অন্য জাহাজের চাকরির সুযোগ থাকলেও সুযোগসুবিধা বেশি দেওয়ায় গত নভেম্বরে 'এমভি আবদুল্লাহ'য় উঠেছিলেন আতিক।
Published : 13 Mar 2024, 10:04 PM
সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি নাবিক আতিক উল্লাহ খানের স্ত্রী পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। স্বামীর জিম্মিদশার খবর পাওয়ার পর থেকে তিনি শয্যাশায়ী। নতুন করে তাকে নিয়ে এখন দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন পরিবারের সদস্যরা।
আর আতিকের মা ছেলের সঙ্গে শেষবার কথা বলার পর থেকে চিন্তায় অস্থির। তিনি কখনো কাঁদছেন, কখনো নামাজে দাঁড়িয়ে ছেলের জন্য দোয়াদরুদ পড়ছেন। কখনোবা তিন নাতনিকে পাশে নিয়ে চুপ করে বসে আছেন। মায়ের মুখে একটাই কথা, ছেলে যেন নিরাপদে ফিরে আসে, আর কিছুর প্রয়োজন নেই।
মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে আরব আমিরাতে যাবার পথে মঙ্গলবার ভারত মহাসাগরে জলদস্যুর কবলে পড়ে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। জাহাজের ২৩ নাবিককে তারা জিম্মি করেছে।
জাহাজের চিফ অফিসার আতিকের বাসা চট্টগ্রামের নন্দনকাননে। সেখানে পরিবারের সদস্যদের সময় কাটছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায়।
১৫ বছরের বেশি সময় ধরে বিদেশগামী জাহাজে কাজ করছেন আতিক। সর্বশেষ গত বছরের ২৫ নভেম্বর চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের মালিকানাধীন এস আর শিপিংয়ের ‘এমভি আবদুল্লাহ’ জাহজে ওঠেন চিফ অফিসার হিসেবে।
সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। আরব আমিরাত যাবার পর দেশে ফেরার কথা ছিল জাহাজটির। কিন্তু এখন সহসহর্মীদের সঙ্গে জিম্মিদশায় আছেন আতিক।
দুই ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে আতিক চতুর্থ। আতিকের মা শাহানুর বেগম, তার স্ত্রী ফিরোজা আজমিন মিনা ও তিন মেয়ে থাকে নন্দনকাননের বাসায়। আতিকের ছোটভাই আবদুল নুর খান আসিফও এ পরিবারের সঙ্গে থাকেন। তাদের গ্রামের বাড়ি চন্দনাইশ উপজেলার বরকল এলাকায়।
আতিকের তিন মেয়ের মধ্যে ১০ বছর বয়সী বড় মেয়ে ইয়াশরা ফাতিমা পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে; মেজ মেয়ে উনাইজার বয়স ছয়, পড়ছে দ্বিতীয় শ্রেণিতে, আর দুই বছর বয়সী ছোট মেয়ের নাম খাদিজা।
মঙ্গলবার স্ত্রী মিনার কাছে পাঠানো এক অডিও বার্তায় আতিক বলেন, “এই মেসেজটা সবাইকে পাস করে দিও। আমাদের থেকে মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে আর কি। ফাইনাল কথা হচ্ছে যে, এখানে যদি টাকা না দেয়, আমাদেরকে একজন একজন করে মেরে ফেলতে বলছে।
“এদেরকে যত তাড়াতাড়ি টাকা দিবে, তত তাড়াতাড়ি ছাড়বে বলছে। এই মেসেজটা সবাইকে পাস করে দিও। এখন মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে।”
ওই অডিও বার্তা পাওয়ার পর থেকে শয্যা নিয়েছেন মিনা।
আতিকের শ্বশুর আমেরিকা প্রবাসী মোহাম্মদ ফরিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আমি এক সপ্তাহ আগে দেশে এসেছি। মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা, স্বামীর জিম্মি হওয়ার সংবাদ পাবার পর থেকে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে নিয়ে আমরা দুঃশ্চিন্তায় আছি।"
আতিকের ভাই আসিফ বলেন, " ভাবি অন্তঃসত্ত্বা, ভাইয়ের জিম্মিদশার সংবাদের পর আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। প্রতিটি মুহূর্ত উৎকণ্ঠার মধ্যেই কাটছে। আমার মাও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।"
সন্তানের জিম্মিদশার সংবাদ প্রাপ্তির পর থেকে উদ্বেগে-উৎকণ্ঠায় জেরবার হয়ে পড়েছেন মা শাহানুর বেগম।
বুধবার দুপুরে বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ছেলের চিন্তায় অস্থির শাহনুর বেগম তিন নাতনিকে নিয়ে বসে আছেন। আবার উঠে গিয়ে জায়নামাজে দাঁড়াচ্ছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গতকাল দুপুরে অন্য জাহাজে কর্মরত আমার মেয়ের জামাইয়ের কাছ থেকে ছেলের সংবাদ পাই। এরপর সন্ধ্যা পর্যন্ত হোয়াটসঅ্যাপে ভয়েস মেসেজ এবং সরাসরি তিনবার কথা হয়েছে।"
আতিকসহ জাহাজের সব নাবিকের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন শাহানুর বেগম। তাদের দ্রুত মুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং জাহাজ মালিক কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন শাহানুর বেগম।
তিনি বলেন, "সংবাদ শোনার পর থেকে আমাদের প্রতিটি ঘণ্টা কীভাবে যাচ্ছে বোঝাতে পারব না। ছেলে বলেছে, জলদস্যুরা তাদের নিয়ে সোমালিয়ার দিকে যাচ্ছে। সেখানে পৌঁছাতে দুই-তিন দিন লাগতে পারে। তারা সবাই একটি কেবিনে বন্দি আছে। কালকে ইফতারের আগে দুই দফা ভয়েস মেসেজে কথা হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে তাদের মোবাইল নিয়ে যাবার কথা বলেছিল।"
এরপর থেকে আতিকের সঙ্গে মা শাহনুর বেগম বা পরিবারের অন্য কোন সদস্যের সাথে কথা হয়নি।
ছোটভাই আবদুল নুর খান আসিফ বলেন, "অন্য কোম্পানির জাহাজে ক্যাপ্টেন হওবার সুযোগ থাকলেও ভাইয়া এস আর শিপিংয়ের জাহাজেরই উঠেছিল। সুযোগ-সুবিধা বেশি থাকায় কবির গ্রুপের মালিকানাধীন এস আর শিপিংয়ের প্রতিষ্ঠানে কাজ করার ক্ষেত্রে তার আগ্রহ ছিল বেশি।"
চিফ অফিসার আসিফ ২০১৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এস আর শিপিংয়ের অধীনেই বিভিন্ন জাহাজে কাজ করেছেন। মাঝে বিদেশি একটি কোম্পানির জাহাজে চড়লেও গত বছরের নভেম্বরে আবার ফিরে আসেন।
মুক্তিপণ না দিলে নাবিকদের মেরে ফেলার হুমকির খবর পেয়ে বুধবার সকালে আগ্রাবাদে জাহাজের মালিক পক্ষের কার্যালয়ে জড়ো হন নাবিকদের স্বজনরা।
জাহাজ মালিক কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া ফোকাল পারসন মিজানুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আমরা জলদস্যুদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। এখনো কোনো যোগাযোগ স্থাপন হয়নি।
“তাদের একটা কৌশল হল, জাহাজ ক্যাপচার করার পর তারা সেইফ জোন তৈরি করে। তারপর সেখান থেকে নিজেদের ডিমান্ড জানায়। আমাদের প্রথম প্রায়োরেটি হল নাবিকদের মুক্ত করা। তারপর জাহাজ অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা।”
এক দশকের বেশি সময় আগে বাংলাদেশি জাহাজ জাহান মনি উদ্ধারের ঘটনা উল্লেখ করে মিজানুল ইসলাম বলেন, “যেহেতু তাদের কাছ থেকে জাহাজ ও নাবিকদের নিরাপদে উদ্ধারে আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। আশা করি এবারও সফল হব।”
পুরনো খবর:
এমভি আবদুল্লাহ: টাকা না দিলে ‘একজন একজন করে মেরে ফেলার’ হুমকি দিচ্ছে জলদস্যুরা