প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় কালরাতের বিভীষিকা

শোষণ মুক্তির মন্ত্রে উদ্দীপ্ত জাতীয় চেতনা দলনে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সুসজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ এখনও শিহরিত করে প্রায় অর্ধশত বছর আগের ওই রাতের প্রত্যক্ষদর্শীদের। 

কামাল তালুকদার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 March 2017, 08:10 PM
Updated : 24 March 2017, 08:10 PM

মুহুর্মুহু গুলি আর কামানের গোলার শব্দে ভয়ার্ত রাত পার হওয়ার পর শহরজুড়ে লাশ আর লাশ দেখতে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন তারা।

ভয়াবহতম যে হত্যাযজ্ঞে দমে না গিয়ে শানিত হয়েছিল বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন, ঘোষিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ, সেই নিষ্ঠুরতার বর্ণনা দিয়েছেন হানাদারদের প্রথম প্রতিরোধকারীসহ গণহত্যার সাক্ষীরা।   

একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রথম হামলা হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে, এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে হত্যার মিছিল চলে যায় বুড়িগঙ্গার তীরে।

সে সময় বয়সে তরুণ পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী মণ্টু মিয়া, মিটফোর্ড হাসপাতালের কর্মচারী আব্দুর রাজ্জাক, জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থী রঞ্জন বিশ্বাস, শাঁখারী বাজারের ব্যবসায়ী অমর সুর, নীলকান্ত দত্ত ও নয়াবাজারের হাজী ফজলুর রহমান পর্বত শুনিয়েছেন সেই রাতের কথা।

ওই রাতে রাজারবাগে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা পুলিশ সদস্যরাও বলেছেন সহযোদ্ধাদের হারানোর কথা।

পুরান ঢাকার বাসিন্দারা কেউ ছাদে উঠে, কেউবা রাস্তার পাশের কোনো ঘরের আড়ালে লুকিয়ে আবার কেউ বন্ধ দোকানে লুকিয়ে থেকে সাক্ষী হন পাকিস্তানি সেনাদের নিষ্ঠুরতার। পরদিন ভোরে বেরিয়ে তারা দেখতে পান হত্যাযজ্ঞের চিত্র।

সেই সময়ের ১৬ বছরের আব্দুর রাজ্জাক এখন মিটফোর্ড হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার। একাত্তরে পুরান ঢাকার ইসলামিয়া স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়তেন তিনি, বাবা ছিলেন মিটফোর্ডের ওয়ার্ড মাস্টার।

রাজ্জাক জানান, ২৫ মার্চ রাতে কয়েকজন বন্ধু মিলে বুড়িগঙ্গার পাড়ে বসে গল্প করছিলেন। রমেশ, ফারুক, হালিম, বাবু, বাবলা ও বাড্ডা ছিল।

“হঠাৎ একটি আওয়াজ শুনতে পেয়ে সবাইকে বললাম, ওই থাম কিসের আওয়াজ আসতেছে। চুপ করে সবাই শুনে বললাম, এটা গুলির শব্দ। সবাই বলাবালি করতে লাগলাম কারাবারতো শুরু হয়ে গেল, কী করবা?”

এরপর সবাই যার যার বাসায় চলে যায়, খেয়ে আবার সবাইকে বেরোতে বলেন রাজ্জাক।

তিনি বলেন, “খাওয়া দাওয়ার পর বের হয়ে দেখি রাস্তা একেবারে ফাঁকা, কেউ নেই। সরু রাস্তা দিয়ে এগোতে লাগলাম এবং শাঁখারিবাজার পর্যন্ত যেতে পারিনি। লায়ন সিনেমা হল পর্যন্ত গিয়ে দেখলাম একটি ট্যাংক বাবু বাজার পুলিশ ফাঁড়ির সামনে পূর্বদিকে তাক করানো।

“গুলির আওয়াজ বাড়ছে আর বাড়ছে। মনে হচ্ছে উত্তর থেকে পাক বাহিনী সব মানুষকে হত্যা করে দক্ষিণ দিকে আসছে।”

পরে মিটফোর্ড হাসপাতালে ফিরে গিয়ে সেখানেই রাতে থেকে যান রাজ্জাক। মধ্যরাতে গুলির আর কামানের গোলার শব্দে আর ঘুম আসেনি। ভোররাতে ফজরের নামাজের আযান দেওয়ার পর গোলাগুলির শব্দ কমতে শুরু করে।

রাজ্জাক বলেন, “সকালে বের হয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসলাম রাতে কী হয়েছে তা দেখার জন্য। ওই সময় জরুরি বিভাগ ছিল বর্তমান ব্যাংক ভবনে। জরুরি বিভাগে এসে দেখি করিডোরের ফ্লোরে লাশ আর লাশ। এর মাঝে দুই একজন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।

“জীবিতদের দ্রুত ওষুধ দিয়ে ব্যান্ডেজ করছিলাম চিকিৎসকের পরামর্শে। আমি ও আমার বয়সী কয়েকজন মিলে লাশগুলো মর্গে নিই।”

১৯৭১ সালে মিটফোর্ডের মর্গের দায়িত্বে ছিলেন সোয়ান লাল ওরফে সোনা মিয়া। মর্গে লাশ রাখতে রাখতে যখন লাশের স্তূপ হয়ে যায়, তখন সোনা মিয়া আর লাশ রাখতে নিষেধ করেন।

“আমরা দেখলাম ঘরের অর্ধেক লাশে ভরে গেছে। তখন বললাম, চাচা অনেক জায়গা আছে আরও কিছু লাশ রাখি। ডোম সোনা মিয়া বলল, না এই লাশ ফুলে যাবে। যদি ঘর ভরে লাশ রাখি তাহলে ফুলে ভবন ফেটে যাবে।”

এভাবে অর্ধেক ভর্তি করে চারটি কক্ষে প্রায় ছয় থেকে সাতশ লাশ রাখা হয় জানিয়ে ষাটোর্ধ্ব রাজ্জাক বলেন, লাশগুলো সদরঘাট টার্মিনাল, বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ি, কোতয়ালী থানা ও  শাঁখারিবাজার এলাকা থেকে আসে। তাদের মধ্যে নারী ও শিশুও ছিল। পুলিশ ও সাধারণ মানুষের লাশও রাখা হয় সেখানে।

বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ি ও কোতয়ালি থানা থেকে দুজন আহত পুলিশ সদস্যকে তিনি নিজে মিটফোর্ড হাসপাতালে এনে ভর্তি করান, তবে তারা বাঁচেনি বলে জানান রাজ্জাক।

মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থানার কনকসার গ্রামের হাজি মণ্টু মিয়া একাত্তরে সদরঘাটের বাকল্যান্ডে মামার ব্যাটারির দোকানে কাজ করতেন। ২৫ মার্চ রাতে ওই দোকানেই ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি।

পাকিস্তানি বাহিনী ওই রাতে সদরঘাটে যে হত্যাযজ্ঞ চালায়, তার থেকে মণ্টুর দোকান ছিল একশ গজ দূরে।

ওই রাতের ঘটনা মনে পড়লে এখনও শিহরিত হয়ে ওঠেন বলে জানান তিনি।

 

মণ্টু মিয়া বলেন, চার থেকে পাঁচজন স্টাফসহ রাতে দোকানে ঘুমিয়ে ছিলেন। রাত ১টা কি ২টা হবে।

“শুরু হল গুলির শব্দ, প্রচুর গুলির শব্দ। দোকান থেকে বের হওয়ার সাহস পেলাম না।

ফজরের আযান দেওয়ার পর গোলাগুলির শব্দ কমতে শুরু করে এবং ভোরে বের হয়ে সদরঘাট টার্মিনালে গিয়ে দেখি- অনেক মৃতদেহ পড়ে রয়েছে, অনেক মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। মানুষের রক্তের স্রোতে নদীর পানিও লাল হয়ে যায়। পুরো পন্টুনজুড়ে রক্ত আর রক্ত।”

পন্টুনে কত লাশ দেখেছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এতো লাশ দেখে মাথা ঠিক ছিল না। শত শত মৃতদেহ।”

আহতদের ঠেলাগাড়িতে করে হাসপাতালে পাঠান বলে জানান তিনি।

সদরঘাট টার্মিনাল খালি হওয়ার পর কোতোয়ালি থানায় যান মণ্টু মিয়া।

“সেখানে গিয়ে দেখি থানায় শেল মেরেছে পাক বাহিনী। অনেক পুলিশের মৃতদেহ পড়ে রয়েছে, আর পাশের বস্তিতেও গুলি চালায় তারা। সেখান থেকে ভিক্টোরিয়া পার্ক সংলগ্ন টেম্পু স্ট্যান্ডের কাছে  গিয়ে দেখি, রাস্তায় রক্ত আর রক্ত। দূর থেকে দেখি পাকিস্তানি বাহিনী ট্রাকে মৃতদেহ ভরছে।”

একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা

ওই সময় তার বয়স ১৭ বা ১৮ বছর ছিল জানিয়ে মণ্টু মিয়া বলেন, “পরে ভেতর দিয়ে কলতাবাজারে মামার বাসায় যাই, কিন্তু সেখানে কাউকে দেখতে পাইনি। পরে আবার বাকল্যান্ডে ফিরে আসি। কিন্তু সেখানে থাকতে পারিনি। পরদিন আমাদের দোকানও জ্বালিয়ে দেওয়া দেওয়া হয়। পরে নদী পার হয়ে কেরানীগঞ্জ হয়ে মুন্সীগঞ্জ চলে যাই।”

বর্তমানে ব্যবসায়ী ৫১ নম্বর শাঁখারি বাজারের অমর সুর ১৯৭১ সালে ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী, প্রগোজ স্কুলের ছাত্র ছিলেন তিনি।

২৫ মার্চ  নিয়ে তিনি বলেন, “আমি শুনতে পেলাম জগন্নাথ হল ও রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পে পাক বাহিনী হামলা করেছে। সেখানে হামলা করে পুরান ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। রাতে আমি ও পরিবারের অন্য সদস্যরা বাসার ছাদে উঠি।

“রাত ২টার পর পাক বাহিনী আদালত এলাকায় আসে এবং তাদের গাড়িবহর সদরঘাট, কোতয়ালি থানা এলাকায় এবং বাবুবাজারে প্রবেশ করে আর শাঁখারিবাজারে একটি গাড়ি ঢোকে।”

চারদিকে তেমন আলো না থাকায় ছাদ থেকে বেশি কিছু দেখা যায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “শুধু গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম।”

পরদিন ভোরে শাঁখারিবাজারের পূর্ব পাশে রাস্তায় পাশে একটি পাগলের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন, পাশের রিকশা গ্যারেজের সামনে রিকশায় ছিল এক রিকশাচালকের মৃতদেহ।

“আর শাঁখারিবাজার সংলগ্ন বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে দেখি অন্তত দশজন পুলিশের মৃতদেহ ফাঁড়িতে পড়ে রয়েছে। সেখানে আহত এক পুলিশ সদস্যকে মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠানো হয়।”

২৬ মার্চ দুপুরে পাক বাহিনী শাঁখারিবাজারে আক্রমণ করে এবং বিভিন্ন বাসা থেকে নানা বয়সী মানুষকে ধরে এনে ৫২ নম্বর শাঁখারিবাজারে নিচতলায় ১৮ জনকে গুলি করে হত্যা করে।

কখন কোথায় হামলা

# ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ৮টার দিকে পাকিস্তানিসেনাবাহিনীর গাড়িবহর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হওয়ার খবর যায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে।

# রাত সাড়ে ৯টার দিকে পাক বাহিনীর গাড়িবহর শহরে ঢোকার খবর পান তারা।

# রাত ১১টার একটু আগে পাকিস্তান বাহিনীর গাড়িবহরচামেলিবাগের কাছাকাছি আসে,ডন স্কুলের ছাদে অবস্থান নেওয়াপুলিশের গুলিতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হন।

# ওই সময় পাক বাহিনী পিছু হটে পুলিশ হাসপাতালসহ বিভিন্ন দিকে অবস্থান নেয় এবং সাড়ে ১১টার দিকে ফের আক্রমণ করে।

# রাজারবাগের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলসহ বিভিন্ন হলে হত্যাকাণ্ড চালায় পাক হানাদার বাহিনী।

# এরপর হামলা হয় পুরান ঢাকায়; রাত ২টার পর পাক বাহিনী আদালত এলাকায় পৌঁছে।

# তাদের গাড়িবহর সদরঘাট, কোতয়ালি থানা এলাকা এবং বাবুবাজারে প্রবেশ করে, আর শাঁখারি বাজারে একটি গাড়ি ঢোকে।

# ফজরেরআযানের পর গোলাগুলির শব্দ কমতে শুরু করে।

# সকালে দেখা যায় লাশ আর লাশ।

 

অমর সুর বলেন, তার তিন বছর বয়সী খালাত ভাই বাবার কোলে ছিল। পাক হায়েনারা ওই শিশুকেও বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে।

৪০ নম্বর শাঁখারি বাজারের বাসিন্দা নীল কান্ত, ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার রঞ্জন বিশ্বাসও ঘরের ছাদ থেকে ওই রাতের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। ওই সময় ইসলামপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠিনক সম্পাদক ফজলুর রহমান পর্বতও একই বর্ণনা দেন।

তাদের সবার কথায় উঠে আসে, ওই রাতে পাকিস্তানি বাহিনী সবার আগে আক্রমণ করে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে, পরে সেখান থেকে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে এবং সবশেষে হামলা হয় পুরান ঢাকায়।

থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে সেনাদের প্রতিহত

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ২২ জন বেঁচে আছেন।

তাদের একজন নেত্রকোণার কেন্দুয়ার শাহজাহান মিয়া বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টার দিকে পাক বাহিনী রাজারবাগে আক্রমণ করে।

ওই সময় সঙ্গে সঙ্গে ওয়্যারলেসে মেসেজ দেন তিনি: ‘Base for all, East Pakistan police Keep note, very very important message for you’.

‘We are attacked by Pak army try to save yourselves… over and out’.

তিনি বলেন, “আক্রমণের পর থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে প্রায় ছয়শ পুলিশ সদস্য সম্মুখ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লাম পাক বাহিনীর সঙ্গে। রাত আড়াইটা পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা রাজারবাগে ঢুকতে না পেরে ক্ষীপ্ত হয়ে আরও ফোর্স নিয়ে এসে আক্রমণ করে। সারা রাত যুদ্ধ হয়।”

শুধু থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে যুদ্ধ করে তারা পেরে উঠছিলেন না। ওই রাতে নিহত হন প্রায় দেড়শ পুলিশ সদস্য।

শাহাজাহান জানান, তিনি ও মনির, আবু শামা, সালামসহ পাঁচজন ডন স্কুলের (বর্তমানে ইস্টার্ন প্লাস মার্কেট) উপরে উঠে যুদ্ধ করছিলেন।

তাদের সঙ্গের অন্য পুলিশ সদস্যরা পাইপ বেয়ে নিচে নামলেও তারা পাঁচজন নামতে পারেননি এবং পরদিন ভোরে গ্রেপ্তার হন।

তিনি জানান, ওই রাতে লড়াইয়ের পর প্রায় দেড়শ পুলিশ সদস্য পাক বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন এবং তাদের সবাইকে ব্যারাকে তৃতীয় তলার একটি কক্ষে রাখা হয়।

“দিন রাত অমানবিক নির্যাতন করা হত এবং ২৮ মার্চ আমাদের তখনকার পুলিশ সুপার ই এ চৌধুরীর জিম্মায় দিয়ে বলা হল, মিল ব্যারাকে যেতে। কিন্তু সেখানে দুই দিন থেকে ৩০ মার্চ গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণায় হেঁটে চলে যাই।”

ওই রাতে রাজারবাগে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়া কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের পীরপুরের আবু শামা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সে সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে অস্ত্রাগারে কর্মরত ছিলেন তিনি। কেউ অস্ত্র নিলে ও জমা দিলে তা এন্ট্রি করতেন। তার সঙ্গে আবুল কাশেম নামে আরেকজন কনস্টবল কর্মরত ছিলেন।

“২৫ মার্চের আগেই আমরা বুঝতে পারি যে পাক সেনারা রাজারবাগ আক্রমণ করতে পারে। কনস্টেবলরা গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে এই নিয়ে আলোচনা শুরু করে এবং কী করা যায় তা নিয়ে ভাবতে শুরু করে। ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ৮টার দিকে খবর আসল যে, পাক সেনারা গাড়িবহর নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হচ্ছে।

 

“এ সময় কনস্টবল আবুল কাশেম দুটি অস্ত্রাগারের চাবি তখন দায়িত্বে থাকা পরিদর্শক মফিজ উদ্দিনের কাছে জমা দিয়ে পালিয়ে যায়। অস্ত্রাগারের কোনো চাবি না পেয়ে কয়েকজন মিলে মফিজ উদ্দিন স্যারের কাছে গিয়ে চাবি চাইলাম। কিন্তু মফিজ স্যার বলল যে, আমার কাছে কোনো চাবি নাই।

“পরে এক রকম জোর করে তার কাছে থেকে একটি অস্ত্রাগারের চাবি নিয়ে সেটি খুলে অস্ত্র নেওয়া শুরু করি, আর আরেকটি অস্ত্রাগার শাবল দিয়ে ‍খোলা হয়।”  

অস্ত্রাগারে থ্রি নট থ্রি রাইফেল ছাড়াও ‘মার্ক ফোর’ নামে আরেকটি অস্ত্র ছিল বলে জানান তিনি।

শামা বলেন, রাত সাড়ে ৯টার দিকে তেজগাঁও থেকে খবর আসে যে, সেনানিবাস থেকে গাড়িবহর বের হয়ে ঢাকায় ঢুকছে।

“এই খবর পাওয়া মাত্রই পুলিশ সদস্যরা অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে ডন স্কুলের ছাদে ও মালিবাগে অবস্থান নেয়। রাত ১১টার একটু আগে পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়িবহর চামেলিবাগের কাছাকাছি এলে ডন স্কুলের ছাদ থেকে গুলি করা হয়। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হন।”

ওই সময় পাক বাহিনী পিছু হটে পুলিশ হাসপাতালসহ বিভিন্ন দিকে অবস্থান নেয় এবং রাত সাড়ে ১১টার দিকে ফের আক্রমণ করে।

সারা রাত লড়াইয়ের পর তিনিও ডন স্কুলের ছাদ থেকে গ্রেপ্তার হন। মিলব্যারাকে যোগ দেওয়ার শর্তে পুলিশ সুপারের জিম্মায় দেওয়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে তিনিও ছিলেন।

“মিলব্যারাকে যাওয়ার সময় পালিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসি এবং পরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিই।”

২৫ মার্চ রাতে রামপুরা টেলিভিশন ভবনের কাছে দায়িত্ব পালনকালে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ১৫ বাঙালি পুলিশ সদস্যের মধ্যে ছিলেন ফরিদপুরের জহিরুল হক জহির।

তিনি বলেন, রাত সাড়ে ১১টার দিকে রফিক নামে পাকিস্তান আর্মির একজন সেকেন্ড লেফটেন্যান্টের নেতৃত্বে তাদের বন্দি করে মারধর শুরু করা হয়। রাত ১টার দিকে তাদের দিকে এলোমেলো গুলি চালানো হয়।

একটি গুলি তার বাঁ হাতে লাগে জানিয়ে তিনি বলেন, গুলিতে হালিম নামে একজন পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলেই মারা যান।

গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পালিয়ে রাতে ওই এলাকার একটি নির্মাণাধীন ভবনে আশ্রয় নেন জহির।

পরিস্থিতি বুঝতে না পেয়ে পরদিন (২৬ মার্চ) সকালে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে এসে আবার বন্দি হন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে।

তিনি বলেন, পাকিস্তানি সেনারা অন্য আরেক পুলিশ সদস্য ও তাকে পুকুর পাড়ে একটি ঝোঁপের মধ্যে বেঁধে রাখে।পরদিন ছেড়ে দিলে কেরানীগঞ্জ হয়ে ফরিদপুর চলে যান তিনি।

ফরিদপুর মেডিকেলে চিকিৎসা নিয়ে ৩ জুন ৮ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন বলে জানান জহির।

পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২৫ মার্চ ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুমিল্লা, খুলনা, পাবনা, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, বগুড়া, ময়মনসিংহ ও যশোরসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব জেলা পুলিশ লাইন্সে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী।