যাত্রাপথে রপ্তানি পণ্য চুরি সব অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে: বিজিএমইএ

বিজিএমইএ বলছে, বিভিন্ন দেশে রপ্তানির সময় ২০২২ সালেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কভার্ড ভ্যান থেকে ২০ থেকে ২২টি চুরির ঘটনা ঘটেছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Feb 2023, 04:04 PM
Updated : 7 Feb 2023, 04:04 PM

মালিক-শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পের অর্জিত সুনাম দীর্ঘদিন ধরে মহাসড়কে চলতে থাকা চুরির কারণে ‘ম্লান হতে চলেছে’ বলে সতর্ক করেছেন রপ্তানিকারকরা। 

মঙ্গলবার উত্তরায় বিজিএমইএর স্থায়ী কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “আমাদের শিল্পের সফলতাগুলো ম্লান হয়ে যায়, যখন ক্রেতা রপ্তানি পণ্য হাতে নেওয়ার পর দেখেন যে, কার্টনে রপ্তানি মালামালের পরিবর্তে অন্য জিনিস রয়েছে এবং তারা তা আমাদেরকে জানায়।” 

সম্প্রতি ব্রাজিলের একজন ক্রেতার ক্রয়াদেশের বিপরীতে পাঠানো পোশাকের চালান খুলে দেখা যায়, সেখানে অনেকগুলো প্যাকেটে পোশাক নেই। তার পরিবর্তে ছেঁড়া কাপড়, আবর্জনা আর মাটি দিয়ে ভর্তি। 

ওই ঘটনার পর চুরিতে জড়িত থাকার অভিযোগে এক চক্রের কয়েক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। 

সে সময় গ্রেপ্তার শাহেদ এর আগেও একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং সর্বশেষ গ্রেপ্তার হওয়ার আগে দুটি মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তার সামনে ঝুলছিল। তার বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা রয়েছে বলে বিজিএমইএ জানায়। 

বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “গত দেড় যুগ ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানির সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ২ হাজারের বেশি কাভার্ড ভ্যান থেকে শত শত কোটি টাকার রপ্তানি পণ্য চুরি করেছে একটি চক্র। ২০২২ সালেই প্রায় ২০ থেকে ২২টি চুরির ঘটনা ঘটেছে।” 

ব্রাজিলের ঘটনা যেভাবে সামনে এল 

সম্প্রতি অপ্রচলিত বাজার ব্রাজিলের একজন ক্রেতার সঙ্গে ঘটে যাওয়া চুরির বর্ণনা দেন ফারুক হাসান। তবে এক্ষেত্রে দুই প্রতিষ্ঠানের সুনাম রক্ষার স্বার্থে বাংলাদেশে অংশের পোশাক কারখানা কিংবা ব্রাজিলের ব্র্যান্ডটির নাম তিনি বলেননি। 

ফারুক হাসান বলেন, জানুয়ারির শুরুতে ব্রাজিল থেকে ক্রেতা ভিডিও ফোনকলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারককে জানায় যে বেশিরভাগ কার্টনের ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ পোশাক তারা বুঝে পাননি। এমনকি কিছু কার্টন খালি ছিল। ওই শিপমেন্টে ২৬ হাজারের বেশি পোশাক ছিল। তার মধ্যে ৮ হাজারের মত পোশাক চুরি হয়। 

“এ ঘটনা জানানো হলে ওই চক্রের হোতাসহ ৪ জনকে গ্রেপ্তার এবং যে কাভার্ড ভ্যান থেকে তারা ব্রাজিলের পণ্য চুরি করেছিল, সেই কাভার্ড ভ্যান জব্দ এবং সঙ্গে চালানও সংগ্রহ করে র‌্যাব। চক্রের হোতা শাহেদের বিরুদ্ধে ১৭ থেকে ১৮টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে দুটি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও আছে। 

“ধরা পড়ার পর শাহেদ জানিয়েছে, ক্রেতাদের স্যাম্পল দেখে তারা সেই স্যাম্পলের বাজার দর যাচাই করে। যদি পণ্যের মূল্যমান ১২ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকার মধ্যে হয়, তবেই তারা এ ধরনের চুরি করে।” 

বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “আমরা অবাক হয়ে যাই, যখন দেখি যে, শাহেদের মত একজন চোর কোটি কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হয়েছে। বছরের পর বছর বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। প্রায় বিরামহীনভাবে দুই দশকের বেশি সময় ধরে শাহেদ এই অপরাধ করতে পেরেছে।” 

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দুই বছর আগে বন্দর নগরীতে দায়ের করা ছয়টি মামলায় আট মাস কারাগারে ছিলেন শাহেদ। কিন্তু প্রতিবারই জামিন পাওয়ার পর তিনি পুরানো পেশায় ফিরে আসেন। 

“এই ধরনের অপরাধীরা কিভাবে এত সহজে জামিন পায় সেটি আমাদের প্রশ্ন। এতে করে তারা পরবর্তীতে আরও গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়তে দ্বিধা করে না,” বলেন ফারুক। 

তিনি অভিযোগ করেন, “শুধু শাহেদ নয়, গার্মেন্টস পণ্য চুরির জগতে আরও মাস্টারমাইন্ড, আরও চক্র রয়েছে, যারা একই কাজ করছে। ধরা পড়লেও প্রায় কোনো শাস্তি ভোগ না করে আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসছে। এই অপরাধীদের কারণে আমাদের পোশাক শিল্প বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।” 

চুরি যেভাবে হয় 

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, চক্রগুলো পরিকল্পিতভাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পোশাক শিল্পের আমদানি- রপ্তানির মালামাল কভার্ড ভ্যানের ড্রাইভারের যোগসাজশে চুরি করে আসছে। 

পরিবহন কোম্পানিগুলো যখন রপ্তানি মালামাল পরিবহন করার জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষকে কভার্ড ভ্যান সরবরাহ করে, তখন নিজেদের মালিকানার কাভার্ডভ্যানের সাথে লাইন থেকে ভাড়া করেও কিছু কভার্ড ভ্যান সরবরাহ করে। অধিকাংশ চুরির ঘটনায় দেখা যায়, লাইন থেকে ভাড়া করা গাড়ির ড্রাইভারের যোগসাজশে এ ধরনের চুরি হয়। 

এসব কভার্ডভ্যান পথিমধ্যে ওয়্যারহাউজ, ইটের ভাটা বা গাড়ির গ্যারেজে প্রবেশ করে। সেখানে কৌশলে কাভার্ড ভ্যানের পিছনের লক ঠিক রেখে কব্জা খুলে প্রত্যেক কার্টন থেকে মালামাল সরিয়ে রাখে। তারপর সেখানে সমপরিমাণ ঝুট বা মাটি দিয়ে কার্টনের ওজন ঠিক রেখে চট্টগ্রামের কনটেইনার ডিপোতে পাঠায়। 

দু-এক মাস পর ক্রেতার কাছে কার্টন পৌঁছানোর পর রপ্তানিকারকরা জানতে পারেন, পোশাকের পরিবর্তে ঝুট বা মাটি পাঠানো হয়েছে। এ ধরনের অপরাধ দমনে আইন আরও কঠোর করার দাবি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে। 

পোশাক শিল্পে অগ্রগতি 

সংবাদ সম্মেলনে দেশের পোশাক শিল্প খাতের অগ্রগতির তথ্যও তুলে ধরেন বিজিএমইএ সভাপতি। তিনি বলেন, “দেশের মোট রপ্তানির ৮৩ শতাংশ আসে পোশাক খাত থেকে। আমাদের এখন ১৮৭টি লিড গ্রিন কারখানা রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে ৬৩টি প্ল্যাটিনাম রেটেড এবং ১১০টি গোল্ড রেটেড। বিশ্বের শীর্ষ ১২টি গ্রিন কারখানার ১০টি বাংলাদেশে অবস্থিত। 

“২০২২ সালে আমাদের ৩০টি কারখানা গ্রিন হয়েছে। কোনো একক বছরে এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যক গ্রিন কারখানার সংখ্যা। তাছাড়া এখন বিশ্বের ১০০টি গ্রিন কারখানার মধ্যে শীর্ষ ৫০টিই বাংলাদেশের। এসব ইমেজ কাজে লাগিয়ে আমরা ধীরে ধীরে উচ্চ মূল্যের পোশাক উৎপাদনের দিকে যাচ্ছি।” 

ফারুক হাসান বলেন, বর্তমানে বৈশ্বিক ক্রেতারা পোশাক সোর্সিং করার জন্য বাংলাদেশেকে তাদের পছন্দের শীর্ষে রেখেছেন। পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। ডেনিমের ক্ষেত্রে চীনকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এখন প্রথম অবস্থানে।

Also Read: মহাসড়কে রপ্তানির পোশাক চুরি ঠেকাতে কমিটি

Also Read: ‘সিলেটি সাঈদ’ এবার র‌্যাবের হাতে, রপ্তানির পোশাক চুরি বন্ধ হবে কি?

Also Read: রপ্তানির পোশাক চুরির পেছনে ‘পরিবহনকারীরাই’, ‘হোতা’ সাঈদের বিলাসী জীবন