চ্যাম্পিয়ন মেয়েরা হবে ‘ট্যাবু ভাঙার সাহস’

সাফে ইতিহাস গড়ে বীরবেশে দেশে ফেরা মেয়েদের অর্জনকে নারীদের ঘিরে থাকা কাচের দেয়াল ভাঙার অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখছেন দেশের কীর্তিমান নারীরা।

কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Sept 2022, 07:42 PM
Updated : 21 Sept 2022, 07:42 PM

নারী ফুটবলে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জয় করে নেপাল থেকে দেশে ফেরা সাবিনা খাতুন আর তার দল যখন ছাদ খোলা বাসে ট্রফি হাতে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন আর শুভেচ্ছার স্রোতে ভাসতে ভাসতে বাফুফের দিকে যাচ্ছিলেন, তখনও ফেইসবুকে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছিলেন খেলার মাঠের পোশাক নিয়ে, মেয়েদের এসব খেলায় ধর্মনাশের কষ্টের কথাও কারও কারও পোস্টে আসছিল।  

এমন অনেক তীর্যক মন্তব্য, অশালীন বাক্যবাণ আর সামাজিক পুলিশের বাধা পেরিয়েই দেশকে শিরোপার গৌরব এনে দিতে পেরেছেন কলসিন্দুরের মারিয়া, শিউলি আর রাঙামাটির ঋতুপর্ণারা। কাঠমান্ডুতে ফাইনালের আগে ফেইসবুকে সে কথাই লিখেছিলেন সানজিদা আখতার। 

তিনি বলেছিলেন, “যারা আমাদের এই স্বপ্নকে আলিঙ্গন করতে উৎসুক হয়ে আছেন, সেই সকল স্বপ্নসারথিদের জন্য এটি আমরা জিততে চাই। নিরঙ্কুশ সমর্থণের প্রতিদান আমরা দিতে চাই। ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনী কে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই।

“আমাদের এই সাফল্য হয়তো আরো নতুন কিছু সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়া পেতে সাহায্য করবে। অনুজদের বন্ধুর এই রাস্তাটুকু কিছু হলেও সহজ করে দিয়ে যেতে চাই।”

সকল কাঁটা ধন্য করে, নেপালে ইতিহাস গড়েই বুধবার বীরবেশে দেশে ফিরেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। বিমানবন্দর থেকে তাদের আনন্দযাত্রায় মাথার ওপর ছিল উন্মুক্ত আকাশ।

নারী ফুটবলারদের এই অর্জনকে সমাজের ট্যাবু আর নারীদের ঘিরে থাকা কাচের দেয়াল ভাঙার অনুপ্রেরণা হিসেবেই দেখছেন অধিকার কর্মী মালেকা বানু।

তার ভাষায়, নারী ফুলবল দলের এই শিরোপা জয় শুধু খেলার মাঠের সাফল্য নয়, সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়ারই বড় উদযাপন।

“মেয়েরা যত এগিয়ে যাচ্ছে, তাদের পিছনে টেনে ধরার একটা প্রবণত রয়েছে। সেই রকম প্রতিকূল পরিবেশে, তারা যে পর্যায়ে গেছে, সেটা শুধু নিজেদের জন্য নয়। তারা দেশের জন্য বড় অর্জন বয়ে এনেছে। তারা একটা খোলা বাসে আসতে চেয়েছে। মানে তারা বদ্ধ ঘরে থাকতে চায় না, পৃথিবীটা তাদের জন্য খোলা হোক- সেটা তারা চায়।”

সমাজের নানা অঙ্গনের কীর্তিমান নারীরা বলছেন, মেয়েরা যে প্রতিকূল পরিবেশেও এগিয়ে যেতে পারে, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে সে উদাহরণই তৈরি করেছে বাংলাদেশের মেয়েরা। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, “যে গ্রামগুলো থেকে নারী ফুটবলাররা এসেছে, সেসব জায়গায় অনেক কুসংস্কার রয়েছে। সমাজ কাঠামো অনেক দুর্বল। যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে, তারা ফতোয়া দেয়।

“এইসব এলাকার মানুষকে আরও সোচ্চার হতে হবে। তারা দেশকে যে শিরোপা এনে দিয়েছে, তাতে বিশ্বে বাংলাদেশ আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াল।”

নারী ফুটবলারদের কীর্তির প্রশংসার মধ্যেই অনেকে যে তাদের পোশাক নিয়ে সমালোচনা করছে, সেটা ‘নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার একটি পুরনো এবং বড় অস্ত্র’ বলেই মন্তব্য এ অধ্যাপকের। 

“স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমরা এ ধরনের কথা কেন বলব? তারা তো অশালীন পোশাক পরে খেলেনি, খেলার যে পোশাক সেটাই পরেছে। পোশাকের কথা বলে তাদের খেলা থেকে বিরত রাখার জায়গায় বাংলাদেশ এখন আর নেই।”

নারীদের নিয়ে সমালোচনা না করে গঠনমূলক কাজ করে তাদের এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গী হতে পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।

সাফ জয়ী এই দলে ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রামেরই আটজন, গত কয়েক বছর ধরেই তারা মেয়েদের ফুটবলের ধারাবাহিক সাফল্যের রচয়িতা। আছে পাহাড়ের দুই কন্যা, আছে ঠাকুরগাঁও আর সাতক্ষীরার মেয়েরাও।

সাফল্যের উদযাপনের সঙ্গে সঙ্গে খেলার মাঠে টিকে থাকার জন্য অভাব আর কষ্ট সয়ে তাদের লড়াই করার গল্পগুলোও এখন সংবাদমাধ্যমে আসছে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে এ দলের গোলরক্ষক রূপনা চাকমাকে ঘর করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। জাতীয় দলের সবার জন্য পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে বাফুফে। 

বিজয়ী মেয়েরা বুধবার বিকালে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে যখন নামলেন, তখন তাদের চেহারায় ক্লান্তি ঢেকে রেখেছিল চওড়া হাসি। বীরের অভ্যর্থনা পেয়ে অভিভূত বাংলাদেশ অধিনায়ক সাবিনা খাতুন গর্বিত কণ্ঠে তাদের স্মরণীয় সাফল্য উৎসর্গ করলেন দেশের মানুষকে।

তিনি বললেন, “বাংলাদেশের মেয়েদের, বাংলাদেশের ফুটবল যে আপনারা এত ভালোবাসেন, এসব দেখে আমরা অনেক অনেক গর্বিত।”

Also Read: দক্ষিণ এশিয়ার সেরা বাংলাদেশের অদম্য মেয়েরা

Also Read: ফুলেল শুভেচ্ছায় চ্যাম্পিয়ন মেয়েদের বরণ

Also Read: মেয়েদের ফুটবলে সাফ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ, পাহাড়ে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস

Also Read: মেয়েদের সাফ ফুটবল জয়, আনন্দে ভাসছে কলসিন্দুর

কমনওয়েলথ শুটিং ও সাফ গেমসে সোনাজয়ী শুটার সাবরিনা সুলতানাও এরকম উদযাপনের মুহূর্ত বাংলাদেশকে এনে দিয়েছেন একসময়। তবে তিনিও মনে করেন, দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট অনেক বেশি অনুপ্রেরণা দেবে এ দেশের নারীদের।

“ফুটবলে এতো বড় একটা অর্জন ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। আমি নরমালি খেলা দেখি না, কিন্তু ওদের খেলা দেখেছি। অনেক বেশি খুশি হয়েছি এই জয়ে।”

“আমাদের নারীদের ইগনোর করা হয় সবক্ষেত্রে। সেক্ষেত্রে ওরা যে জয় এনেছে, এটা অনেক বড় পাওয়া। বিশেষ করে এই নারীরা অনেক সংগ্রাম করে এ পর্যায়ে এসেছে। এই অর্জনের ফলে নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাবে।”

নারী ফুটবলারদের জন্য আরও সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশের শুটিং ইতিহাসের অন্যতম সফল এই তারকা বলেন, “ওদের আরও বেশি প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ফিটনেস বাড়াতে হবে। ওদের যেন পেছনে তাকাতে না হয়, সেদিকে সরকারেরই লক্ষ্য রাখতে হবে।”

২০১৮ সালের এশিয়া কাপ টি টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল চ্যাম্পিয়ন হয়। এবার ফুটবলে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হওয়ার পর জাতীয় দলের ক্রিকেটার সাথিরা জাকির জেসি মনে করিয়ে দিলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বড় দুটি ট্রফি কিন্তু নারীদের হাত ধরেই এসেছে।

Also Read: বীর মেয়েদের আনন্দযাত্রায় পথে পথে উৎসব

Also Read: ক্রীড়ায় আগ্রহী মেয়েদের পাশে দাঁড়ান: পরিবারকে সাবিনার বোন

Also Read: ফুটবলের মেয়েদের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত ক্রিকেটের মেয়েরা

“এই জয় আমাদের জন্য অনেক বেশি অনুপ্রেরণার, বড় পাওয়ার। এর ফলে নারীদের খেলার ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন আসার কথা। কারণ আগে অনেকেই জানত না বাংলাদেশের নারীরা ফুটবল বা ক্রিকেটে এতটা ভাল। কারণ সবগুলো খেলা প্রচার হয় না। মানুষ জানত না, এখন আমার কাছে মনে হয় সবাই জানে।”

এই জয় ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের আসার পথকে সহজ করবে বলেই আশা করছেন জেসি। তিনি বলেন, “মেয়েরাও যে ভাল খেলতে পারে, সেটা প্রমাণ হয়ে গেল। খেলার মাধ্যমে যে ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব, সেটা এখন অভিভাবকরা বুঝতে পারবেন। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে যারা খেলতে দেন না, এত বড় সাফল্যের পর তাদের অনেকেই আগ্রহী হবেন।

“ভাল কিছু করলে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে, সফলতা অনেক পথ খুলে দেয়। ভবিষ্যতে যারা আসবে, তাদের জন্য সুবিধা হবে। এখন যারা খেলছে, তাদের লক্ষ্যটা ঠিক হয়ে যাবে। অনেকে খেলতে গিয়ে হতাশায় পড়ে যে ভালো পর্যায়ে যেতে পারবে কিনা। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে মেয়েরা যত ভালো খেলবে, দেশে তাদের সুযোগ-সুবিধা তত বাড়বে।”

নারীরা এখনও পুরুষ ক্রীড়াবিদদের তুলনায় অনেক কম সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, সেদিকে সরকারকে মনোযোগ দিতে বললেন ক্রিকেটার জেসি।

একই কথা বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাদেকা হালিম। তিনি মনে করিয়ে দিলেন, এই দলের অনেকেই ‘খুব পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী’ থেকে আসা, জাতীয় পর্যায়ে এসেও তারা অনেক কম পারিশ্রমিক পাচ্ছে, বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।

“তারা যে সংগ্রাম করে এসেছে, সেটা আমরা বুঝব না। খোলা বাসে দেশে নেমে তারা তাদের অর্জনটা বাংলাদেশের মানুষের হাতে তুলে দিতে চেয়েছে। তারা প্রমাণ করেছে- কিছু একটু সুবিধা পেলে অনেক কিছু করতে পারে। সেখানে আমরা পুরুষদের ঢেলে দিচ্ছি।”

অনেক অভিভাবকের কাছে পরিবারের মেয়েরা এখনও ‘বোঝা’, সাফের এই জয় তাদের সেই মানসিকতায় পরিবর্তন এনে দেবে বলে সাদেকা হালিমের প্রত্যাশা।

আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহফুজা খানম মনে করেন, কাঠমান্ডুর এই জয়রথ শুধু ক্রীড়াঙ্গনে নয়, সবক্ষেত্রেই নারীদের সাহস জোগাবে। বাবা-মায়েরা এখন উৎসাহিত হবেন, মেয়েদের খেলার প্রতি ঝোঁক থাকলে তাদের জন্য সুযোগ করে দেবেন।

“মেয়েরাও যে পারে, এটাও প্রমাণ করল তারা। এটা বিশাল একটা অনুপ্রেরণার জায়গা হয়ে থাকবে। সাইকোলজিক্যালি এই বিষয়টি বুঝতে সহযোগিতা করবে যে, ধর্ম এক জিনিস আর কোনো ক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা আরেক জিনিস।”

নারীদের পোশাকের সমালোচনাকারীদের উদ্দেশে এই অধ্যাপক বলেন, "কোনো কিছু অর্জন করাটাই বড়। সেই অর্জন করার জন্য পোশাক কোন বাধা হয়ে আসতে পারে না।”

অনেক আশা, অনুপ্রেরণা ও আনন্দের এই জয় এ দেশের সমাজের এগিয়ে যাওয়ার পথে উল্লেখযোগ্য একটি অর্জন হয়ে থাকবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।

তিনি বলেন, “আমরা মাঝে মাঝে অনেক হতাশ হয়ে যাই যে, সমাজ অনেক পিছিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই সময়ে এসে নারীদের এই অর্জন অনেক বেশি ভালো লাগার।

“এখানে পাহাড়ের জনগোষ্ঠীর অনেক মেয়েরা আছেন। তারা তো অনেক পিছিয়ে পড়া। কিন্তু তাদের কারণে আজ দেশের পতাকা সম্মানের সঙ্গে উড়ল। এই নারী সমাজকে যোগ্য মর্যাদা, সম্মান দিতে হবে।”