিত শুনানি হয়নি।

কোম্পানির পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা এদিন কমিশনে উপস্থিত হয়ে সময়ের আবেদন করলে আগামী ১৩ অক্টোবর শুনানির পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়।

এ কোম্পানির আটা-ময়দায় সঙ্কট নিয়ে পৃথক একটি মামলার বিষয়েও প্রয়োজনীয় তথ্য জমা না দিয়ে সময় বাড়ানোর আবেদন করা হয়। কমিশন ওই মামলার জন্যও ১৩ অক্টোবর পরবর্তী শুনানির দিন রেখেছে।

এদিন ইউনিলিভারের বিরুদ্ধে আনা একটি মামলার শুনানি হওয়ার কথা থাকলেও প্রয়োজনীয় তথ্য প্রস্তুতের জন্য সময়ের আবেদন করেন কোম্পানির আইনজীবী মোস্তফিজুর রহমান খান। কমিশন আগামী ১৬ অক্টোবর এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করে।