ইভিএম ও সিসি ক্যামেরা বাদ পড়লেও নির্বাচনী অ্যাপ চালুর প্রস্তুতি চলছে; যার মাধ্যমে ভোট কেন্দ্র, প্রার্থীদের তথ্য জানা যাবে, পাওয়া যাবে ভোটের ফলও।
Published : 18 Aug 2023, 01:17 AM
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দুই প্রধান রাজনৈতিক শিবিরে বিরোধ শঙ্কা ছড়ালেও নির্দিষ্ট সময়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজনের কাজ শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন।
ভোটের জন্য ১১ ধরনের মালামাল কেনার দরপত্র হয়েছে।এরমধ্যে কিছু সরবরাহও হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইসি কর্মকর্তারা।
প্রায় ১২ কোটি ভোটারের বিপরীতে এবার নতুন করে ৮০ হাজার স্বচ্ছ ব্যালট কেনা, অমোচনীয় কালিসহ নানা ধরনের নির্বাচন সামগ্রী কেনাকাটা, আসনভিত্তিক ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত ও প্রশিক্ষণ, নির্বাচনী ম্যানুয়াল তৈরি ও মনোনয়নপত্র মুদ্রণ, ভোট কেন্দ্রের তালিকা চূড়ান্ত করাসহ আনুষাঙ্গিক কাজ নিয়ে তফসিল ঘোষণার আগে-পরে একগুচ্ছ কাজের ফর্দ ধরে এগোচ্ছে ইসি।
এবার ইভিএম ও সিসি ক্যামেরা রেখে ভোটের ভাবনা থাকলেও তা থেকে সরে যেতে হয়েছে সাংবিধানিক সংস্থাটিকে। তবে প্রযুক্তিগত সহায়তায় ভোটার, প্রার্থী, দল, প্রতীক ও ভোট কেন্দ্রের নানা ধরনের দিতে থাকছে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা অ্যাপ, যা এখনও প্রক্রিয়াধীন।
শতেক কাজের ফর্দ নিয়ে ভোটের পথে ইসি
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন: ব্যালট পেপার সকালে পাঠানোর চিন্তা ইসির
অক্টোবরে আসবে মার্কিন ‘প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল’
এবার ভোটের আইন-বিধি, পর্যবেক্ষক নিয়ে খুঁটিনাটি জানল ইইউ দল
নির্বাচন: নভেম্বরের মধ্যে স্কুলের পরীক্ষা শেষ করার পরিকল্পনা
সংবিধান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। ১ নভেম্বর শুরু হবে সেই নির্বাচনের ক্ষণগণনা।
নির্বাচনের ক্ষণ গণনা শুরুর পরপরই আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করার পর প্রথা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে ইসি। তারপর কমিশন সভায় বসে ভোটের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করে।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোট হতে পারে বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল।
সেই সময়ে সরকারে কে থাকবে, তা নিয়ে রাজনীতিতে রয়েছে বিভেদ। বিএনপির দাবি, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। তা মানতে নারাজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার উপর জোর দিচ্ছেন সিইসি; তিনি আশা করছেন, ভোটের আগে সেই সমঝোতা হয়ে যাবে।
কেনা হচ্ছে ১১ ধরনের মালামাল
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, “বলা যায়, আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে এবং ভালোভাবে চলছে। ইতোমধ্যে ১১ ধরনের নির্বাচনী মালামাল কেনাকাটার কার্যাদেশ হয়েছে। দুয়েকটির সরবরাহও হচ্ছে। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহের মধ্যে সবকিছু গুছিয়ে নেওয়া হবে।”
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভোটের তফসিল ঘোষণা হতে পারে বলে আগেই ধারণা দিয়েছিলেন সিইসি।
তফসিল ঘোষণার আগের কাজ এবং তফসিল ঘোষণার পরের কাজগুলো সাজিয়ে একটা ‘চেকলিস্ট’ করছে ইসি সচিবালয়। অতিরিক্ত সচিব জানান, অর্ধশতাধিক কাজ সম্ভাব্য সময় ধরে বাস্তবায়ন অগ্রগতি কমিশনকে সময়ে সময়ে জানান হচ্ছে।
অশোক দেবনাথ বলেন, হাতে থাকা ব্যালট বাক্সের বাইরে এবার নতুন করে অন্তত ৮০ হাজার স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স লাগছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকে তা কেনা হচ্ছে। ব্যালট পেপারের জন্য নির্ধারিত প্রেস যথাসময়ে কাগজ সংগ্রহ ও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময়ের পর মুদ্রণের কাজ করবে।
অন্যান্য কাজ নিয়ে তিনি বলেন, সেপ্টেম্বরের দিকে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার প্যানেল প্রস্তুতের কাজ শুরু হবে, ভোট কেন্দ্র চূড়ান্ত হবে, প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রস্তুতি চলবে। নানা ধরনের আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক, আইন শৃঙ্খলবাহিনী, পর্যবেক্ষকদের সংস্থার বিষয়গুলো নিয়ে ধাপে ধাপে কাজ থাকবে।
“তফসিল ঘোষণার পরের কাজগুলো ঘোষণা হওয়ার পর সময় ধরে এগোবে।”
নির্বাচন পরিচালনা ও আইন শৃঙ্খলা খাত মিলিয়ে এবার সংসদ নির্বাচনে প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে বলে ধারণা দিয়েছেন ইসি কর্মকর্তারা।
ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার কর্মকর্তারা জানান, প্রথম সংসদ নির্বাচনে ভোটের আগে ৬০ দিন, দ্বিতীয়ে ৫৪ দিন, তৃতীয়ে ৪৭ দিন, চতুর্থে ৬৯ দিন পঞ্চমে ৭৮ দিন, ষষ্ঠে ৪৭ দিন, সপ্তমে ৪৭ দিন, অষ্টমে ৪২ দিন, নবমে ৪৭ দিন, দশমে ৪২ দিন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪৬ সময় হাতে রেখে তফসিল ঘোষণা হয়েছিল।
প্রথা অনুযায়ী, ভোটের তারিখের আগে ৪০-৪৫ দিন সময় রেখে তফসিল ঘোষণা হয়। এক্ষেত্রে মনোনয়নপত্র জমা, বাছাই, প্রত্যাহারের সময় ও প্রতীক বরাদ্দের পর প্রচারের জন্য সময় রাখা হয়।
প্রচারের জন্যে সর্বোচ্চ তিন সপ্তাহ, মনোনয়নপত্র জমায় ১০-১৫ দিন, বাছাইয়ে চার দিন, আপিল নিষ্পত্তিতে চার থেকে সাত দিন, প্রত্যাহারের জন্য সাত দিন সময় দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে প্রথম থেকে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে যথাক্রমে- ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ, ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৬ সালের ৭ মে, ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ, ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর।
সবশেষ নবম, দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয় ২০০৮ সালের ২ নভেম্বর, ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর ও ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর।
ভোটের আগে-পরে যত কাজ
অতিরিক্ত সচিব অশোক দেবনাথ জানান, রোডম্যাপ ধরে সংলাপ, আইন সংস্কার ও সংশোধন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন শেষ হয়েছে। পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন চূড়ান্ত হচ্ছে মাস খানেকের মধ্যে, ভোট কেন্দ্র চূড়ান্ত হবে সেপ্টেম্বরে।
নির্বাচনী সামগ্রী: ব্যালট পেপারের কাগজ, মনোনয়নপত্র থেকে ফলাফল বিবরণী, ম্যানুয়াল মুদ্রণ, ভোটারের সমান সংখ্যক ব্যালট পেপার মুদ্রণ। কেনাকাটার মধ্যে রয়েছে অফিসিয়াল সিল, মার্কিং সিল, ব্রাস সিল, লাল গালা, প্যাকিং বাক্স, অমোচনীয় কালি, বিভিন্ন ফরম, প্যাকেট, সুই-সুতা, খাম, মোমবাতি।
ভোট গ্রহণের উপকরণ: স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, অমোচনীয় কালির কলম, ব্যালট বাক্সের সিল, স্ট্যাম্প প্যাড, রেড সিলিং ওয়াক্স, অফিসিয়াল সিল, মার্কিং সিল ও ব্রাশ সিল।
তফসিলের আগের কাজ: ভোটকেন্দ্রের তালিকা, পুনর্নির্ধারিত সীমানা অনুযায়ী আসনভিত্তিক ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স প্রস্তুত, নির্বাচন সামগ্রী কেনাকাটা, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত, প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, নির্বাচনী ম্যানুয়াল তৈরি, মনোনয়নপত্র মুদ্রণসহ আনুষঙ্গিক কাজ।
তফসিলের পরের কাজ: মন্ত্রিপরিষদসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা, রিটার্নিং কর্মকর্তার জন্য পরিপত্র জারি, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ, নির্বাচনী তদন্ত কমিটি গঠন, নির্বাহী ও বিচারিক হাকিম নিয়োগে ব্যবস্থা, ভোট কেন্দ্রের গেজেট প্রকাশ, সাংবাদিক-স্থানীয় ও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের অনুমতি, মাঠ পর্যায়ে সামগ্রী বিতরণ এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও সংস্থার সঙ্গে বৈঠক।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা পাওয়ার পর ব্যালট পেপার মুদ্রণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, রিটার্নিং কর্মকর্তা, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে সভা এবং আইন শৃঙ্খলা প্রধানদের সঙ্গে বিশেষ পর্যালোচনা বৈঠক কমিশন নির্ধারণ করে থাকেন।
ইভিএম-সিসি ক্যামেরা বাদ, টিকে আছে অ্যাপ
এবার দেড়শ’ আসনে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়ে এগোলেও অর্থ সঙ্কট ও রাজনৈতিক মতানৈক্যের মধ্যে শেষ পর্যন্ত বাদ যায় তা। এরমধ্যে ৩০০ আসনে সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের পরিকল্পনার কথা জানালেও তা এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। বরং তাও বাদ দেওয়ার আভাস এসেছে।
তবে প্রযুক্তিনির্ভর ভোট ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে নভেম্বরেই নির্বাচনী অ্যাপ চালুর প্রস্তুতি চলছে ইসিতে।
অ্যাপটির বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান বলেন, “আগামী সংসদ নির্বাচন ব্যালট পেপারে হলেও প্রার্থীদের সুবিধা এবং ভোটারদের ভোগান্তি কমাতে আমাদের এ উদ্যোগ।
‘বাংলাদেশ ইলেকশন অ্যাপ’ নামে এই অ্যাপ তৈরি হচ্ছে, তার মাধ্যমে ভোটাররা সহজে প্রার্থীর নাম, পরিচিত, ছবি, দলীয় পরিচয় ও প্রার্থীর হলফনামার তথ্য দেখতে পাবেন। ভোট কেন্দ্র এবং ভোটার নম্বর, ভোট কেন্দ্রের ছবিও দেখতে পাবেন। ভোট শেষে কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল, দলভিত্তিক প্রাপ্ত আসন সংখ্যা এবং নিকটতম প্রার্থীর নাম ও প্রাপ্ত ভোট সংখ্যাও দেখতে পাবে যে কেউ।
এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র অনলাইনে জমা নেওয়ার প্রস্তুতিও চলছে বলে জানান আহসান হাবিব।