আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্বপালনের সময়কার ব্যয় মেটাতে নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রায় হাজার কোটি টাকা চেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী।
এমন চাহিদার বিপরীতে কতদিনের জন্য নির্বাচনী এলাকায় নিরাপত্তা রক্ষায় বাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন থাকবেন সেটি বিবেচনা করে বরাবরের মতো অর্থ বরাদ্দ দেবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত ৩০ অক্টোবর আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক সভা হয়, যেখানে পুলিশ, আনসার, র্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ড সম্ভাব্য ব্যয় জানিয়ে তাদের চাহিদা জানিয়েছে। তফসিল ঘোষণার পর সশস্ত্রবাহিনী চাহিদা জানালে সে অনুযায়ী অর্থ ছাড় করা হবে বলে জানিয়েছেন ইসি কর্মকর্তারা।
তারা জানান, পুলিশ ৪৩০ কোটি, আনসার ও ভিডিপি ৩৬৬ কোটি টাকা, বিজিবি ১৪৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, র্যাব ৫০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ও কোস্টগার্ড চেয়েছে ৭৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা চেয়েছে।
কমিশনের নির্বাচন পরিচালনা ব্যয়ের খাত থেকে এসব ব্যয় মেটানো হবে। প্রয়োজনে সরকারের কাছ থেকে নতুন অর্থ বরাদ্দ চাওয়ার সুযোগ রয়েছে ইসির।
রোববার ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কতদিনের জন্য মোতায়েন থাকবে নির্বাচনী এলাকায় তা কমিশন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। কেন্দ্রের নিরাপত্তায় কত সংখ্যক সদস্য থাকবেন তাও চূড়ান্ত হবে। সেই সঙ্গে স্ট্রাইকিং ও মোবাইল ফোর্স রয়েছে। ডেপ্লয়মেন্ট ও সংখ্যা বিবেচনায় করেই চাহিদার বিপরীতে অর্থ ছাড় হবে। গত সংসদ নির্বাচনে যেমন হয়েছে, এবারও প্রায় কাছাকাছি ব্যয় হতে পারে।”
আগামী কয়েকদিনের মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোটের তারিখ থাকতে পারে বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন।
এর আগে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের ব্যয়ের ফর্দ তৈরি করে ইসি। এতে সর্বমোট ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ের একটি হিসাব কষা হয়। এর দুই-তৃতীয়াংশই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেছনে ব্যয় হবে বলে হিসাবে দেখা যায়।
ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার জানান, ভোটার সংখ্যা বাড়ায় কেন্দ্রও বেড়েছে, সেক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যয়ও বাড়বে। নির্বাচন পরিচালনা খাতে যেমন ব্যয় তুলনামুলক বেশি হচ্ছে, নিরাপত্তা ব্যয়ও তাই বাড়বে। আইনশৃঙ্খলা খাতের ব্যয় আলোচনা করে যৌক্তিকভাবে বরাদ্দ দেওয়া হবে।
তিনি জানান, একাদশ সংসদ নির্বাচনে পুলিশ, আনসার, বিজিবি, র্যাব, কোস্টগার্ড যে পরিমাণ অর্থ চেয়েছিল, এবারও তার কাছাকাছি চাহিদা দিয়েছে। সশস্ত্রবাহিনীর চাহিদা যখন সময় হবে তখন দিতে পারে।
সবশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটের দিন প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ১৪ থেকে ১৬ জন নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। র্যাব, বিজিবি ও সেনা সদস্যরা ছিল টহলে।
গতবার ৩০ ডিসেম্বরের ভোটে ভোটের এক সপ্তাহ আগে থেকে ১০ দিনের জন্য মোতায়েন ছিল সশস্ত্রবাহিনী।
একাদশের আইন শৃঙ্খলায় যারা
নিরাপত্তা সদস্য কেন্দ্রে
৬,০৮,০০০ (পুলিশ ১,২১,০০০; আনসার ৪,৪৬,০০০ ও গ্রাম পুলিশ ৪১,০০০)
মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স
২০০০ প্লাটুন (৬৫,০০০)
বিজিবি ১১০৬ প্লাটুন (প্লাটুন প্রতি ৩০ জন); কোস্ট গার্ড ৪২ প্লাটুন, র্যাব ৬০০ প্লাটুন, সেনাবাহিনী ৪১৪ প্লাটুন ও নৌ ৪৮ প্লাটুন
এবার ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন খাতের ব্যয়ও বাড়বে। প্রায় নয় লাখ প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তাদের ভোটগ্রহণের ভাতা বাবদ গত নির্বাচনের চেয়ে এবার বেশি দিতে পারে ইসি। প্রায় ১২ কোটি ভোটারের এবারের নির্বাচনে ৩০০ আসনে কেন্দ্র থাকবে ৪২ হাজারেরও বেশি।
ইসি ব্যয়ের হিসাব অনুযায়ী, শুধু ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের ভাতা বাবদ ব্যয় বাড়বে ২৮০ কোটি টাকা। এটিসহ নির্বাচন পরিচালনা খাতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার কোটি টাকার বেশি। এর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা খাত মিলিয়ে এবার মোট ব্যয় হিসাব করা হচ্ছে দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে যে পরিমাণ টাকা চাহিদা দেওয়া হয়, সাধারণত তা পুরোপুরি দেওয়া হয় না। নির্বাচনে কোন বাহিনীর কত সংখ্যক সদস্য কয়দিন মাঠে থাকবেন- সেটির উপর ভিত্তি করে টাকা বরাদ্দের পরিমাণ ঠিক করা হয়। গত নির্বাচনেও তাই হয়েছে।
তবে এবারের নির্বাচনে ভোটগ্রহণের ১৫ দিন পর পর্যন্ত প্রয়োজনে মাঠে পুলিশের টহল রাখতে চায় ইসি। আইনশৃঙ্খলা খাতে ব্যয় বাড়ার অনেকগুলোর কারণের মধ্যে এটিও একটি হতে পারে বলে ধারণা কর্মকর্তাদের।
আগের কোন নির্বাচনে কত ব্যয়
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা ও নির্বাচন পরিচালনার জন্য মোট ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। পরে তা আরও বেড়েছিল।
দশম সংসদ নির্বাচন: ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ২৬৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে নির্বাচন পরিচালনায় ৮১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পেছনে ব্যয় হয় ১৮৩ কোটি টাকা। এ নির্বাচনে ১৪৭ আসনে ভোট হয়, ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন একক প্রার্থীরা। অর্ধেক এলাকায় ভোট করতে হওয়ায় বরাদ্দের তুলনায় খরচ অনেক কমে আসে।
নবম সংসদ নির্বাচন: ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের ভোটে ১৬৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়; যাতে ভোটার ছিল ৮ কোটি ১০ লাখের বেশি। উপকরণ ও ব্যবস্থাপনাসহ সব খাতে ব্যয় বাড়ার কারণে ধীরে ধীরে নির্বাচনী বরাদ্দও বাড়ে।
অষ্টম সংসদ নির্বাচন: মোট ব্যয় হয় ৭২ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
সপ্তম সংসদ নির্বাচন: পরিচালনা বাবদ ব্যয় ১১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
ষষ্ঠ জাতীয় নির্বাচন: মোট ৩৭ কোটি টাকা ব্যয় হয়।
পঞ্চম সংসদ নির্বাচন: পরিচালনা ও আইনশৃঙ্খলা খাতে ব্যয় হয় ২৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।
চতুর্থ সংসদ নির্বাচন: ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
তৃতীয় সংসদ নির্বাচন: ৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা।
দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন: ব্যয় হয় ২ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
প্রথম সংসদ নির্বাচন: ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ ৩ কোটি ৫২ লাখ ৫ হাজার ৬৪২ জন ভোটারের এ নির্বাচনে ব্যয় ছিল ৮১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা।