রাসেলকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, শুক্রবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে তা সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, বিপুল সংখ্যক গ্রাহক তৈরি করে ইভ্যালির ‘ব্র্যান্ডভ্যালু’ বাড়ানোর পরিকল্পনা ছিল রাসেলের। সেই ব্র্যান্ডভ্যালু কাজে লাগিয়ে তিনি কোনো বিদেশি কোম্পানির কাছে দায়সহ ব্যবসা বেচে দেওয়ার কথা ভাবছিলেন।
“তিনবছর পূর্ণ হলে শেয়ার মার্কেটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে দায় চাপানোরও পরিকল্পনা ছিল তার। আর দায় মেটাতে ব্যর্থ হলে কোম্পানি দেউলিয়া ঘোষণার পরিকল্পনা ছিল।”
প্রতারণার অভিযোগে এক গ্রাহকের করা মামলায় ইভ্যালির এমডি মোহাম্মদ রাসেল এবং তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোছা. শামীমা নাসরিনকে বৃহস্পতিবার বিকালে তাদের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
রাতে র্যাব সদরদপ্তরে রেখে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর শুক্রবার উত্তরায় র্যাব সদরদপ্তরেই সংবাদ সম্মেলনে আসেন কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, “একটি প্রতিবেদনে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইভ্যালির দেনা ৪০৩ কোটি টাকা বলা হলেও তিনি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, তার এক হাজার কোটি টাকা দায় রয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনের পর রাসেল ও তার স্ত্রীকে গুলশান থানায় সোপর্দ করা হয়।
মামলার বাদী আরিফ বাকের তার অভিযোগে বলেন, ইভ্যালির বিজ্ঞাপন দেখে প্রভাবিত হয়ে তিনি ৩ লাখ ১০ হাজার টাকার পণ্যের অর্ডার দেন। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে তাকে কোনো পণ্য সরবরাহ করা হয়নি।
প্রতারণা ও গ্রাহক হয়রানির অভিযোগে ইভ্যালি এমডি রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে এর আগেও কয়েকটি মামলা হয়েছে বিভিন্ন জেলায়।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু করে মাত্র আড়াই বছরের মাথায় সরবরাহকারী কোম্পানি ও গ্রাহকদের কাছে কয়েকশ কোটি টাকার দায়ে পড়েছে ইভ্যালি। এত অল্প সময়ে এই বিপুল টাকা কোথায় গেল, তার হদিস এখনও মেলেনি।
আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে গত জুলাই মাসে দুদকের আবেদনে ইভ্যালির শীর্ষ কর্তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদালত।
র্যাব কর্মকর্তা মঈন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, রাসেল ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করতেন। পরে তিনি একটি ব্যাংকে চাকরি নেন। ২০১৭ সালে চাকরি ছেড়ে ডায়াপারের ব্যবসা শুরু করেন।
“ওই ব্যবসা বিক্রি করে তিনি এক কোটি টাকা পান। এই সামান্য টাকা দিয়ে ইভ্যালির কার্যক্রম চালু করেন।”
কমান্ডার মঈন বলেন, “এখন পর্যন্ত ইভ্যালি যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে, যেসব অফার দিয়ে আসছে,তার যে ব্যসায়িক কৌশল ছিল, এখন পর্যন্ত উনার কোনো লভ্যাংশ উনি পাননি। ক্রমান্বয়ে উনি দায় বাড়িয়েছেন। উনার প্রতিষ্ঠান এখন দেনাদার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।”
প্রতিষ্ঠার পর এক/দুই মাসের আগাম সময় নিয়ে প্রায় অর্ধেক মূল্যে পণ্য সরবরাহের বিভিন্ন ‘অফার’ দেওয়া শুরু করেছিল ইভ্যালি। তাতে অল্প সময়ের মধ্যে সারাদেশে মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, এসি, প্রাইভেটকারসহ নানা পণ্যের ক্রেতাদের সমারোহ ঘটেছিল ইভ্যালিতে।
স্বল্প মূল্যের এসব পণ্যের জন্য টাকা নেওয়া হতো অগ্রিম। কিন্তু কিছু ক্রেতাকে পণ্য দিয়ে বাকিদেরকে অপেক্ষায় রাখার কৌশল নিয়ে তারা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল। এখন এ কোম্পানির দায় দাড়িয়েছে সম্পদের কয়েক গুণ বেশি।
গ্রাহকদের অর্থ কীভাবে ফেরত দেবেন সে ব্যাপারে রাসেলকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল র্যাব। কিন্তু তিনি কোনো ‘সদুত্তর’ দিতে পারেননি বলে কমান্ডার মঈনের ভাষ্য।
“মানুষের কাছ থেকে যেভাবে অগ্রিম অর্থ বা পণ্য নিয়েছেন তা ফিরিয়ে দেওয়া জটিল বলে রাসেল স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করেছেন।”
দীর্ঘদিন ধরে গ্রাহকরা যখন প্রতারিত হচ্ছিলেন, পণ্য পাচ্ছিলেন না, তখন হঠাৎ করে ‘টি টেন’ ‘টি সেভেন’ ‘টি ফাইভ’ নামে অফার ঘোষণা করে ইভ্যালি। এসব অফারের মাধ্যমে আসলে সাধারণ পণ্য দেওয়া হত।
“রাসেলের বক্তব্য অনুযায়ী, গত ফ্রেবুয়ারির পর বড় কোনো পণ্যা গ্রাহককে তারা দিতে পারেননি,” বলেন মঈন।
“এই প্রচার প্রচারণা… তার সম্পূর্ণটাই সাধারণ জনগণের লগ্নিকৃত অর্থের মাধ্যমে করেছেন, লভ্যাংশ থেকে করেননি।”
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে র্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, “বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যেসব কোম্পানি ই- কমার্সে বিনিয়োগ করে, ইভ্যালিতে তাদের বিনিয়োগ পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল রাসেলের। সেজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘুরেছেন, তাদের সাথে আলোচনা করেছেন।
“গ্রাহক সংখ্যা দেখিয়ে ইভ্যালিতে বিনিয়োগ করতে তাদের প্রলুব্ধ করতে চেয়েছিলেন রাসেল। দেশি কোম্পানিগুলো বিনিয়োগে উৎসাহিতও হয়েছিল। কিন্তু তারা ভেতরে ঢুকে দেখল, ইভ্যালির যে পরিমাণ দায়, সেখান থেকে উত্তরণ বেশ কষ্টসাধ্য।”
রাসেল এবং তার স্ত্রী পদাধিকার বলে মাসে ৫ লাখ টাকা করে বেতন নিতেন এবং কোম্পানির টাকায় দুটি রেঞ্জ রোভার ও অডি গাড়ি ব্যবহার করতেন। সাভারে রাসেলের কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি থাকলেও তার নিজের নামে কোনো ফ্ল্যাট নেই বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান হয়।