রপ্তানির পোশাক চুরির পেছনে ‘পরিবহনকারীরাই’, ‘হোতা’ সাঈদের বিলাসী জীবন

রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকপণ্য চুরি নিয়ে দীর্ঘদিন থেকেই রীতিমত গলদঘর্ম হচ্ছিলেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। এ নিয়ে পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ দফায় দফায় পুলিশ ও ট্রাক মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Sept 2021, 06:20 PM
Updated : 20 Sept 2021, 06:23 PM

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় সম্প্রতি দায়ের হওয়া দুটি পোশাক কারখানার মালামাল চুরির মামলা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ১২ জনকে। এদের প্রায় সবাই ট্রাক চালক, মধ্যস্থতাকারী, ট্রাক মালিক ও পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত।

পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে চুরির অনেক কিছুই; সঙ্গে রপ্তানির পোশাক পরিবহনকালে চুরির সঙ্গে জড়িত এক নেটওয়ার্কের, যেটির নেতৃত্বে থাকা এক চোরের অঢেল বিত্ত ও বিলাসী জীবনের।

সোমবার গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানাতে সংবাদ সম্মেলন করে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার জানান, দীর্ঘদিন ধরে পণ্য পরিবহনে যুক্ত ট্রাক ও কভার্ড ভ্যান চালক-শ্রমিক, ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির একটি সংঘবদ্ধ চক্রই মূলত পোশাক চুরিতে যুক্ত।

পুলিশের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন মজুমদার বলছেন, “ট্রাক ড্রাইভার বা স্টাফ যুক্ত না থাকলে এভাবে মাল চুরি সম্ভব নয়। আমি আমার ড্রাইভারদের বলছি কেউ এরকম করলে সরাসরি পুলিশে ধরিয়ে দেব।

“বাংলাদেশে গার্মেন্টস না থাকলে বহু লোককে না খেয়ে থাকতে হবে- এই বাস্তবতা ট্রাক শ্রমিকদের বুঝতে হবে।“

প্রবীণ ট্রাক ব্যবসায়ী তোফাজ্জল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কোনো চালক, শ্রমিক বা ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির লোক যদি এই ধরনের চুরির সঙ্গে জড়িত হন তবে তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া কোনো উপায় নেই।

“দেখা যায় পোশাকপণ্য চুরির পর সেগুলো টাকার বিনিময়ে উদ্ধারের জন্য কিছু ট্রাক বন্দোবস্তকারী বা চালক মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসেন। চুরির মাল উদ্ধারের ওই মধ্যস্থকারীদের ধরলেই পুরো চক্রের সন্ধান পাওয়া যাবে।”

পুলিশের ঊধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকেও চুরির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তারা শক্ত অবস্থানে যাওয়ার কথা তুলে ধরেছেন বলে জানান তিনি।

তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক ও জনসংযোগ কমিটির চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন রুবেল এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, চলতি বছরের সাত মাসে মহাসড়কে ট্রাক ছিনতাইয়ের ২৪টি ঘটনা তাদের কাছে অভিযোগ আকারে এসেছে। এসব ঘটনায় ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৫০৩ পিস কাপড় খোয়া গেছে। টাকার অংকে এর মূল্য প্রায় আট কোটি টাকা। এগুলোর অধিকাংশই ঘটেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে।

সাম্প্রতিক সময়ে চুরি বেড়ে যাওয়ায় জুলাই মাসে চুরি ঠেকাতে নীতিমালা প্রস্তুত করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি কমিটি করে দিয়েছে। ওই কমিটিতে কভার্ড ভ্যান অ্যাসোসিয়েশন, ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, ডিবি, সিআই ও হাইওয়ে পুলিশ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

যেভাবে তৈরি পোশাক চুরি হয়

আশুলিয়ার জয়ন্তী নিটওয়্যারের  ব্যবস্থাপক বুলবুল আহমেদ পোশাক চুরির অভিযোগে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি মামলা করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেছেন, গত ১১ মে তেজগাঁওয়ের বেলায়েত ট্রান্সপোর্টের মাধ্যমে বন্দরে পাঠাতে তার প্রতিষ্ঠান ৩৭৪ কার্টনে মোট ২৮ হাজার ৮২০ পিস কাপড় বিদেশে (ইংল্যান্ডে) রপ্তানির জন্য কাভার্ড ভ্যানে তুলে দেয়। ওই চালান বিদেশে পৌঁছানোর পর ক্রেতা কোম্পানি অভিযোগ করে প্রতিটি কার্টনে ২০ থেকে ৪০ পিস পোশাক কম পাওয়া গেছে।

ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এজন্য জয়ন্তী নিটওয়্যারকে ২৮ হাজার ৯০৮ ডলার জরিমানা করে।

মামলায় ট্রাক চালক এমরান ও তার সহযোগী হিসেবে মহিউদ্দীন, ইব্রাহিম, মোবারক, রিপন ও সাঈদসহ অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করা হয়।

ওই মামলায় গ্রেপ্তার চালক এমরান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এতে তিনি উল্লেখ করেছেন, গত ১১ মে পরিবহন মধ্যস্থতাকারী ইব্রাহিম মিয়া তাকে একটি পোশাক কারখানা থেকে পণ্য নিয়ে চট্টগ্রামে নেওয়ার জন্য ভাড়া নেয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনি পোশাক লোড করে রওনা দিলে ইব্রাহিম তাকে ফোন করে মাতুয়াইল এলাকার একটি গুদামে আসতে বলেন।

মাতুয়াইলে গিয়ে এমরান দেখেন ইব্রাহিম, মোবারকসহ কয়েকজন শ্রমিক দাঁড়িয়ে আছেন। ইব্রাহিম গুদামের ভেতর ট্রাক ঢুকিয়ে এমরানকে খেতে পাঠান। এমরান ফিরে এসে দেখেন ট্রাক থেকে কিছু মালামাল গুদামের মেঝেতে নামানো হয়েছে।

পুলিশ ওই মামলায় এখন পর্যন্ত এমরান, ইব্রাহিম, মোবারক, মহিউদ্দীন ও সাঈদকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। এদের মধ্যে প্রথম চারজন গত কয়েকদিনে গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারা হেফাজতে রয়েছেন।

সর্বশেষ এই মামলায় গত ১৯ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ সাঈদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাকে হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে আবেদন করেছে ডিবি।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাতেই গত ১৭ সেপ্টেম্বর রপ্তানির উদ্দেশ্যে পাঠানো পোশাক চুরির অভিযোগে মামলা করেন গাজীপুরের নে টওয়ার্ক ক্লোথিং এর হেড অব কমার্শিয়াল মো. মনিরুজ্জামান।

মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, গত ১৫ সেপ্টেম্বর তেজগাঁওয়ের এন এন ট্রেডিং এবং ট্রান্সপোর্টের মাধ্যমে একটি কাভার্ড ভ্যানে এক হাজার ৪৩১টি কার্টনে মোট ১৭ হাজার ১৫২ পিস কাপড় বিদেশে (স্পেনে) রপ্তানির জন্য চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়।

গাড়িটি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর পর তাতে পাঁচ হাজার পিস কাপড় কম পাওয়া যায়। মামলায় উল্লেখ করা হয়, চালক রুবেলের সহায়তায় ওই পোশাকগুলো তেজগাঁও এলাকাতেই চুরি করা হয়।

ওই মামলার তদন্তে নেমে ডিবির তেজগাঁও জোনাল টিমের সদস্যরা ১৮ সেপ্টেম্বর উত্তরায় একটি মিনি কাভার্ড ভ্যান থেকে চুরি যাওয়া তিন হাজার ৩০০ পিস পোশাকসহ তিন জনকে গ্রেপ্তার করে। এরা হলেন- গাড়ি চালক রাজ্জাক, ইউসুপ ও মইনুল।

এরপর তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কুমিল্লার বুড়িচংয়ের নিমশার পেট্রোলপাম্প সংলগ্ন এলাকা থেকে আরেকটি মিনি কাভার্ডভ্যান থেকে চুরি যাওয়া এক হাজার ৩০০ পিস পোশাক উদ্ধার করে।

এসময় গ্রেপ্তার করা হয় চালক চালক মো. দুলাল ও আল আমিনকে। এদের মধ্যে আল আমিন বুড়িচং এলাকার একটি হাইওয়ে হোটেলের মালিক। বাকিরা পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত।

চুরির পণ্য যায় কোথায়

পুলিশ বলছে, এসব চোরাই পোশাকের বড় বাজার রয়েছে দেশে ও বিদেশে। চুরিতে জড়িত গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের নিয়ে সোমবার ঢাকা মহানগর পুলিশ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার।

চোরাই গার্মেন্টস পণ্য কোথায় বিক্রি ও কারা ক্রয় করছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চোরাই পণ্যের ক্রেতা হিসেবে বেশ কয়েকজনের নাম জেনেছে ডিবি। তদন্তের চলমান থাকায় তাদের নাম এখনই প্রকাশ করা হচ্ছে না।

“তবে চুরির পর পণ্যগুলো দেশের ছোট কিছু বায়িং হাউসের গুদামে যাচ্ছে। হাউসগুলো তুলনামূলক কমদামে বিদেশি ছোট ক্রেতাদের কাছে সেগুলো আবার বিক্রি করে দিচ্ছে। এ ছাড়া দেশের বাজারেও এগুলোর চাহিদা রয়েছে। সেখানেও যাচ্ছে এসব পণ্য।“

এছাড়া বিভিন্ন সময় পোশাক রপ্তানিকারকরা অভিযোগ করেন, জাহাজীকরণের জন্য পাঠানো পোশাক আটকে মুক্তিপণ চাওয়া হচ্ছে।

চুরির ‘হোতা’ সাঈদের বিলাসী জীবন

ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। পরিপাটি চুল। দেখতেও বেশ। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া এই ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ সাঈদ।

পুলিশ বলছে, সাঈদ চুরির বিশাল একটি নেটওয়ার্কের নেতৃত্বে আছেন। আনুমানিক ৫৫ বছরের এই ব্যক্তি গত ২০ বছর ধরে পরিবহনকর্মী ও ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক চুরি করছেন।

তার চক্রের সদস্যরা ছড়িয়ে আছেন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত। এ পর্যন্ত আনুমানিক পাঁচ হাজার চুরির ঘটনায় নিজের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তিনি তথ্য দিয়েছেন বলে দাবি পুলিশের।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাঈদ পুলিশকে জানিয়েছেন, তিনি যে পরিমাণ চুরি করেছেন তার আর্থিক মূল্য প্রায় হাজার কোটি টাকা।

সাঈদের দুই স্ত্রীর একজন থাকেন লন্ডনে আরেকজন মৌলভীবাজারে। চুরির টাকা দিয়ে এক স্ত্রীকে লন্ডনে অভিজাত এলাকায় বাড়ি করে দিয়েছেন।

অপরজনকে মৌলভীবাজারে বাড়ি করে দিয়েছনে। সেখানে তার দুটি বাড়ির সন্ধান পাওয়া যায়।

এছাড়া তিনি ইটের ভাটা, ট্রাক ও সিএনজির মালিক হয়েছেন।

ঢাকা মহানগর ডিবির তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহাদাৎ হোসেন সুমা জানান, সিলেটি সাঈদের বিরুদ্ধে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চুরির ২৪টি মামলার খোঁজ পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে ছয়টি মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হন।

কিছুদিন কারা ভোগের পর আবার জামিনে বের হয়ে একই কাজে যুক্ত হন সাঈদ। পরিবহনকর্মীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে রপ্তানমুখী পোশাক পরিবহনকারী কাভার্ড ভ্যানগুলো থেকে পোশাক বের করে নেন। এরপর স্থানীয় বাজারে সেগুলো বিক্রি হয়।

পুলিশ কর্মকর্তা শাহাদাৎ বলেন, “চুরির টাকায় সাঈদ পাঁচ শতাধিক ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানে বিনিয়োগ করেছেন। তার এসব যানবাহন পোশাক পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির সঙ্গেও তার যোগসাজশ রয়েছে। সব মিলিয়ে চুরির বিশাল নেটওয়ার্ক বানিয়ে বসেছেন তিনি।“

মাথায় এত মামলার বোঝা নিয়েও সাঈদ কী করে চুরি চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জানতে চাইলে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার বলেন, বিভিন্ন মামলায় সাঈদ বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। সর্বশেষ একটি মামলায় তিনি আট মাস জেলে থেকে বেরিয়ে এসে আবার পোশাক পণ্য চোরাই কারবারে জড়িয়েছেন।