‘সিলেটি সাঈদ’ এবার র‌্যাবের হাতে, রপ্তানির পোশাক চুরি বন্ধ হবে কি?

বেশ কয়েকবার ধরা পড়লেও ‘বদ্দা’ নামে পরিচিত এই ব্যক্তির চুরির কর্মকাণ্ড ঠেকানো যাচ্ছে না।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Feb 2023, 08:42 PM
Updated : 4 Feb 2023, 08:42 PM

রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকপণ্য চুরির নতুন মামলায় আলোচিত সিলেটি সাঈদকে এবার গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব, যিনি সোয়া বছর আগে একই অভিযোগে ধরা পড়েছিলেন গোয়েন্দা পুলিশের হাতে।

শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে পোশাক পণ্য চুরির অভিযোগে সাঈদসহ চারজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানানো হয়।

পুলিশের এ বিশেষ ইউনিটের ভাষ্য, দেড় যুগ ধরে প্রায় দুই সহস্রাধিক কভার্ড ভ্যান থেকে শত শত কোটি টাকার রপ্তানিযোগ্য পোশাক পণ্য চুরির সংঘবদ্ধ চক্রের ‘গডফাদার’ হচ্ছেন সাঈদ।

এর আগে গাজীপুরের একটি কারখানার রপ্তানি পোশাক চুরির অভিযোগে ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করেছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তখন ডিবির তরফে সাঈদের ৫০০ শতাধিক কভার্ড ভ্যানের মালিকানা, চুরির বিশাল নেটওয়ার্ক ও বিলাসী জীবনের কথা বলা হয়েছিল।

এও বলা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চুরির ২৪টি মামলার হদিস মিলেছে, যেগুলোর মধ্যে ছয়টিতে গ্রেপ্তার হয়ে তিনি কারাভোগও করেছেন।

বারবার গ্রেপ্তার হলেও পোশাক পণ্য চুরির একটি চক্রের নেতৃত্ব দেওয়া সাঈদের কর্মকাণ্ড থেমে থাকছে না, তাহলে তিনি কি অপ্রতিরোধ্য?

এ প্রশ্নের উত্তরে সোয়া বছর আগের অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া ডিবির অতিরিক্ত উপ কমিশনার শাহাদাৎ হোসেন বলছেন, ৫২ বছর বয়সী সাঈদ গত ২০ বছর ধরে পরিবহনকর্মী ও ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক চুরি করছেন। বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বের হয়ে একই কাজে যুক্ত হন আবার।

“তার চক্রের সদস্যরা ছড়িয়ে আছেন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত। তখন সাঈদ আনুমানিক পাঁচ হাজার চুরির ঘটনার সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য দেন। যার বাজারমূল্য হাজার কোটি টাকা হতে পারে। চুরির টাকায় তিনি নামে-বেনামে কয়েকশ কভার্ড ভ্যান নামিয়েছেন, যেগুলো তার নেটওয়ার্কের মূল চালিকাশক্তি।”

পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে সাঈদ চক্রের নেটওয়ার্কভুক্ত গুদাম।

ঢাকার ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, নারায়ণগঞ্জের মদনপুর, কুমিল্লার দাউদকান্দি, চান্দিনা, ফেনী, চট্টগ্রামের মীরসরাই, সীতাকুন্ড ও ভাটিয়ারীর এসব গুদামে কাভার্ড ভ্যান ঢুকিয়ে রপ্তানি পণ্য চুরি করেছে চক্রটি।

পুলিশ কর্মকর্তা ও ট্রাক মালিকদের বর্ণনায়, রপ্তানি পণ্য বহনকারী প্রায় প্রতিটি কাভার্ড ভ্যানে জিপিএস ট্র্যাকার থাকে, যার ফলে গাড়িটির অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।

কিন্তু চক্রের সদস্যরা মহাসড়কের পাশের গুদামে গাড়ি ঢোকায়। এতে জিপিএস ট্র্যাকারে গাড়ির অবস্থান মহাসড়কের উপরেই দেখায়। আর গাড়ি থামানোর কারণ হিসেবে খাওয়া বা বাথরুমের অজুহাত দেখায় চালকরা।

এসব কাভার্ড ভ্যানের দরজা সিলগালা করা থাকলেও চক্রের সদস্যরা গাড়ির উপরের অংশের স্টিলের সিট সরিয়ে মালামালের কার্টন বের করেন। তারা আস্ত কার্টন না সরিয়ে প্রতি কার্টন থেকে অল্প কিছু করে রপ্তানি পণ্য তারা সরিয়ে নেন, যাতে বন্দরে কার্টনের হিসেবের কোনো গোলমাল না হয়।

কার্টন খুলে সেগুলো আবার আগের মতো করে প্যাক করার দক্ষ লোকও রয়েছে তাদের দলে। চুরির পণ্য আবার কেনে পোশাক খাতের লোকজনই, কিছু বায়িং হাউজ এর সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন।

Also Read: রপ্তানির পোশাক চুরির পেছনে ‘পরিবহনকারীরাই’, ‘হোতা’ সাঈদের বিলাসী জীবন

এসব কাভার্ড ভ্যানের দরজা সিলগালা করা থাকলেও চক্রের সদস্যরা গাড়ির উপরের অংশের স্টিলের সিট সরিয়ে মালামালের কার্টন বের করেন। তারা আস্ত কার্টন না সরিয়ে প্রতি কার্টন থেকে অল্প কিছু করে রপ্তানি পণ্য তারা সরিয়ে নেন, যাতে বন্দরে কার্টনের হিসেবের কোনো গোলমাল না হয়।

কার্টন খুলে সেগুলো আবার আগের মতো করে প্যাক করার দক্ষ লোকও রয়েছে তাদের দলে। চুরির পণ্য আবার কেনে পোশাক খাতের লোকজনই, কিছু বায়িং হাউজ এর সঙ্গে জড়িত বলে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন।

ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রপ্তানি পোশাক চুরির পাঁচটি গ্রুপের সন্ধান পাওয়া যায়। এই পাঁচটি গ্রুপই কোনো না কোনোভাবে সাঈদের সঙ্গে যুক্ত।

এই গ্রুপগুলোর মধ্যে রয়েছে- রিপন-কামাল গ্রুপ, মাসুদ-নাজিম, লেডি জাহাঙ্গীর-সালাউদ্দীন, সাইফুল চৌধুরী-ইব্রাহিম-মহিউদ্দীন গ্রুপ। এর বাইরে বড় একটি গ্রুপ আছে, যেটি চালান রাসেল নামের এক ব্যক্তি। তার গ্রুপে সাঈদ (চাঁদপুর), স্বপন, নূর ইসলাম, সাজ্জাদ, সবুজ, বারেকসহ বেশ কয়েকজন রয়েছেন।

ডিবির কর্মকর্তা শাহাদাতের ভাষ্য, এদের নেটওয়ার্কের শিকড় বলা যায় চট্টগ্রামে। সেখানে ভালোভাবে হানা দিতে হবে।

এবার র‌্যাবের হাতে সাঈদ

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, র‌্যাব ২০২১ সালের অগাস্ট থেকে এ পর্যন্ত রপ্তানি পণ্য চুরির কয়েকটি চক্রের হোতাসহ প্রায় অর্ধশতাধিক অপরাধীকে গ্রেপ্তার এবং প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার পোশাক পণ্য উদ্ধার করেছে।

কিন্তু তাতে কি চুরি বন্ধ হয়েছে? র‌্যাবেরই ভাষ্য, চুরি চলছে।

সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির কর্মকর্তা মঈন বলেন, গাজীপুরের কোনাবাড়ীর একটি তৈরি পোশাক কোম্পানি গত বছরের ২৯ অক্টোবর এক চালানে ৮৯৮ কার্টন সোয়েটার পাঠায় ব্রাজিলে। ৬ জানুয়ারি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান একটি ভিডিও পাঠায় কারখানা কর্তৃপক্ষকে, যাতে দেখা যায়- প্রতিটি কার্টন থেকে অনেকগুলো করে পণ্য নেই। অনেকগুলো কার্টন একেবারেই খালি।

ওই ভিডিওতে দেখা যায়, কার্টনের গায়ে লেখা ১০টি করে পণ্য রয়েছে তাতে। ইনট্যাক্ট কার্টন কাটার পর দেখা যাচ্ছে তাতে তিন বা চারটি করে পণ্য রয়েছে। ওই ঘটনায় কারখানা কর্তৃপক্ষ গাজীপুরের গাছা থানায় মামলা করে।

ওই মামলায় মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ ও ঢাকার আশপাশে অভিযান চালিয়ে ‘হোতা’ সাঈদ ওরফে বদ্দা, ইমারত হোসেন সজল, শাহজাহান ওরফে রাসেল ওরফে আরিফ ও হৃদয়কে চুরি যাওয়া পণ্যসহ গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

এদের মধ্যে ইমারত হোসেন কম দামে চুরির পণ্য কিনে থাকেন। শাহজাহান ও হৃদয় চুরি যাওয়া কাভার্ড ভ্যানটির চালক ও হেলপার। তাদের কাছ থেকে চুরি যাওয়া পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত কাভার্ডভ্যানটিও উদ্ধার করা হয়েছে।

র‌্যাবের পরিচালক মঈন বলছেন, “এই গার্মেন্টস পণ্য চুরি জগতের মাস্টারমাইন্ড, মূলহোতা ও নির্দেশদাতা হচ্ছেন সাঈদ। মূলত তার ছত্রছায়ায় ও সম্মতিতে বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ গার্মেন্টস পণ্য চুরির ঘটনাগুলো ঘটছে। এই চক্রে রয়েছে ড্রাইভার, হেলপার, গোডাউন মালিক, গোডাউন এলাকার আশ্রয়দাতা, দক্ষ কুলি সর্দারসহ একদল লেবার।

“একেকটি চুরি থেকে কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভার ৩০ হাজার, হেলপার ২০ হাজার, গোডাউনের মালিক ৫০ হাজার, গোডাউন এলাকার শেলটার পার্টি ৬০ হাজার, কার্টুন প্যাকেজিং এক্সপার্ট ১০ হাজার এবং অন্যান্য লেবারকে দুই থেকে তিন হাজার টাকা দেওয়া হতো।”

ব্রাজিলের পণ্য যেভাবে ডেমরায় নামে

র‌্যাবের ভাষ্য, গত ২৯ অক্টোবর যে কাভার্ড ভ্যানে গাজীপুর থেকে ব্রাজিলের উদ্দেশ্যে পণ্য পাঠানো হয়, সেই গাড়ির চালক শাহজাহানকে স্যাম্পল হিসেবে কিছু সোয়েটার দিয়েছিল কারখানা কর্তৃপক্ষ। শাহজাহান সেই সোয়েটারের ছবি তুলে চোর চক্রের হোতা সাঈদের কাছে পাঠান।

সাঈদ স্যাম্পলের ছবি পাঠান সহযোগী তাওহীদুল ওরফে বড় কাওছারের কাছে। কাওছার ড্রাইভারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ২৯ অক্টোবর গভীর রাতে ঢাকার ডেমরার মিরপাড়ার আয়েশা প্যাকেজিং ভবনের গোডাউনে গাড়িটি নিয়ে যায়।

সেখানে প্যাকেজিংয়ে দক্ষ কুলি সর্দার নাজিম শ্রমিকদের নিয়ে কাভার্ড ভ্যান থেকে কার্টন নামিয়ে পণ্য সরায়। এরপর প্যাকিং করে কার্টন ফের তোলা হয় কাভার্ড ভ্যানে। এই নাজিমকে রপ্তানি পণ্য চুরির আরেক মামলায় গত ২৪ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।