“অনেকে বিনিয়োগ যে করবেন, সে আস্থা পাচ্ছেন না। টাকা যদি লক হয়ে যায়, তাহলে আমরা কোথায় যাব?” বলেন রিহ্যাবের সহসভাপতি আবদুল লতিফ।
Published : 03 Nov 2024, 01:40 AM
ঢাকার একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন টঙ্গীর বোর্ডবাজার এলাকার বাসিন্দা জাকির হোসেন, যিনি দুই বছর আগে অবসরে যান; তার স্ত্রী মনোয়ারা বেগমও প্রায় অবসরের দ্বারপ্রান্তে। নিজেদের সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট কেনার ইচ্ছে ছিল তাদের কিন্তু কিনবেন কি না তা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দে ভুগছেন এখন।
জাকির হোসেন বলছেন, সরকার পরিবর্তনের এই ডামাডোলে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ফ্ল্যাট কেনার সাহস পাচ্ছেন না।
“আমি আর আমার স্ত্রী মিলে প্রায় ৬০ লাখ টাকার মত সঞ্চয় করেছি- আমার পেনশন আর সব মিলিয়ে। কিন্তু এই টাকায় যেখানে খুঁজছি সেখানে নতুন ফ্ল্যাট পাব না।
“এটা তো একটা সমস্যা। পাশাপাশি পুরোনো ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশন ফি, আর নতুনের ফি যে একই; এটা আমি জানতাম না। প্রায় ১৫ শতাংশ। সব থেকে বড় কথা হল, এই মুহূর্তে এই টাকায় ফ্ল্যাট কিনে ঝামেলায় পড়ি কি না। এ জন্য কেনা হচ্ছে না।”
সরকার পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, ক্রেতা-বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা, উচ্চ নিবন্ধন ফি, নির্মাণসামগ্রীর মূল্য বেড়ে যাওয়া, ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) সংশোধন না করাসহ বেশ কিছু কারণে দেশের আবাসন ব্যবসা ঝিমিয়ে পড়েছে বলে তথ্য দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
জীবনযাত্রায় উচ্চ ব্যয়ের কারণে সঞ্চয় ভেঙে ফ্ল্যাট কেনায় এই মুহূর্তে আগ্রহ দেখাচ্ছে না মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই। আবার ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ফ্ল্যাট-প্লটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে ‘কালো টাকা’ বিনিয়োগের যে সুযোগ রাখা হয়, সংস্কারমুখী অন্তর্বর্তী সরকার যে বিষয়ে অবস্থান পরিষ্কার করেনি। ফলে সব শ্রেণির ক্রেতাদের মধ্যে সংশয় কাজ করছে বলে উঠে এসেছে সংশ্লিষ্টদের কথায়।
দ্বিধায় ক্রেতা
ধানমণ্ডির ৯/এ এলাকায় একটি ফ্ল্যাট কেনার পরিকল্পনা ছিল চাঁদপুরের কচুয়ার মধ্যবিত্ত দম্পতি রিনা বেগম ও স্বপন হোসেনের।
কিস্তিতে কেনার শর্তে দিয়েছিলেন ডাউন পেমেন্টও। কিন্তু এখন তারা কিস্তি পরিশোধ না করে সেই ফ্ল্যাটটি বিক্রির চেষ্টা করছেন।
রিনা বেগম বলেন, “আসলে আমরা সিকিউরড ফিল করছি না। দেশের একটা শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকে আমাদের কিছু জমানো অর্থ ছিল৷ এখন সেখান থেকে টাকা তুলতে পারছি না। ব্যাংকের লোকজন সময় চেয়েছে।
“তবুও আমরা ফ্ল্যাটের কিস্তিটা চালিয়ে যেতে চাইছিলাম কিন্তু সাহস পাচ্ছি না। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় কি না অথবা রাজনৈতিক পরিস্থিতিইবা কেমন হয়; এটা নিয়ে একটা শঙ্কা আছে। ফলে আমরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছি। তাই ভাবছি- এখন হয়ত বিক্রি করে দিলেই ভালো হবে। পরে সুবিধাজনক সময়ে রাখা যাবে। কিন্তু বাজার মন্দা৷ ক্রেতা পাচ্ছি না। একটা ভালো ঝামেলায় আছি বলতে পারেন।”
ঢাকার নিকেতনে একটি ফ্ল্যাটে থাকেন ব্যবসায়ী বোরহান উদ্দিন। মহাখালীতে তার নিজের ব্যবসা আছে। তিনি মগবাজারে একটা ফ্ল্যাট কেনার কথা পাকাপাকি করেছিলেন। তবে এখন তিনি ফ্ল্যাট না কিনে সে টাকা নিজের অন্য ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। তার ভাষ্যও প্রায় একইরকম।
তিনি বলেন, “এটার মূল কারণ হচ্ছে সময়টা আসলে বুঝতে পারছি না; নিরাপদ হবে কি না। যে হারে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, তাতে ফ্ল্যাট কেনাটা প্রয়োজন কি না, এখন সেটা নিয়ে দ্বিধায় আছি।”
পরিবর্তিত সময়ে বিক্রি কমেছে অন্তত ৫০ শতাংশ
আবাসন ব্যবসায় মন্দার জন্য বেশ কয়েকটি কারণের কথা করছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে সরকার পরিবর্তনের পর অস্থির সময়, অর্থনৈতিক মন্থরগতি, বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা-ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) বাতিল করার কথাই ঘুরে ফিরে আসছে।
দেশের আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-রিহ্যাবের দেওয়া তথ্যানুযায়ী ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ১৫ হাজারের কাছাকাছি ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়েছে।
এরপর ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সেটি নেমে বছরে গড়ে ১২ হাজারের কিছু বেশিতে ঠেকে। ২০১৭-২০২০ পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ১৩ থেকে ১৪ হাজারে দাঁড়ায়।
২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রতি বছর ১৫ হাজারের কাছাকাছি ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়েছে।
এরপর নির্মাণ উপকরণের মূল্য বেড়ে যায়, যার প্রভাব দেখা যায় ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রিতে। সঙ্গে শুরু হয় কোভিড মহামারী। ফের কমে যায় কেনাবেচা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিক্রি হয় ১০ হাজারের কাছাকাছি এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংখ্যাটি ১০ হাজারের নিচে নেমে যায়।
এ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদা দিনকে দিন কমছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক বছর আগে থেকে বর্তমান পর্যন্ত ফ্ল্যাট বিক্রির ব্যবসা কমেছে অন্তত ৫০ শতাংশ বলে দাবি সংগঠনটির।
‘ব্যাসিক বিল্ডার্স লিমিটেডের’ ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও রিহ্যাবের সহ-সভাপতি আবদুল লতিফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সব ব্যবসায় আসলে ‘মন্দা’ যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের রিয়েল এস্টেট ব্যবসাও শ্লথ। বেচাবিক্রি যে একেবারে হচ্ছে না, তা না। হচ্ছে; কিন্তু দামে কম্প্রোমাইজ করতে হচ্ছে। আগে যা হত, এখন তার চেয়ে ৫০ বা ৬০ শতাংশ কম হচ্ছে।”
কেন বিক্রি কমে গেল- এই প্রশ্নে আবদুল লতিফ বলেন, “একটা বড় চেঞ্জ (ক্ষমতার পরিবর্তন) হওয়ার পরে মানুষের মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করে। যারা বিনিয়োগকারী তাদের মধ্যেও একটা আতঙ্ক থাকে; এই মুহূর্তে বিনিয়োগ করা ওয়াইজ (সঠিক সিদ্ধান্ত) হবে কি না, দেশের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে কি না। এই যে একটা শঙ্কা নাগরিকদের মধ্যে, এ জন্যই নাগরিকেরা ‘গো স্লো' ওয়েতে রয়েছে।
“এর মধ্যে কিছু ব্যাংকের লিকুইড মানির (তারল্য) সংকট আছে, যার জন্য অনেকে ফ্ল্যাট কিনেও দেখা যাচ্ছে ওই ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে না পারায় ঠিক সময়ে কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না।”
পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে এই ব্যবসায়ী নেতা বলছেন, “আমার মনে হয় আগামী দুই-তিন মাস সরকার যদি ল' অ্যান্ড অর্ডারটা ঠিক করতে পারে, দেশটা যদি স্থিতিশীল হয়ে যায়, অর্থনৈতিক পরিস্থিতিটা যদি একটু ভালো হয়, তাহলে আমার মনে হয়, এই পরিস্থিতিটা বেশি দিন থাকবে না। ডিসেম্বর নাগাদ এটা ঠিক হয়ে যাবে।”
সংকট কাটাতে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ প্রত্যাশা করে রিহ্যাব সহ-সভাপতি লতিফ বলছেন, “আর সরকারের তরফ থেকে যে সমস্ত সেক্টরে বিনিয়োগে বাধা নাই বা এখানে বিনিয়োগ করলে বা ব্যাংকে টাকা রাখলে যে ঝুঁকি নাই; এ ধরনের প্রচার হলে হয়ত সেক্টরটা ঘুরে দাঁড়াবে। মানুষের মধ্যে সাহস সঞ্চার হবে। এটাই মেইন ইস্যু।
“অনেকে বিনিয়োগ যে করবেন, সে আস্থা পাচ্ছেন না। টাকা যদি লক হয়ে যায়, তাহলে আমরা কোথায় যাব? এ দিকে অনেক ব্যাংকে তারল্য সংকট। ফলে দুটো মিলেই এই ব্যবসায় এখন ‘মন্দা’ বলে আমরা ফিডব্যাক পেয়েছি।”
আরেকজন ব্যবসায়ী বলেন, বাজারে যারা সত্যিকার ক্রেতা, তারা ফ্ল্যাটের দামও কম বলছেন। নেওয়ার আগ্রহও কম। সুযোগ বুঝে যদি কম দামে পাওয়া যায়, এ ধরনের কিছু ক্রেতা মার্কেটে আছেন। সব মিলিয়ে বিক্রির গতি স্লথ।”
বারিধারা, গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডি রাজধানীর অভিজাত আবাসন এলাকা হিসেবে পরিচিত। সাধারণত উচ্চবিত্তরা এসব এলাকার প্লট-ফ্ল্যাটের মালিক। আবাসন ব্যবসায়ীদের একটি অংশ এসব এলাকায় বড় পুঁজি বিনিয়োগ করে, ব্যাংকও এগিয়ে আসে তাদের পাশে। এখন এখানেও বেচাকেনায় গতি নেই।
অভিজাত এলাকাগুলোতে ব্যবসা করে আকাশ ডেভেলপারস। কোম্পানিটির ম্যানেজার অনিরুদ্ধ বাপ্পি বলছিলেন, “আমাদের প্রোডাক্ট বা প্রজেক্ট আছে। তবে মার্কেট এখন স্লো। ক্রেতা আছেন, তবে মনে হচ্ছে তারা সময়টা পর্যবেক্ষণ করছেন। ”
কালো টাকা বিনিয়োগ সুবিধা থাকবে কি না?
ক্ষমতার পালাবদলের পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে ঢালাওভাবে অপ্রদর্শিত অর্থ (কালো টাকা) সাদা করার সুযোগ গত ২ সেপ্টেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে বাতিল করে।
তবে চলতি বাজেটে কালো টাকা বিনিয়োগেরে জন্য দেওয়া আরেকটি সুযোগের বিষয়ে এ প্রজ্ঞাপনে কিছু বলা হয়নি। সেই সুযোগ হল- স্থাপনা, বাড়ি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট, ফ্লোর স্পেস ও ভূমি আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত থাকলে তা নির্ধারিত হারে আয়কর দিয়ে বৈধ করার বিধান।
সরকার কোনো সিদ্ধান্ত না দেওয়ায় আইনের দিক থেকে এটি এখনও বহাল রয়েছে। তবে গত দুই মাসে আবাসন খাতে মন্থর গতি থেকে বোঝা যায়, সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন না বিনিয়োগকারী বা ক্রেতারা।
এ বিষয়ে এনবিআরের (করনীতি) সদস্য এ কে এম বদিউল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সবশেষ বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের যে সুযোগ রাখা হয়েছিল, সেটা ২ সেপ্টেম্বর বাতিল করেছে সরকার।
“কিন্তু জমি ও ফ্ল্যাটে বিনিয়োগের সুযোগ বাতিলের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। সেটি নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে; এটুকুই বলতে পারি।”
স্থবিরতা কাটাতে ড্যাপ বাতিল চায় রিহ্যাব
আবাসন ব্যবসায়ে বিশেষ করে প্লট-ফ্ল্যাটের বাজারে সংকটের কারণ হিসেবে ঘুরে ফিরে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ বাতিলের কথা বলেছেন এই খাতের ব্যবসায়ী নেতারা।
তাদের দাবি, বর্তমানে রাজউকের এই ড্যাপ বৈষম্যমূলক। এটি বাতিল করলে বিল্ডিংয়ের প্ল্যান পাস বাড়বে। সেই সঙ্গে বিল্ডিংয়ের আয়তন (ইউনিট-ফ্ল্যাট) বাড়বে, যার প্রভাবে বাজার সচল হতে শুরু করবে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিষদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০২২-২০৩৫ অনুসারে ঢাকা শহরের বেশির ভাগ এলাকায় পূর্বে ভবনের যে আয়তন পাওয়া যেত, এখন তার প্রায় ৬০ শতাংশ পাওয়া যায়। ফলে ডেভেলপাররা নতুন কোনো প্রকল্প গ্রহণ করতে পারছেন না। যারা ব্যক্তি উদ্যোগে বাড়ি করেন, তারাও প্ল্যান পাস করতে আগ্রহী হচ্ছে না। কারণ অনেক এলাকায় আগে যেখানে আটতলা ভবন তৈরি করতে পারতেন, সেখানে পারবেন চার থেকে পাঁচতলা।
একই সঙ্গে ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ ও মাস্টার প্ল্যান (ড্যাপ)-২০১০ বিধি অনুসারে ভবনের নকশা অনুমোদনের দাবি তুলেছেন ব্যবসায়ীরা।
গত ২১ অগাস্ট ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে রিহ্যাব সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, “নানা চড়াই-উৎরাই এবং সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে আবাসন খাত এগিয়ে গেলেও সবচেয়ে বড় সংকট তৈরি হয় ২০২২ সালের ড্যাপের প্রজ্ঞাপন জারির পর। ড্যাপ পাসের পর ঢাকা শহরের উন্নয়ন একেবারেই থমকে গেছে, যার কারণে আবাসন খাতে ব্যাপক মাত্রায় স্থবিরতা নেমে এসেছে।”
তিনি বলেন, “একটি সুন্দর ও সময়োপযোগী ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ কে উপেক্ষা করে ও মাস্টার প্ল্যান-২০১০ কে অন্যায়ভাবে রহিত করা হয়।”
এর ফলে, আগামী এক বছর পর থেকে সংকট আরও মারাত্মক হবে এবং আবাসন শিল্প একেবারে কোমায় চলে যাবে বলে শঙ্কা তার।
সংবাদ সম্মেলন উপস্থিত ছিলেন রিহ্যাবের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও ব্রিক ওয়ার্কস ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী ভূঁইয়া।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে গত সপ্তাহে তিনি বলেন, “ড্যাপের জন্য ব্যবসা প্রায় বন্ধের উপক্রম। কেউ প্ল্যান পাস করছে না এটার জন্য। কারণ প্ল্যান পাস করিয়ে ডেভেলপারের পোষাবে না। বাড়ির মালিকদেরও পোষাবে না। এর ফলে একটা ভ্যাকুয়াম সৃষ্টি হয়েছে এই মার্কেটে। প্রোডাক্ট নাই আমাদের। তার মানে আবার দাম কমে যাবে এটা না, দাম হয়ত আরও বাড়বে। ড্যাপ যতক্ষণ সংশোধন হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত মার্কেট ভালো হবে না।”
রিহ্যাবের সহ-সভাপতি (অর্থ) এবং আরমা রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “মনে করেন কারও ৩ কাঠা জমি আছে। এখন এই তিন কাঠা জমির ওপরে আগে ছয়টা বা সাতটা ফ্ল্যাট আমরা পেতাম। এখন এই জমির ওপরে তিনটা বা চারটা ফ্ল্যাট হবে। ফলে কারও লাভ হচ্ছে না।”
এ প্রসঙ্গে আক্তার প্রোপ্রার্টিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং রিহাবের সহ-সভাপতি মো. আক্তার বিশ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ড্যাপ নিয়ে আমাদের সমস্যা হয়েছে। এটার কারণে আমাদের বৈষম্য হয়েছে। সেটা আমরা সরকারের কাছে তুলে ধরেছি। রাজউক (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) তথা এর সাথে সংশ্লিষ্ট যারা আছে, তাদেরও বলেছি।
“আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, তারাও বুঝতে সক্ষম হয়েছে। তারাও এটা সংস্কারের পক্ষে। তবে কতটুকু সংস্কার বা পরিবর্তন হবে; কত দিনের মধ্যে হবে, সেটা তারা বলেনি।”
এ বিষয়ে জানতে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও মো. আশরাফুল ইসলামকে দুই দিনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
নিবন্ধন ব্যয় আর নির্মাণসামগ্রীর দামের আধিক্য
ফ্ল্যাট কেনাবেচায় ভাটার কারণ হিসেবে আরও কিছু বিষয় সামনে এনেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। তারা বলছেন, নতুন ও পুরনো ফ্ল্যাটের নিবন্ধনের হার একই হওয়ায় বাজার বড় হচ্ছে না।
সেই সঙ্গে নির্মাণসামগ্রীর মূল্য ও শ্রমিক-কারিগরের ব্যয় বাড়ার বিষয়টিও ফ্ল্যাটের দামে প্রভাব রেখেছে। সঙ্গত কারণেই বেচাকেনাতেও প্রভাব পড়েছে।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করে এ শিল্প টিকিয়ে রাখতে নীতি সহায়তা চেয়ে সরকারের কাছে দাবি জানায়।
সংগঠনটির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “গ্যাস, বিদ্যুতের অতিরিক্ত দাম, ডলার সংকট এবং ব্যাংক ঋণের চাপে বিপাকে পড়েছে স্টিল উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলো। উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে বাজারমূল্যের অসঙ্গতিতে ব্যবসা কমেছে বহু উদ্যেক্তার।
“সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ইস্পাত উৎপাদনে খরচ বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। পাশাপাশি গ্যাসের দরও বেড়েছে। ফলে প্রতি টন রডে ২ হাজার টাকা দাম বেড়েছ। কারণ, ইস্পাত খাতের কাঁচামাল, রাসায়নিক ও যন্ত্রাংশের ৮৫ শতাংশই আমদানিনির্ভর।”
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, একই অবস্থা সিমেন্ট, বালু, ইট-পাথরের ক্ষেত্রেও।”
এ প্রসঙ্গে লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, “এই ব্যবসার সাথে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০টি ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ব্যবসা জড়িয়ে আছে। ফলে ফ্ল্যাটের দাম নির্ধারণ বা বাজারে সেগুলোরও প্রভাব আছে।
“যেমন- নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে, লেবার কস্টও বেড়েছে, সব মিলিয়ে এই ব্যবসায় প্রভাব পড়েছে।"
আক্তার প্রোপ্রার্টিজের আক্তার বিশ্বাস বলেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়তিই আছে। সরবরাহও কমেছে। ফলে নির্মাণ কাজের গতিও ধীর হয়েছে।
নিবন্ধন ফি কমিয়ে আনার তাগিদ দিয়ে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, “পার্শ্ববর্তী দেশের মত ফ্ল্যাট নিবন্ধন ফি যদি ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা হয়, তাহলে বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
“বর্তমানে সব মিলিয়ে আমাদের দেশে নিবন্ধন ফি ১৫ শতাংশ হয়ে যায়, আরও অন্যান্য খরচ মিলে এটা ১৮ শতাংশে যায়। ক্রেতাদের জন্য এটাও একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। আমরা এটাও সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি, এটাকে সিংগেল ডিজিটে (৭, ৮ বা ৯ শতাংশে) নামিয়ে আনা যায় কি না। আমাদের পাশ্ববর্তী সব দেশেই এরকম আছে।”
তিনি বলেন, “এখনও আমাদের সেকেন্ডারি মার্কেটের জন্য আমরা কোনো নীতিমালা পাইনি। অন্যান্য দেশে সেকেন্ড হ্যান্ড ফ্ল্যাট যদি কেনেন, রেজিস্ট্রেশন কস্টটা প্রথমবারের তুলনায় পরেরবার হাফেরও নিচে থাকে। যতবারই কেনা-বেচা করেন, একই নিবন্ধন ফি দিতে হয়।”
এত সংকটের পরও আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা সংস্থা স্ট্যাটিস্টা মার্কেট ইনসাইটস এর তথ্যমতে, ২০২৪ সাল শেষে বাংলাদেশের আবাসনের বাজার ২ দশমিক ৭৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ২ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের আবাসিক খাতের এই ব্যবসা বাজারে আধিপত্য বিস্তার করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২৪ থেকে ২০২৮ সাল নাগাদ এই বাজার বার্ষিক ২ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে বাড়ার আভাস। ফলে ২০২৮ সালের মধ্যে দেশের আবাসন খাতের বাজার দাঁড়াবে ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলারে।