বৃহস্পতিবার বিকালে ঢাকার মোহাম্মদপুরে রাসেলের বাসায় ঘণ্টাখানেক অভিযান চালানোর পর তাদের দুজনকে র্যাবের গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান খায়রুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তাদের র্যাব সদরদপ্তরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যে মামলা হয়েছে, তাতে তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হবে।”
বিকাল ৪টার দিকে স্যার সৈয়দ রোডের একটি নয়তলা ভবনের চতুর্থ তলায় রাসেলের ফ্ল্যাটে র্যাবের অভিযান শুরু হয়। পরে বিকাল সোয়া ৫টার দিকে রাসেল ও তার স্ত্রীকে বাসা থেকে বের করে র্যাব সদরদপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়।
এ বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় বলেন, “মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইভ্যালি সিইও রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে র্যাব সদর দপ্তরে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছে। শুক্রবার বিস্তারিত জানিয়ে প্রেস ব্রিফ্রিং করা হবে।”
মামলার বাদী আরিফ বাকের তার অভিযোগে বলেন, ইভ্যালির বিজ্ঞাপন দেখে প্রভাবিত হয়ে তিনি ৩ লাখ ১০ হাজার টাকার পণ্যের অর্ডার দেন। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে তাকে কোনো পণ্য সরবরাহ করা হয়নি।
পণ্যের ব্যাপারের ইভ্যালির অফিসে এবং পরে সিইও মো. রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ‘প্রাণনাশের হুমকি’ দেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।
প্রতারণা ও গ্রাহক হয়রানির অভিযোগে ইভ্যালি এমডি রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে এর আগেও কয়েকটি মামলা হয়েছে বিভিন্ন জেলায়।
আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে গত জুলাই মাসে দুদকের আবেদনে ইভ্যালির শীর্ষ কর্তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদালত।
এদিকে রাসেল গ্রেপ্তার হওয়ার খবরে গ্রাহকদের অনেকে তার মোহাম্মদপুরের বাসার সামনে ভিড় করেন। রাসলেকে র্যাব নিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিবাদ জানিয়ে মোটামুটি অর্ধশতাধিক লোককে সেখানে বিক্ষোভ করতেও দেখা যায়।
নিজেদের ইভ্যালির গ্রাহক হিসেবে পরিচয় দিয়ে তারা রাসেলকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানান। তাদের বিক্ষোভের কারণে রাসেলকে বহনকারী মাইক্রোবাস কিছুটা বাধার মুখে পড়ে।
এসময় ‘রাসেল ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’, ‘রাসেল ভাইয়ের মুক্তি চাই‘- ইত্যাদি গ্লোগান দেয় বিক্ষোভকারীরা।
“কিন্তু তারপরেও আমি চাই রাসেল ভাইকে গ্রেপ্তার না করে ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়া হোক।"
সজীবুর রহমান নামে আরেকজন বলেন, “রাসেলকে গ্রেপ্তার করে কোনো লাভ নেই। তাকে সুযোগ দেওয়া উচিত। তিনিতো সময় চেয়েছেন। তাকে সে সময়টা না দিয়ে গ্রেপ্তার করা হল। গ্রেপ্তার করে গ্রাহকের টাকা আদায় করা যায় না।”
রাসেলকে র্যাব নিয়ে যাওয়ার এক ঘণ্টা পরও গ্রাহকরা তার বাসার সামনে অবস্থান করে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন।
মো. রাসেল মোহাম্মদপুরের ওই ভবনের চতুর্থ তলায় ভাড়া থাকেন বলে জানান বাড়ির কেয়ারটেকার।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যানে লেখাপড়া করা রাসেল আগে ঢাকা ব্যাংকে চাকরি করতেন। পরে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে অনলাইনে পণ্য বেচাকেনার ব্যবসা শুরু করেন।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, অনলাইনে তিনি ডায়াপার বিক্রি দিয়ে শুরু করেছিলেন। পরে বড় আকারে ই কমার্স প্ল্যাটফর্ম করার চিন্তা করেন। সেই পথ ধরেই ২০১৮ সালে তার ই-কমার্স কোম্পানি ইভ্যালির যাত্রা শুরু হয়।
প্রতিষ্ঠার পর এক/দুই মাসের আগাম সময় নিয়ে প্রায় অর্ধেক মূল্যে পণ্য সরবরাহের বিভিন্ন ‘অফার’ দেওয়া শুরু করেছিল ইভ্যালি। তাতে অল্প সময়ের মধ্যে সারাদেশে মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, এসি, প্রাইভেটকারসহ নানা পণ্যের ক্রেতাদের সমারোহ ঘটেছিল ইভ্যালিতে।
স্বল্প মূল্যের এসব পণ্যের জন্য টাকা নেওয়া হতো অগ্রিম। কিন্তু কিছু ক্রেতাকে পণ্য দিয়ে বাকিদেরকে অপেক্ষায় রাখার কৌশল নিয়ে তারা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল বলে পরে অভিযোগ উঠতে শুরু করে।
এসব অনিয়ম নিয়ে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে নানা কথা উঠলেও কোনো ব্যবস্থা তখন নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে আইন ও নীতিমালা ‘না থাকার’ কথা বলা হচ্ছিল সে সময়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ইভ্যালির বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিলে কোম্পানির গাড্ডায় পড়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
সেখানে বলা হয়, গত ১৪ মার্চ ইভ্যালি ডটকমের মোট সম্পদ ছিল ৯১ কোটি ৬৯ লাখ ৪২ হাজার ৮৪৬ টাকা (চলতি সম্পদ ৬৫ কোটি ১৭ লাখ ৮৩ হাজার ৭৩৬ টাকা) এবং মোট দায় ছিল ৪০৭ কোটি ১৮ লাখ ৪৮ হাজার ৯৯৪ টাকা।
এর মধ্যে গ্রাহকের কাছে ইভ্যালির দায় ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ ৬ হাজার ৫৬০ টাকা এবং মার্চেন্টের কাছে দায় ১৮৯ কোটি ৮৫ লাখ ৯৫ হাজার ৩৫৪ টাকা।
ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পর ইভ্যালির বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দুদককে অনুরোধ করা হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ইভ্যালির বিষয়ে গ্রাহক ও মার্চেন্টের ৩৩৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা আত্মসাত ও পাচারের অভিযোগ পেয়ে গত ৮ জুলাই থেকে অনুসন্ধানে নামে দুদক। দুদকের আবেদনে তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদালত।
প্রতারণার অভিযোগ ওঠার পর ইভ্যালির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাসেলের ব্যাংক হিসাবে লেনদেন স্থগিত করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
অগাস্টের শেষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ইভ্যালির পক্ষ থেকে জমা দেওয়া দায়-দেনার হিসাবে বলা হয়, দুই লাখ ১৪ হাজার গ্রাহক ইভ্যালির কাছে পণ্য কেনার জন্য বুকিং দিয়েছেন। গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত বুকিং বাবদ গ্রাহকরা ইভ্যালির কাছে ৩১০ কোটি টাকা পাবেন।
ব্যাপক আলোচনার মধ্যে গত ৪ সেপ্টেম্বর এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসে ইভ্যালির এমডি দাবি করেন, ভুল হতে পারে, কিন্তু কোনো আইন তিনি ‘ভাঙেননি’।