২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি দিল সংসদ

একাত্তরের ২৫ মার্চে রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞে নিহতদের স্মরণে ‘গণহত্যা দিবস’ পালনের প্রস্তাব জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 March 2017, 04:03 PM
Updated : 11 March 2017, 06:39 PM

প্রায় সাত ঘণ্টা আলোচনার পর সংসদে সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদসহ ৫৬ জন সংসদ সদস্য এই আলোচনায় অংশ নেন।

শনিবার বিকাল ৩টায় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু পর প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন জাসদের সংসদ সদস্য শিরীন আখতার।

প্রস্তাবে বলা হয়, “সংসদের অভিমত এই যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকে স্মরণ করে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হউক এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হউক।”

আলোচনা শেষে স্পিকার শিরীন শারমিন প্রস্তাবটি ভোটে দিলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। এসময় সকল সংসদ সদস্য টেবিল চাপড়ে তাতে সমর্থন জানান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলোচনায় অংশ নিয়ে এই প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, “এই গণহত্যার প্রমাণ লাগে না। বিশ্বের বিভিন্ন প্রত্রিকায় এসেছে- কীভাবে গণহত্যা হয়েছে।”

কার্যপ্রণালী-বিধির ১৪৭ বিধির আওতায় এই প্রস্তাব আনেন জাসদের সংসদ সদস্য শিরীন। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনার জন্য যে কোনো সংসদ সদস্য ১৪৭ বিধিতে প্রস্তাব আনতে পারেন।

সংসদে গৃহীত এই প্রস্তাবের বিষয়ে এবার সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাহী বিভাগ।

২৩ বছরের শোষণ থেকে বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের শ্বাসরোধ করতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের সেই অভিযানে কালরাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় চালানো হয় গণহত্যা।

২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান।

অবশ্য তার আগেই ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় বাঙালির অবিসংবাদিত এই নেতা বলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

কার্যত সেটাই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা, যার পথ ধরে কালরাতের পর শুরু হয় বাঙালির প্রতিরোধ পর্ব।

নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং জাতির অসাধারণ ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, “এটা গণহত্যা। কারণ, তারা বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলো। এই রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা। এই রক্তকে অবমাননা করলে এই স্বাধীনতাকে অবমাননা করা হবে, বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা করা হবে।”

“স্বাধীনতার ঘোষণা এসেছে অনেক আগে ৭১’র সাতই মার্চে।”

মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত এই সেনা কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশে এলেও লড়াইয়ে অংশ না নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন বলে সমালোচনা রয়েছে। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল তারও প্রধান ছিলেন এইচএম এরশাদ।

এবিষয়ে সামরিক শাসক এরশাদ বলেন, “আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারিনি। ৬৯ সালে আমি লে. কর্নেল হই। ১৯৭০ সালের ২৯ ডিসেম্বর করাচিতে বদলি করা হলো। ৭১ সালে আমি একমাস ছুটি নিয়েছিলাম। ফেব্রুয়ারিতে করাচিতে ফিরলাম। মার্চে যুদ্ধ শুরু হলো।”

“তখন জেনারেল ওসমানী সাহেবকে ফোন করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, এখনো মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি। ইউ আর অ্যা সোলজার, ইউ মাস্ট ফলো দি অর্ডার।”

বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জানতে হবে। নতুন প্রজন্মে জানাতে হবে।

“বলাবাহুল্য ঘোষক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটা নিয়ে বিতর্ক বন্ধ করতে হবে। আমি উনাকে কাছ থেকে দেখেছি। আমার জীবন ধন্য। সাত মার্চের ভাষণ আমাদের মনের মধ্যে ছিলো।”

আলোচনায় অংশ নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, “বিএনপি নেত্রী সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আসলে শহীদের সংখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। এমনকি মওদুদীর ছেলেও এক সাক্ষাৎকারে  জামায়াতের অফিসিয়াল প্রকাশনার উদ্ধৃতি দিয়ে  বলেছেন, একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বাংলাদেশে নিহতের সংখ্যা ৩৫ লাখ। এই সংখ্যা নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলে তাদের ধিক্কার জানাই।”

২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের প্রস্তাবটি সমর্থনের পাশাপাশি ১ ডিসেম্বরকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব দেন আওয়ামী লীগের এই জ্যেষ্ঠ নেতা।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, “পাকিস্তানিরা শুধু একাত্তরে আমাদের ওপর নয়, এখনও গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে বেলুচিস্তানে। প্রস্তাবটি সমর্থন করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে এ গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে সরকারকে তৎপর হওয়ার আহবান জানান।”

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, দেশে এখনও পাকিস্তানের প্রেত্মাতা রয়েছে। বাংলাদেশে আর কখনও যাতে স্বাধীনতাবিরোধীরা ক্ষমতায় আসতে না পারে সেজন্য এই দিবস পালন করতে হবে।

আলোচনায় আরও অংশ নেন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আমির হোসেন আমু, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ  নাসিম,  মহীউদ্দিন খান আলমগীর, মুহাম্মদ ফারুক খান, আব্দুল মতিন খসরু, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, শওকত আলী, আলী আশরাফ প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজ, দীপু মনি, আব্দুর রহমান, আব্দুল মান্নান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম, নুরুল ইসলাম সুজন, কামাল আহমেদ মজুমদার, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক,  সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, এ বি তাজুল ইসলাম, ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু,  নুরুল  মজিদ মাহমুদ হুমাযুন, পঞ্চনন বিশ্বাস, এ টি এম ওয়াহহাব, বজলুল হক হারুন, মনিরুল ইসলাম, সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য ফজিলাতুন নেসা বাপ্পী, নুরজাহান বেগম, আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী ও কাজী রোজী।

জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, ফখরুল ইমাম, নুরুল ইসলাম ওমর, জাসদের মইনউদ্দীন খান বাদল, ওয়ার্কার্স পার্টির ফজলে হোসেন বাদশা, সংরক্ষিত আসনের হাজেরা খাতুন, তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী, বিএনএফ’এর আবুল কালাম আজাদ, স্বতন্ত্র সদস্য সাংসদ আব্দুল মতিন ও তাহ্জীব আলম সিদ্দিকীও প্রস্তাবের উপর বক্তব্য দেন।