“যদিও এর প্রভাব অনুমান করা কঠিন, তবে আমরা বিশ্বাস করি যে কোনও প্রযুক্তি উপখাতই ক্ষতির বাইরে থাকবে না,” বলছে মুডিস রেটিং।
Published : 10 Apr 2025, 11:43 PM
প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের অভিষেক ঘিরে যে তহবিল গঠন করা হয়েছিল, তাতে শরিক হয়েছিলেন সিলিকন ভ্যালির অনেক শীর্ষ নির্বাহী। ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারের তহবিল বাড়াতেও ভূমিকা রেখেছিলেন অনেকে।
তারা ট্রাম্পের মার-এ-লাগো রিজোর্টে যেমন গিয়েছেন, তেমনি প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠানে বসেছেন সামনের সারিতে। কিন্তু প্রেসিডেন্সির প্রথম তিন মাসে ট্রাম্প যেসব নীতি নিয়েছেন, তাতে সেই দাতারাও ব্যবসায়িকভাবে হারাচ্ছেন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার।
সিএনএন লিখেছে, মেটা সিইও মার্ক জাকারবার্গ, অ্যাপল সিইও টিম কুক, গুগল সিইও সুন্দর পিচাই, টেসলা সিইও ইলন মাস্ক ও অ্যামাজন প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোসের কোম্পানি এ বছরের শুরু থেকে প্রায় ১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের বাজার মূলধন হারিয়েছে।
ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্ক স্থগিত করার প্রতিক্রিয়ায় বুধবার বাজার ঘুরে দাঁড়ালেও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো তেমন সুবিধা করতে পারেনি। তাতে প্রযুক্তি খাতের ওই টাইকুনদের ব্যক্তিগত সম্পদও সঙ্কুচিত হয়েছে।
সিএনএন এক প্রতিবেদনে লিখেছে, শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ট্রাম্পের মাধ্যমে এমন কিছু নীতি আশা করছিল- যাতে তারা ব্যবসায় সুবিধা নিতে পারে। যেমন অ্যান্টিট্রাস্ট মামলার চাপ কিংবা সরকারি বিধিবিধানের ঝামেলা কমবে বলে তারা আশা করেছিল।
তারা ধরেই নিয়েছিলেন, প্রযুক্তি শিল্পে মার্কিন অবস্থান এগিয়ে নিতে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পোক্ত করতে আগ্রহী হবেন ট্রাম্প।
কিন্তু ট্রাম্পের শুল্ক পরিকল্পনা ঘিরে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তাতে সিলিকন ভ্যালিকেও বেশ কয়েকটি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর লোকসান তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ট্রাম্পের শুল্ক পরিকল্পনায় ব্যাপকভাবে নিশানা করা হয়েছে এশিয়ার সরবরাহ ব্যবস্থাকে, যেখানে বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল সংগ্রহ, সস্তায় উৎপাদনের পাশাপাশি অ্যাসেম্বিলিং করে থাকে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো।
বেশিরভাগ বাণিজ্যিক অংশীদার দেশের ওপর আরোপ করা বাড়তি শুল্ক ট্রাম্প স্থগিত করলেও চীনের শুল্ক ১০৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে করেছেন ১২৫ শতাংশ।
সিএনএন লিখেছে, শুল্ক যেখানে প্রযুক্তি জায়ান্টদের জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, সেখানে ভোক্তা ও বিজ্ঞাপনদাতারা খরচে লাগাম দিলে তার প্রভাবও গুরুতর হয়ে দেখা দেবে।
ইউবিএসের রোববারের প্রতিবেদনের বরাতে সিএনএন লিখেছে, দীর্ঘমেয়াদী সম্পূরক শুল্কের কারণে এবং এর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা প্রযুক্তি খাতের আয় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে বলে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন।
এআইয়ের বদৌলতে ফুলেফেঁপে ওঠা কোম্পানিগুলোর আয়ে যে স্থিতিশীলতা এসেছিল, সেই প্রবণতায় বড় পরিবর্তন আসবে। শেয়ার প্রতি লাভের হিসাবেও টান পড়বে।
ওয়েডবুশ সিকিউরিটিজের বিশ্লেষক ড্যান আইভস সোমবার ট্রাম্পের শুল্ক নীতিকে প্রযুক্তি খাতের জন্য ‘আর্মাগেডন’ [নিউ টেস্টামেন্টে উল্লেখিত বিচার দিবসের আগে ভালো ও মন্দের মধ্যে শেষ ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ] হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
তিনি বলেছেন, এ নীতি প্রযুক্তি খাতের বিনিয়োগ পরিস্থিতিকে গত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন করে তুলেছে।
সিএনএন বলছে, তারা মেটা, অ্যাপল, অ্যামাজন, টেসলা এবং ইলন মাস্কের একজন প্রতিনিধির মন্তব্য চেয়েছে, কিন্তু তারা সাড়া দেননি। গুগল এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
সবচেয়ে নাটকীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন ইলন মাস্ক নিজে, যিনি ট্রাম্পের অন্যতম শীর্ষ সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন গত কয়েক মাসে।
ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার্স ইনডেক্সের ৮ এপ্রিলের তথ্য অনুযায়ী, ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনে অন্তত ২৯০ কোটি ডলারের অনুদান দেওয়া কিংবা সরকারি দক্ষতা বিভাগের দায়িত্ব নিয়েও ইলন মাস্কের সম্পদ ২০২৫ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কমেছে ১৪৩ বিলিয়ন ডলার।
মূলত টেসলার শেয়ারের দরপতন, সরকারে মাস্কের বিতর্কিত কাজ ও ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার কারণে এ দশা তৈরি হয়েছে এবং এখন হাজির হয়েছে সম্পূরক শুল্ক।
চলতি বছরের শুরু থেকে বুধবার পর্যন্ত, টেসলার শেয়ারের দাম কমেছে ২৮ শতাংশ, বাজার মূলধন কমেছে ৩৭৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। তার মানে নির্বাচন পরবর্তী লাভের অনেকাংশ খোয়া গেছে। মাস্ক বলেছেন, নতুন শুল্ক নীতি তার কোম্পানিগুলোর মধ্যে টেসলার ওপর 'উল্লেখযোগ্য' প্রভাব ফেলতে পারে।
সিএনএন লিখেছে, যদিও ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে মাস্ক আলোচনায় রয়েছেন, তবে তিনিই একমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত প্রযুক্তি ব্যবসায়ী নন।
কমেছে সম্পদ ও ভ্যালুয়েশন
ট্রাম্পের অভিষেক তহবিলে শুরুতে যেসব কোম্পানি এক মিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার একটি মেটা। ট্রাম্পের দায়িত্ব গ্রহণের আগে ও পরে তার সঙ্গে নীতিগত অগ্রাধিকার নিয়ে আলোচনা করেন জাকারবার্গ।
তিনি তার ব্যবসায় বেশ কয়েকটি ট্রাম্প-বান্ধব পরিবর্তনও আনেন; তার মধ্যে রয়েছে- একজন রিপাবলিকানকে কোম্পানির শীর্ষ নীতিনির্ধারণী পদে আনা, পেশাদার ফ্যাক্ট-চেকারদের ছাঁটাই করা এবং ট্রাম্পের সহযোগী এবং ইউএফসি বস ডানা হোয়াইটকে মেটার পরিচালনা পর্ষদে আনা।
২০২৫ সালের শুরু থেকে জাকারবার্গের মোট সম্পদের পরিমাণ কমেছে ২৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। মেটার শেয়ারের দাম কমেছে প্রায় ২ দশমিক ২৫ শতাংশ, কোম্পানির ভ্যালুয়েশন কমেছে ৩৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন।
সিএনএন লিখেছে, গত নভেম্বরে ট্রাম্পকে তার নির্বাচনী জয়ের জন্য অভিনন্দন জানাতে উদগ্রীব ছিলেন বেজোস। তিনি ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফেরাকে ‘অসাধারণ রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন’ বলে বর্ণনা করেছিলেন এবং অ্যামাজন ট্রাম্পের অভিষেক তহবিলে ১ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছিল।
বেজোস মালিকানাধীন ওয়াশিংটন পোস্টে ২০২৪ সালের নির্বাচনে কোনো প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে সমর্থন না করার ‘বিতর্কিত’ সিদ্ধান্তের পেছনেও ছিলেন অ্যামাজন কর্ণধার।
ব্লুমবার্গের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বেজোসের মোট সম্পদের পরিমাণ কমেছে ৪ হাজার ৭২০ কোটি ডলার। অ্যামাজনের শেয়ার ১৩ শতাংশ দর হারিয়েছে, কোম্পানির ভ্যালুয়েশন কমেছে ৩১৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার।
গুগল ট্রাম্পের অভিষেক তহবিলে দেয় ১ মিলিয়ন ডলার। সেই অনুষ্ঠান ইউটিউবে সরাসরি সম্প্রচার করে। ট্রাম্পের নির্বাচনের পরের সপ্তাহগুলোতে মার-এ-লাগো সফরকারী সিইও বহরে ছিলেন পিচাই।
কিন্তু গুগলের শেয়ারের দাম এখন পর্যন্ত কমেছে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ; বছরের শুরু থেকে কোম্পানির ভ্যালুয়েশন কমেছে ৩৮৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।
অ্যাক্সিওস জানিয়েছে, গত জানুয়ারিতে ট্রাম্পের অভিষেক কমিটিতে ব্যক্তিগতভাবে ১০ লাখ ডলার অনুদান দেন অ্যাপলের কুক। তিনি নির্বাচনের পর শুল্ক ও ইউরোপীয় প্রযুক্তি নীতিমালা নিয়ে মার্চ-এ-লাগোতে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন।
চলতি বছরের শুরুতে অ্যাপল ঘোষণা দেয়, আগামী চার বছরে তারা তাদের মার্কিন স্থাপনাগুলোতে ৫০ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। ওই ঘোষণা ট্রাম্পকে রাজনৈতিক জয় এনে দেয়। তিনি বলেছিলেন, অ্যাপলের এই ধরনের পদক্ষেপ তার ওপর আস্থারই প্রকাশ।
চীন, ভিয়েতনাম ও ভারতের মত বিদেশি বাজারে নিজেদের অনেক পণ্য উৎপাদন করা অ্যাপল এখন ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণে বড় ধাক্কা খাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চলতি বছরের শুরু থেকে অ্যাপলের শেয়ারের দাম ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে, বাজার মূলধন কমেছে ৬৮৪ বিলিয়ন কোটি ডলার।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে অনেক বড় প্রযুক্তি কোম্পানি শুল্ক ছাড়ের জন্য তদবির করেছিল। তবে এবার পরিস্থিতি যে তেমন অনুকূল নয়, তা সাম্প্রতিক এক গবেষণা নোটে উল্লেখ করেছেন মুডি’স রেটিংসের বিশ্লেষকরা।
তারা লিখেছেন, “যদিও এর প্রভাব অনুমান করা কঠিন, তবে আমরা বিশ্বাস করি যে কোনো প্রযুক্তি উপখাতই ক্ষতির বাইরে থাকবে না।”