“আমার মনে হয়, কূটনৈতিক উদ্যোগ দরকার সরকারের পক্ষ থেকে,’’ বলেন এক রপ্তানিকারক।
Published : 10 Apr 2025, 01:45 AM
জরুরি প্রয়োজনে মধ্যপ্রাচ্যসহ পশ্চিমের ক্রেতাদের কাছে দ্রুত রপ্তানি পণ্য পাঠাতে ভারতের বিমান ও স্থলবন্দরের বিকল্প ব্যবহারের পথ বন্ধ হল। প্রতিবেশী দেশটির হঠাৎ এ সিদ্ধান্তের প্রভাব খতিয়ে দেখা শুরু হয়েছে; অন্য উপায় কী হতে পারে তা নিয়েও ভাবছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা।
ভারতের এমন পদক্ষেপের কারণ কী হতে পারে তা নিয়েও সরকারি, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন মহলে শুরু হয়েছে জল্পনা কল্পনা।
বুধবার বিকালে সিদ্ধান্তটি জানার পর তাৎক্ষণিকভাবে রপ্তানিকারকরা বলেছেন, এতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে তেমন প্রভাব না পড়লেও ক্রেতা দেশের কাছে পণ্য সরবরাহের বিকল্প এক পথ কমে যাবে। রপ্তানি সক্ষমতা কিছুটা হলেও সংকুচিত হবে।
তবে প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্ককে বহুমাত্রিক করার যে প্রচেষ্টা গত কয়েক দশক ধরে চলছিল এ ধরনের বাণিজ্য বাধা সেই উদ্যোগে ছেদ ফেলবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও কূটনীতিকরা।
এমন প্রেক্ষাপটে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন অন্তর্বর্তী সরকারের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রপ্তানি অনুবিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, বাণিজ্য উপদেষ্টা বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে মোবাইলে ফোন করে ও ইমেইল পাঠিয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টার সাড়া পাওয়া যায়নি।
ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডিরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি) এক সার্কুলারে দেশটির ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় কোনো দেশে রপ্তানি পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করার কথা জানায়।
পরে বুধবার সন্ধ্যায় দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নতুন করে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছে, বাংলাদেশের পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করার যে সিদ্ধান্ত ভারত নিয়েছে, তা নেপাল বা ভুটানগামী পণ্য চালানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
অর্থাৎ, ভারতের কোনো বন্দর বা বিমানবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের পণ্য তৃতীয় দেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা আর দেবে না ভারত।
প্রথমে ভারতের সংবাদপত্রের বরাতে আসা খবরে হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের সংবাদমাধ্যমে তুমুল আলোচনার মধ্যে বুধবার সন্ধ্যায় বিষয়টি স্পষ্ট করে বিবৃতি দেয় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সেখানে বলা হয়, “বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরগুলোতে উল্লেখযোগ্য পণ্যজট সৃষ্টি হচ্ছিল। এই কারণে আমাদের নিজস্ব রপ্তানিতে বিলম্ব, খরচ বৃদ্ধি এবং ব্যাকলগ তৈরি হচ্ছিল। ফলে, এই সুবিধা ৮ এপ্রিল ২০২৫ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
“স্পষ্ট করে বলা যায়, এই সিদ্ধান্ত ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে নেপাল বা ভুটানে পণ্য পরিবহনের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না।”
কী আছে সার্কুলারে
সিবিআইসি মঙ্গলবার এক সার্কুলারে বাংলাদেশের পণ্যে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত জানায়। এতে ২০২০ সালের ২৯ জুনের একটি সার্কুলার ‘অবিলম্বে’ বাতিল করার কথা বলা হয়।
বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পণ্য কনটেইনার বা কভার্ড ভ্যানের মাধ্যমে তৃতীয় দেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে ভারতের স্থল শুল্ক স্টেশন থেকে দেশটির অন্য কোনো বন্দর বা বিমানবন্দর পর্যন্ত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল পুরনো ওই সার্কুলারে।
নতুন নির্দেশনায় বলা হয়, বর্তমানে ট্রানজিটে থাকা বাংলাদেশি পণ্য বিদ্যমান প্রক্রিয়ার আওতায় ভারত ছাড়তে পারবে, তবে নতুনভাবে কোনো পণ্যের চালান ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা পাবে না।
ভারতের এই সিদ্ধান্তের ফলে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ অন্যান্য বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক অন্য দেশে রপ্তানির বিষয়টিও বাধাগ্রস্ত হবে।
ভারতের অ্যাপারেল এক্সপোর্টার্স কাউন্সিল এই সুবিধা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিল, কারণ বাংলাদেশ ও ভারত তৈরি পোশাক খাতে প্রতিযোগিতা করছে।
কী প্রভাব পড়বে রপ্তানিতে
দুটি কারণে মূলত ভারতের বিমানবন্দর ও স্থলবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা তৈরি পোশাক বা অন্য পণ্য তৃতীয় দেশে পাঠিয়ে থাকেন। এর মধ্যে প্রথমটি হচেছ, কলকাতা থেকে পাঠানোর খরচ কম এবং সেখান থেকে পশ্চিমা দেশের প্রায় সবগুলো রুটে সরাসরি পণ্য পরিবহন সম্বব।
দ্বিতীয়টি হচেছ, হরতাল, বন্যা বা দুর্যোগের মত সময়ে দ্রুত ও সময়মত ক্রেতা দেশের কাছে পণ্য পৌঁছাতে পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা ভারতের বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরকে ব্যবহার করেন।
ভারত এ সুবিধা বাতিল করলেও পোশাক খাতের খুব একটা সমস্যা হবে না মনে করছেন পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা।
তারা বিকল্প হিসেবে শ্রীলঙ্কার কলম্বো, মালদ্বীপ, পাকিস্তান বা দুবাইয়ের বিমানবন্দর ব্যবহারের কথা বলেন। তবে এতে খরচ খুব একটা না বাড়লেও বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের পথগুলো সংকুচিত হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুযায়ী, সদস্য দেশগুলোকে পণ্য পরিবহনের জন্য অবাধ ও নিরবচ্ছিন্ন ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত করতে হয়।
‘‘এটা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাংলাদেশ চাইলে অবশ্যই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ফোরাম ও ডব্লিউটিওতে তুলতে পারবে। এটা কূটনৈতিকভাবেও যোগাযোগ করতে হবে।’’
সবশেষ ২০২০ সালে করোনা মহামারীর সময় ঢাকার বিমানবন্দরে কার্গো চাপ বেড়ে গেলে কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা অধিক পরিমাণের পণ্য ক্রেতার কাছে পাঠিয়েছিলেন।
সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বিজিএমইএ এর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘কলকাতা বিমানবন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং ক্যাপাসিটি বেশি। সেখান থেকে পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় সবগুলো রুটে সরাসরি উড়োজাহাজ যায়। আমাদেরও পণ্য পাঠানো সহজ হয়। শুধু জরুরি সময়ে বিকল্প হিসেবে ভারতের বন্দরগুলো বাংলাদেশিরা ব্যবহার করেন।’’
ভারতের এ সুবিধা বাতিলে বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারে পণ্য পাঠানোর বিকল্প একটা পথ কমে যাবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এতে সক্ষমতাতো কিছুটা হলেও কমল।
পণ্য তৈরিতে কোনো কারণে দেরি হলে ক্রেতারা উড়োজাহাজে পাঠানোর অনুরোধ করেন। তখন ক্রেতার স্বার্থে উদ্যোক্তাদের সেই অনুরোধ রাখতে হয়।
এ খাতের আরেক উদ্যোক্তা বলেন, ঢাকার চেয়ে কম খরচে কার্গো ভাড়া নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায় ভারতে। কলকাতা বিমানবন্দর দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে প্রতিকেজি পণ্য পাঠানোর খরচ দুই থেকে আড়াই ডলার। সেখানে বাংলাদেশে তা ৫-৬ ডলার বলে তুলে ধরেন বিকেএমইএ সভাপতি মোহামম্মদ হাতেম।]
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘ভারতের কার্গো ভাড়া কেমন হবে তা ঠিক করে দেশটির সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। এ কারণে কোনো পরিবহন উড়োজাহাজ চাইলেই ভাড়া বাড়াতে পারে না।
“বাংলাদেশে ভাড়া ঠিক করে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সগুলো। একটু চাপ বেশি হলেই ভাড়া বাড়িয়ে দেয় তারা। এখানে সরকার চাইলে ভাড়া ঠিক করে দিতে পারে।’’
ভারতের বিকল্প কোন পথ হতে পারে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘এখন আমাদের রপ্তানি করার উপায়গুলো কিন্তু একটু হলেও কমল। তবে পোশাক রপ্তানিতে কোনো প্রভাব পড়বে না। এখন জাহাজে করে কলম্বো, মালদ্বীপ, দুবাই বা পাকিস্তানে পাঠাতে হবে। সেখান থেকে উড়োজাহাজে করে পণ্য যাবে। ভারত থেকে পাঠালে যে সময় বাঁচত, এখন তা হবে না।’’
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও তৈরি পোশাক খাতের শাশা গার্মেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘একটা বিকল্প আমাদের হাতে ছিল। সেটি বন্ধ হল, আর্থিক দিয়ে দেখার চেয়ে অন্য দিকটি দেখতে হবে।
”তৈরি পোশাকে তারা আমাদের কম্পিটিটিভ হতে চেষ্টা করছে। এর প্রভাব কতটা হতে পারে, বায়াররা কীভাবে নেয়-তা বুঝতে একটু সময় লাগতে পারে।’’
কলকাতা বা দিল্লি বিমানবন্দর সব সময় ব্যবহার করা হয় এমন নয়, মন্তব্য করে তিনি বলেন, প্রয়োজনে হয়। অপশনটা থাকলে ভালো হয়।
“আমার মনে হয়, কূটনৈতিক উদ্যোগ দরকার সরকারের পক্ষ থেকে।’’
বহুমাত্রিক সম্পর্কের পথে বাধা
প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্ককে বহুমাত্রিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ করার চেষ্টা চলছে গত কয়েক দশক ধরেই। দুই দেশেই সরকারের পালাবদলে তা মাঝেমধ্যে এদিক-ওদিক হলেও সবপক্ষ সম্পর্কে উন্নয়নে জোর দিয়ে আসছে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও চলছে টানাপড়েন। এরমধ্যে এ ধরনের বাণিজ্য বাধা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির উদ্যোগকে বিঘি্নত করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও কূটনীতিকরা।
ভারতের সিদ্ধান্তটা ঠিক হয়নি মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আমেনা মহসিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এ সুবিধা থাকলে বরং ভারতেরই লাভ ছিল।
“কারণ পার্টিকুলারলি দেখেন, বিমসটেক সম্মেলনের পরে যখন আমরা কানেক্টিভিটির কথা বলছি, একটা রিজিওনাল সম্পর্কের কথা বলছি তখন এই জিনিসটা হল। এবং কানেক্টিভিটির উপরে তো ভারতেরই সবচেয়ে বেশি, মানে এটার দ্বারা ভারতই লাভবান হত।”
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের অতিরিক্ত নতুন শুল্কারোপের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়িয়ে ভারতের বাণিজ্য বাড়ানোর পথে হাঁটাই উচিত ছিল।
“অথচ ঠিক এই মুহূর্তে যখন পুরো বিশ্ব আমেরিকার ট্যারিফের চাপের মুখে আছে এবং সেখানে ধরেন আঞ্চলিক যে দেশগুলো আছে তাদের উচিত ছিল যে তারা… আমরা আশা করছিলাম যে তারা নিজেদের মধ্যে কীভাবে যোগাযোগ বাড়িয়ে বাণিজ্য বৃদ্ধি করবে। সেটা না করে এই যে জিনিসটা করল ভারত। সেটার কিন্তু একটা ইমপ্যাক্ট ভারতেও…(পড়বে)।”
এতে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্কের দীর্ঘমেয়াদের ‘নেতিবাচক’ প্রভাব পড়বে বলে তার ভাষ্য।
সেভেন সিস্টার্স বিতর্ক
আকস্মিকভাবে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের কোনো কারণ ভারতের প্রজ্ঞাপনে না থাকায় বিষয়টি নিয়ে নানা ধরনের জল্পনা কল্পনা শুরু হয়ে যায়।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার এক বক্তব্য ঘিরে দুই দেশের সাম্প্রতিক উত্তেজনার সঙ্গে ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা দেখা যায় ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে।
২৮ মার্চ বাংলাদেশের বিনিয়োগের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরতে গিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বেইজিংয়ে চীনা ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, “ভারতের সাত রাজ্য, ভারতের পূর্বাঞ্চলে, যেগুলোকে সেভেন সিস্টার্স বলা হয়ে থাকে… ভারতের ভূবেষ্টিত অঞ্চল। সমুদ্রে যাওয়ার কোনো উপায় তাদের নেই। এই অঞ্চলের জন্য সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক আমরা।
“ফলে, এটা বিপুল সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। এটা চীনের অর্থনৈতিক বর্ধিতাংশ হতে পারে। বিভিন্ন জিনিস নির্মাণ, উৎপাদন করুন, বাজারজাত করুন; জিনিসপত্র চীন নিয়ে আসুন কিংবা সারাবিশ্বে পাঠিয়ে দিন।”
তার ওই বক্তব্য ঘিরে রীতিমত হৈ চৈ শুরু হয় ভারতে। বাংলাদেশ-চীনের আলোচনায় ‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যগুলোকে টেনে আনায় ইউনূসের সমালোচনামুখর হন ভারতের রাজনীতিক, সাবেক কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবরে বলা হয়, ইউনূসের ওই বক্তব্যকে ‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে
‘কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের সুবিধাজনক অবস্থান’ তুলে ধরার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়েছে। নয়াদিল্লির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কের অবস্থা যখন নাজুক, তখন চীনকে ‘নতুন কৌশলগত অংশীদার; হিসেবে চিত্রিত করাও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে আরো জটিল করে তুলেছে।
গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (জিটিআরআই) সহ-প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ভারত গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশকে ‘একতরফাভাবে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার’ দিয়ে সহায়তা করে এসেছে। তবে বাংলাদেশের লালমনিরহাটে একটি বিমানঘাঁটি চীনের সহায়তায় সচল করার উদ্যোগ ভারতের শিলিগুঁড়ি করিডোরের কাছাকাছি হওয়ায় ভারত এ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে।
লালমনিরহাটের বিমানঘাঁটিটি ভারতের শিলিগুঁড়ি করিডোর বা ‘চিকেনস নেক’-এর খুব কাছে, যা ভারতের পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর মধ্যে সংযোগের একমাত্র পথ। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ এই অঞ্চলে ‘কৌশলগত সহযোগিতা’ বৃদ্ধির চেষ্টা করছে এমন প্রতিবেদনে নয়াদিল্লির উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
পরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিয়ে সাংবাদিকরা জানতে চান, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যের কারণেই ভারত এমন সিদ্ধান্ত নিল কি না।
এক সাংবাদিক বলেন, থাইল্যান্ডে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে নরেন্দ্র মোদী ও মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের পর সম্পর্ক ‘ইতিবাচক’ দিকে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হলেও এখন মনে হচ্ছে ‘উল্টোদিকে’ যাচ্ছে।
জবাবে রাণধীর জয়সওয়াল বলেন, “ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহারের কারণ আসলে কী, তা ইতোমধ্যে বলা হয়েছে। এটা প্রত্যাহার করা হয়েছে, কারণ ভারতেরই পণ্যজট এবং ধীরগতি সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে ২০২০ সালে দেওয়া নির্দিষ্ট এই সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে।”
নেপাল ও ভুটানে পণ্য যাওয়ার সুযোগ ‘বন্ধ করার’ প্রসঙ্গ ধরে আরেক সাংবাদিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মত অংশীদারের কাছ থেকে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য যখন চাপের মুখে পড়েছে, তখন বাংলাদেশি ট্রাক বন্ধ না করে বাংলাদেশ-নেপালের মত দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য জোরদারের করারইতো কথা ছিল।
উত্তরে মুখপাত্র বলেন, “আমি আবারও বলছি, নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশের রপ্তানির ক্ষেত্রে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। পণ্যজট মোকাবেলার কারণে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নিজেদের রপ্তানির জন্য আমাদের বাড়তি জায়গার দরকার ছিল।”
ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধের খবরে বাংলাদেশেও প্রতিক্রিয়া হয়।চলমান বিনিয়োগ সম্মেলনের ফাঁকে এক ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুনকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা।
উত্তরে তিনি বলেন, “গত এক সপ্তাহ ধরে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এখন বাণিজ্য জগতে অনেকেই দ্রুত অনেক ধরনের সিদ্ধান্ত… এগুলো আবার পরিবর্তন (ওভারটার্ন) হবে বলে আমার ধারণা। যেহেতু বিষয়টি আমি বিস্তারিত জানি না, তাই মন্তব্য করতে পারছি না।”
প্রধান উপদেষ্টার ‘সেভেন সিস্টার্স’ বিষয়ে বক্তব্যের ফলে এমন সিদ্ধান্ত ভারত নিয়েছে বলে ধারণা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সাবেক অধ্যাপক আমেনা মোহসিনের।
তার ভাষ্য, “সেটা মনে হচ্ছে আপাতত দৃষ্টিতে। সেভেন সিস্টার নিয়ে যে, যেটা সেটা।”
এ পরিস্থিতিতে দুই দেশই আলোচনায় সমাধান খুঁজবেন বলেও আশা করেন এ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।
বাংলাদেশের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করল ভারত
ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের প্রভাব নেপাল-ভুটানে রপ্তানির ক্ষেত্রে পড়বে না: ভারত