“ঝামেলা হইলো, এইবার আমরা না ওই তিন মাস বিক্রি করতে পারছি, না পারতেছি এখন,” হতাশ কণ্ঠে বলেন এক দোকানি।
Published : 17 Apr 2023, 12:37 PM
“আগে এই সময়ে আসলে আমাদের আপনার সাথে কথা বলার মতো সময় থাকত না, আর এবার দেখেন আমিসহ আমরা সবাই আড্ডা দিচ্ছি।”
ঈদের আগে গয়নার বিক্রিবাট্টা কেমন সেই আলাপে বলছিলেন ঢাকার ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্সের সারা গ্যালারির সত্ত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে তার দাবি, গতবারের ঈদের তুলনায় তাদের ক্রেতা অর্ধেক কমে গেছে।
বাঙালি নারীর সাজপোশাকের অন্যতম অনুষঙ্গ গয়নার বিক্রি কেমন চলছে- তা দেখতে শুক্রবার রাজধানীর নিউ মার্কেটের ওই বিপণি বিতানে গিয়ে দেখা যায়, সিংহভাগ দোকানি হয় মোবাইল ফোনে সময় কাটাচ্ছেন, নয়ত নিজেদের মাঝে খোশগল্পে মত্ত।
সেখানকার সুশ্রী জুয়েলার্সে গত তিন বছর ধরে কাজ করেন সঞ্জীব বর্ধন। তিনি বলেন, “আমি এই লাইনে ১৫ বছর। কিন্তু কোনো বছর এত বাজে অবস্থা আমি দেখি নাই। আমাদের গয়না বেচার মূল সিজন আসলে চলে গেছে। কিন্তু ঈদের সময় একটা মিনিমাম বিক্রি তো হইত। এবার তাও নাই।”
বাংলা বর্ষবরণ আর ঈদের আগে গয়নার বাজারে একটু সরগরম হওয়ার আশায় ছিলেন দোকানিরা। তবে ভিড় তো দূরের কথা সেই অর্থে ক্রেতাও নেই বলে দাবি রাজধানীর বিভিন্ন বিপণি বিতানের গয়না ব্যবসায়ীদের।
শুক্রবার বসুন্ধরা সিটি শপিং মলের তাজ ইন্ডিয়া নামের এক গয়নার দোকানে অনেকটাই অলস বসে থাকা কর্মী আদি বললেন, “আজ শুক্রবার, প্লাস বৈশাখ। অনেক ভিড় আশা করছিলাম। কিন্তু কোনো ভিড় দেখতে পাইতেছেন আপনি? কিছুই নাই। সারাদিন বইসা ছিলাম, এখনও বইসাই আছি। দেখি, ইফতারের পর হয়ত মানুষ আসা শুরু করবে।”
২৫ রোজার পর বিক্রি বাড়ার আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, সাধারণত বিয়ের সময়কাল হিসেবে পরিচিত নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি গয়না বিক্রির প্রধান মৌসুম। তবে ঈদে সবসময় ‘সিম্পল’ গয়না চললেও এবার পুরাই খরা।
“ঝামেলা হইলো, এইবার আমরা না ওই তিন মাস বিক্রি করতে পারছি, না পারতেছি এখন,” হতাশ কণ্ঠে বলেন তিনি।
সবখানের হালচাল কাছাকাছি
দেশে এখনও অধিকাংশ ইমিটেশন জুয়েলারি পণ্য চীন ও ভারত থেকে আমদানি হয়। এর বাইরে ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও সাভারের ভাকুর্তা এলাকায় স্থানীয় কারিগরদের হাতে কিছু অলঙ্কার তৈরি হয়।
বাংলাদেশ ইমিটেশন জুয়েলারি মেনুফ্যাকচারার্স, এক্সপোর্টার্স অ্যান্ড মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আনিসুর রহমান বাদশা বলেন, “দেশে প্রডাকশন হয় মাত্র ৫ শতাংশ। ৯৫ শতাংশ চায়না ও ভারত থেকে। কিন্তু উন্নত পণ্যগুলো বিদেশ থেকেই আসে। দেশে উৎপাদিত ইমিটেশন পণ্যগুলো মান অতটা ভালো হয়না।”
গত কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও অন্যান্য কারণে সোনালী রঙে মোড়ানে এসব অলঙ্কারের বাজার খারাপ হয়ে গেছে জানিয়ে বাদশা বলেন, “করোনার আগে বছরে হাজার কোটি টাকার ইমিটেশন অলঙ্কার আমদানি হয়েছিল। পরের বছরগুলোতে আমদানি কিছুটা কমেছে।
“ডলার সঙ্কটের কারণে আমদানি নিয়ন্ত্রণকালীন পরিস্থিতিতে আমদানি আরও সীমিত হয়ে গিয়েছিল। ঈদ উপলক্ষে আবার আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে ডলারের দাম বাড়ার কারণে অলঙ্কারের দামও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। পাশপাশি বিক্রিও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে “
বৃহস্পতি ও শুক্রবার রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স, ইস্টার্ন মল্লিকা ও গাউছিয়া মার্কেট ঘুরে দেখা যায়, ক্রেতা সমাগম রমজানের শুরুর দিকের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি হলেও গয়নার দোকানগুলোতে ততটা নয়। পোশাকের দোকানগুলোতে যতটা গমগম করছে ক্রেতা-দোকানির হাঁকডাকে তেমনটি নেই গয়নার দোকানে।
তবে ভিন্ন চিত্রও কিছুটা চোখে পড়েছে। বসুন্ধরা সিটিতে এফজি নামের ছোট এক গয়নার দোকানে নজরে পড়ে এমন ভিড় দেখা গেল। ক্রেতাদেরকে সামাল দিতে হিমশিম অবস্থা বিক্রয়কর্মীদের।
দোকানের কর্মী মো. শাখাওয়াত হাসতে হাসতে বলেন, “আসলে ভিড় বেশি, তা বলা যাবে না। ক্রেতা যখন আসে, একসাথে প্রচুর আসা শুরু করে। আর যখন আসে না, আসেই না। আজ সারাদিন যেমন আমরা বসা ছিলাম। কিন্তু এখন আবার কিছু কিছু আসতেছে।”
বিক্রিতে ভাটা: কী বলছেন দোকানিরা
গয়না কম কেনার কারণ হিসেবে সুশ্রী জুয়েলার্সের সঞ্জীব বর্ধন দাম বেড়ে যাওয়ার কথা বললেন। বর্তমান ঊর্ধ্বগতির বাজারে জীবনযাত্রার অন্যান্য হিসাব মিটিয়ে গয়নার জন্য টাকা বাঁচাতে না পারার বিষয়টি তার চোখে ধরা পড়েছে বলে জানালেন।
“মানুষ আসলে কিনতে চায়। তারা আসে, দেখে, দাম করে, চলে যায়। কিনতে পারে না, কারণ অন্যসবের মতো গয়নার দামও তো কিছুটা বাড়তি এখন। আর আমরাও একেবারে লস কইরা দিতে পারি না। মানুষের জীবনে কোনটা আগে? পোশাক, নাকি গয়না? অবশ্যই পোশাক। তাই কাপড়ের দোকানেই শুধু ভিড় এখন।”
রঙ, মেটাল, পাথরসহ উপকরণগুলোর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে গয়নার দরও বাড়তি। ক্রেতা পেতে কম লাভে তাদের বিক্রির চেষ্টাও সফল হচ্ছে না বলে কারও কারও দাবি।
সারা গ্যালারির সাইফুলের ভাষ্য, “সবকিছুতে অন্তত ৩০ শতাংশ দাম বাড়ছে। কারণ গয়নার কাঁচামাল দেশে হয় না। এই যে স্টোন দেখছেন, এগুলা আপনাকে বাইরে থেকেই আনতে হবে, দেশে পাবেন না। এলসি ওপেন ছিল, আমরা বাড়তি দাম দিয়ে জিনিস আনছি।”
ইস্টার্ন মল্লিকার নীল জুয়েলার্সের কর্মী অন্তু সাহা বললেন মেটালের দাম বাড়ার কথা। যেগুলোয় ‘কালারের গ্যারান্টি’ থাকে সেগুলোর দাম বেড়েছে, অন্যগুলো একই আছে বলে জানালেন তিনি।
“আমাদের এমনিতেও ঈদে ওইভাবে বিক্রি হয় না। যা হয়, বছরের শেষে আর শুরুতে। এ ঈদের সময় যারা আসে, তারা ছোট ছোট জিনিস কিনতে আসে। যেমন ‘কেজেড’ এর ব্যবসা এখন ভালো। কারণ ওদের গয়নার দাম ৫০০ এর মধ্যে। আমাদের তো সব বিয়ের গয়না।”
কেজেড এ গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ক্রেতাদের আনাগোনা বেশি। এক কর্মী সামিউল হক তুহিন জানান, বছরজুড়েই মোটামুটি ভালো বেচাবিক্রি হয় তাদের। তবে ঈদ বাজার হিসেবে গতবারের চেয়ে ব্যবসা কম। মানুষের কাছে টাকা না থাকাকে তুলে ধরলেন কারণ হিসেবে।
রাজধানীর গাউছিয়া মার্কেটে বিত্তবান-সীমিত আয়ের মানুষের দেখা মেলে সমানভাবে। সেখানকার গয়নার বাজার কেমন চলছে, তা দেখার জন্য গেলে এক দোকানি মোহাম্মদ সাঈদ বলেন, “বেচাবিক্রি অনেক কম। রোজার আগে যেই পরিমাণ বিক্রি করতে পারছি, এখন সেই পরিমাণও বিক্রি করতে পারি না।
“ব্যাপারটা আমরাও বুঝতেছি না। সকাল ৯টায় দোকান খুলছি। এখন দুপুরে এসেও বিসমিল্লা হয় নাই। আমার অবস্থা খারাপ, এবার ঈদ হইবো না। জিনিসপত্রের দাম বেশি। মানুষ আগে খাবারের নিশ্চিয়তা চায়। এরপরে তারা এসব শৌখিন জিনিস কিনতে আসে।”
চকবাজারের জিনাত ট্রেডিং এর হেদায়েতুল্লাহ ঈশান বলেন, “দীর্ঘদিন বিলাসী পণ্য আমদানি বন্ধ থাকার পর, ঈদের কিছুদিন আগে সরকার ইমিটিশনের গহনা আমদানির সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু আমদানি করতে গিয়ে দেখি, ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে দাম অনেক বেশি পড়ে যাচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম বেশি হওয়ায় মানুষ এখন এই ধরনের বিলাস পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে।”
ক্রেতারা কী বলছেন?
এ দোকানে সপরিবারে গয়না কিনতে এসেছেন নাজমা রহমান। ঈদের জন্য আগেই হালকা গয়না কেনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন আমি একটু ভারি গয়না কিনতে আসছি, শাড়ির সাথে পরার জন্য। কারণ ঈদের পরই আমার ভাইয়ের ছেলের বিয়ে।”
তবে ইমিটিশন বা মেটালের গয়নার পাশাপাশি এখন রূপার গয়নার প্রতিও ঝোঁক বাড়ছে নারীদের। বসুন্ধরা সিটির আড়ং এ গয়নার অংশে নারীদের হুমড়ি খাওয়া ভিড়।
তাদের একজন পলিন রহমান বলেন, “রূপার গয়না কিনব কারণ গয়না-টয়নার বেলায় আমি স্থায়ী কিছু কেনা পছন্দ করি। টাকার হিসাব করে আমি মেটালের গয়না কিনলাম। কিন্তু দুইদিন পর তা নষ্ট হয়ে যাবে, মাঝখান থেকে পুরো টাকাটা জলে।”
তবে শিক্ষার্থী বা কম আয়ের ক্রেতার এভাবে ভাবার সুযোগ কম। তাদের ভরসা গাউছিয়ায় বৃহস্পতিবার বিকালে বৈশাখের জন্য গয়না কিনতে আসা অনন্যা গুহ বলেন, “এবার বিভিন্ন ব্যস্ততায় বৈশাখের জন্য ম্যাচিং করে গয়না কেনার সময় পাই নাই। তাই আজকে চলে এলাম।”