কালরাতে শহীদদের স্মরণের দিন

পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার বিবরণ দিতে গিয়ে সাংবাদিক সায়মন ড্রিং লিখেছিলেন, “আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত এক সন্ত্রস্ত নগর।”

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2023, 06:05 PM
Updated : 24 March 2023, 06:05 PM

একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে মুক্তিকামী বাঙালির উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে ‍যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সূচনা শুরু করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী, নিরপরাধ সেই মানুষদের ওপর সেই বিভীষিকার স্মরণে পালিত হচ্ছে গণহত্যা দিবস।

শনিবার নানা আয়োজনে জাতি স্মরণ করছে অগণিত সেই শহীদদের, যাদের আত্মত্যাগের পথ ধরে ৫২ বছর আগে রূপ পেয়েছিল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

তেইশ বছরের শোষণ থেকে বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের শ্বাসরোধ করতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের সেই অভিযানে কালরাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় চালানো হয় গণহত্যা।

রাত ১০টার দিকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনীর একটি বড় কনভয় যুদ্ধ সাজে শহরের দিকে রওনা হয়।

শহরমুখী সেনাবাহিনীর মেকানিক্যাল কলামটি প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় ফার্মগেইটে। সেখানে বড় বড় গাছের গুঁড়ি, অকেজো স্টিম রোলার এবং ভাঙা গাড়ির স্তূপ জমিয়ে রাখা হয়েছিল পথ আটকানোর জন্য। মুক্তিকামী বেপরোয়া প্রতিরোধোন্মুখ জনতার মাঝ থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উঠছিল।

গুলি করে এ প্রতিরোধ ভেঙে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ট্যাংকগুলো সামনে এগিয়ে যায়।

রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ রেসকোর্স ময়দানের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে সেনাবাহিনীর অন্তত ৮০টি সাঁজোয়া যানকে পূর্ণ যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।

রাত ১১টা ২০ মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি অংশ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের চারিদিকে অবস্থান নিতে শুরু করে। এ আক্রমণের সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে দেশের জেলা ও সাব ডিভিশনে বেতার বার্তার মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়।

রাত সাড়ে ১১টার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল তাজের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাদের কনভয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমণ শুরু করে।

ব্যারাকে অবস্থানরত বাঙালি পুলিশ সদস্যরা সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে পাল্টা গুলি করে।

একই সময়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২তম বালুচ রেজিমেন্টের সেনারা পিলখানায় ইপিআর-এর ওপর হামলা করে। ব্যারাকে থাকা বাঙালি সেনারা চরম সীমাবদ্ধতার মধ্যেও প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন।

পিলখানা ইপিআর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনস আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারি বাজারসহ সমগ্র ঢাকায় শুরু হয় প্রচণ্ড আক্রমণ; বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় রাতের অন্ধকারে গুলি, বোমা আর ট্যাংকের আওয়াজে প্রকম্পতি পুরো শহর।

Also Read: প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় কালরাতের বিভীষিকা

Also Read: ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি দিল সংসদ

Also Read: ‘একাত্তরের মার্চেই ঘটেছিল পৃথিবীর বৃহত্তম গণহত্যা’

সেনাবাহিনী সেই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা, এবং বস্তিবাসীর ওপর নজিরবিহীন নৃশংসতা চালায়।

রাত ১টার পর পাকিস্তানের সেনারা ট্যাংক আর সাঁজোয়া যান নিয়ে ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান।

এরপর নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং জাতির অসাধারণ ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।

১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় সাংবাদিক সায়মন ড্রিংয়ের করা প্রতিবেদনে বলা হয়, “আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত এক সন্ত্রস্ত নগর।

“পাকিস্তানি বাহিনীর নিষ্ঠুর ও ঠাণ্ডামাথায় গোলাবর্ষণের ২৪ ঘণ্টা পর, অন্তত ৭ হাজার মানুষ মৃত, বিশাল এলাকা মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার সংগ্রামকে নৃশংসভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।

২০১৭ সাল থেকে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসাবে পালন করে আসছে বাংলাদেশ; প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির।

গণহত্যা দিবস উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, “বাঙালির মুক্তি আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে কাপুরুষের দল সেদিন নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালির ওপর নির্বিচারে হামলা চালায়। এ গণহত্যায় শহীদ হন ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, বিভিন্ন বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশ ও তৎকালীন ইপিআর সদস্যসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার অগণিত মানুষ।

“এ দিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ত্রিশ লক্ষ বাঙালির আত্মত্যাগের মহান স্বীকৃতির পাশাপাশি তৎকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যার বিরুদ্ধে চরম প্রতিবাদের প্রতীক।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে কালরাতের গণহত্যা ও নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন দেশ অর্জন এবং দেশের ৫২ বছরের পথচলার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।

বাংলাদেশের নীতিতে ‘শান্তির সংস্কৃতি ও অহিংসাকে’ লালন করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমরা যুদ্ধ ও সংঘাত চাই না, নর-নারী-শিশু হত্যা আমাদের তীব্রভাবে ব্যথিত করে। আমরা শান্তিতে বিশ্বাস করি। টেকসই শান্তি বিরাজমান থাকলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।”

Also Read: একাত্তরের জেনোসাইডকে স্বীকৃতি দিল আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘জেনোসাইড ওয়াচ’

Also Read: একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি এল যুক্তরাষ্ট্র থেকে

Also Read: একাত্তরের জেনোসাইডের স্বীকৃতি দিতে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে প্রস্তাব

বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, “রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শান্তির নীতি অনুসরণ করি। সকল প্রকার বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে আমি দেশবাসীসহ বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানাই।”

গণহত্যা দিবসের কর্মসূচি

একাত্তরের ওই রাতে নিহতদের স্মরণে নেওয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনও কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

এ উপলক্ষে শনিবার রাত ১০টা ৩০মিনিট থেকে ১০টা ৩১ মিনিট পর্যন্ত সারাদেশে প্রতীকী ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করা হবে।

এদিন সকাল সাড়ে ৯টায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে গণহত্যা দিবসের ওপর আলোচনা সভা হবে।

এছাড়া সারাদেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গীতিনাট্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

ঢাকাসহ সকল সিটি করপোরেশনের মিনিপোলগুলোতে গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা হবে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এদিন বাদ জোহর দেশের সকল মসজিদে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে সুবিধাজনক সময়ে প্রার্থনা করা হবে।

আওয়ামী লীগের কর্মসূচি

আলোচনা সভা, মানববন্ধনসহ ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস উপলক্ষে এক দিনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগ।

এদিন দুপুর ২টায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগ আয়োজিত এ সভায় প্রধান অতিথি থাকবেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

গণহত্যা দিবস উপলক্ষে শনিবার বেলা ১১টায় রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে 'কালোরাত্রী স্বরণ' শীর্ষক আলোচনা সভা করবে যুবলীগ।

দিনটিতে রাজু ভাস্কর্যের সামনে মৌলবাদী সংগঠন হিসেবে জামাত শিবিরকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে মানববন্ধন করবে ছাত্রলীগ।

এছাড়া আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো পৃথক কর্মসূচি পালন করবে।