বীর মেয়েদের আনন্দযাত্রায় পথে পথে উৎসব

শিরোপা তুলে ধরে, হাত নেড়ে, জাতীয় পতাকা উড়িয়ে অভিনন্দনের জবাব দেন সাবিনারা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Sept 2022, 02:42 PM
Updated : 21 Sept 2022, 02:42 PM

বিজয়ীদের বরণে ছাদখোলা বাস প্রস্তুত ছিল আগেই; পথে পথে অপেক্ষায় ছিলেন সমর্থকরাও। সেই অপেক্ষা উৎসবে রূপ নিল দুপুরের পর। শিরোপা হাতে বিজয়ীদের নিয়ে সাজানো দ্বিতল বাসটি বিমানবন্দর থেকে এগোতে শুরু করলে শুরু হল অভিবাদনের বৃষ্টি।  

গলা ফাটিয়ে, পতাকা নাড়িয়ে, ব্যানার হাতে পথে পথে নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী দলের সদস্যদের বরণ করেছেন, সংবর্ধনা জানিয়েছেন তারা।

সমর্থকদের এ মিছিলে ছিলেন সব বয়সের, সব শ্রেণির মানুষ। বিমানবন্দর থেকে সন্ধ্যায় মতিঝিল পৌঁছানো পর্যন্ত পুরো সড়কজুড়েই ছিল উৎসবের এ দৃশ্য। পাশের ভবনের ছাদ থেকেও হাত নেড়ে, উঁকি দিয়ে হাজারো মানুষ বীর এই নারীদের জানিয়েছেন ভালোবাসা।

পুরো পথেই বাসটি দৃশ্যমান হতেই স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ। শিরোপাজয়ী দলকে কাছ থেকে দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তারা। পুরো সড়কজুড়েই জাতীয় পতাকা, ব্যানার হাতে নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন দলকে বরণ করেন তারা। এ জয়যাত্রায় ছাদখোলা বাস ঘিরে পথে পথে ছিল সব বয়সী উৎসুক জনতার ঢল।

Also Read: দক্ষিণ এশিয়ার সেরা বাংলাদেশের অদম্য মেয়েরা

নেপালে নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে বুধবার দুপুর দুইটার একটু আগে ঢাকায় পা রাখে বাংলাদেশ দল। বিমানবন্দরে নানা আয়োজনে তাদেরকে বরণ করে নেওয়া হয়।

এরপর বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে সাজিয়ে রাখা ছাদখোলা বাসে উঠে যান দলের সবাই। ধীরগতিতে বাসটি এগোতে শুরু করলে আগেই সড়কে অপেক্ষায় থাকা অনেকে বাসের পেছনে পেছনে ছুটছেন।

চ্যাম্পিয়নদের স্বাগত জানিয়েছেন গানের তালে তালে। কেউ ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে, কেউ চিৎকার করছে, কেউবা ধরছে স্লোগান। আবার কেউ ছাদখোলা গাড়ির সঙ্গে তুলেছেন সেলফি। প্রায় পুরো যাত্রাপথে এ দৃশ্য দেখা গেছে।

গাড়ি চলছে ধীর গতিতে, সমাগম সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের। মোড়ে মোড়ে হাত নাড়িয়ে গলা ফাটিয়ে তারা অভিবাদন জানান বিজয়ী মেয়েদের। শিরোপা তুলে ধরে, হাত নেড়ে, জাতীয় পতাকা উড়িয়ে অভিনন্দনের জবাব দেন সাবিনারা।

Also Read: এই ট্রফি বাংলাদেশের সব মানুষের : সাবিনা

তাদেরই একজন ইউসুফ, যিনি তিন বছরের সন্তান সিয়ামকে নিয়ে বাড্ডা থেকে বনানীতে এসেছেন সাবিনাদের টানে। সড়কে অপেক্ষারত ইউসুফ বলেন, আনন্দের ভাগাভাগি করতে ছেলেকে নিয়ে করছি। ছাদখোলা গাড়িতে ওদের আসার কথা জানার পর থেকে বায়না ধরেছে ছেলে। এয়ারপোর্ট যেতে পারব না বলে বনানীতে এলাম। বেশ ভালো লাগছে।

এদিন ঢাকা সড়ক বিভাগ ভবনের সামনে দুপুর থেকেই সাফ বিজয়ীদের শুভেচ্ছা ও অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করছিলেন রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা।

Also Read: মেয়েদের সাফ ফুটবল জয়, আনন্দে ভাসছে কলসিন্দুর

Also Read: সাফজয়ী রূপনা চাকমাকে ঘর দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী কিংকিং মারমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "বাংলার বাঘিনীদের একনজর দেখার জন্য আমরা এখানে দুপুর থেকে দাঁড়িয়ে আছি। অনেক এক্সাইটেড লাগছে। তাছাড়াও ফুটবলারদের মধ্যে আদিবাসী গোষ্ঠীর নারীরাও আছেন। এটা আমার নিজের জন্যই অনেক গর্বের বিষয়।"

সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে অপেক্ষায় থাকা তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী মলি তালুকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "দেশের জন্য এতবড় সাফল্য নিয়ে আসছেন আমাদের নারী ফুটবলাররা। তাদের নিয়ে আমরা গর্বিত। দুপুরের রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতেও বিন্দুমাত্র কষ্ট কাজ করছে না। আমরা ভীষণভাবে আপ্লুত।"

বিজয় স্মরণীতে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশদের বেশ উৎসবমুখর অবস্থায় দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেল।

এ মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা অয়ন রহমান নামে এক দোকানকর্মী বলেন, “আমি ফার্মগেটে এক দোকানে কাজ করি। বসের কাছে বলে কিছুক্ষণের জন্য আসছি। ছাদখোলা বাস দেখার জন্য।”

এ মোড়ে নানা শ্রেণি, পেশা ও বয়সের মানুষের সরগরম উপস্থিতির মধ্যে বিজয়ীদের জন্য অপেক্ষায় থাকা তৃতীয় লিঙ্গের রেশমা বাসে অর্থ না তুলে রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

তিনি বলেন, “ওদের একটু দেখার জন্য এতটুকু কষ্ট করাই যায়।”

শহীদ বীর উত্তম লেফটেন্যান্ট আনোয়ার গার্লস কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান স্বর্ণা বলেন, “হ্যাঁ, অবশ্যই সাফ জেতা আমাদের জন্য অনেক গর্বের বিষয়। সেই ২০০৩ সালের পর থেকে আর কোনো ট্রফি আসে নাই। এত বছর পর সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনুভূতিটা আসলেই অন্যরকম।

“এর মাধ্যমে আমাদের নারী ফুটবল আরও এগিয়ে যাবে। কিন্তু একটা বিষয় হল আমাদের মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় অনেক কম সুযোগ সুবিধা, বেতন পায়; যেটা আসলেই দুঃখজনক।”

ছাদখোলা বাসে সংবর্ধনার বিষয়ে বিএএফ শাহীন কলেজের শিক্ষার্থী রাকিব হোসেন বলেন, “এই বাস তারা ডিজার্ভ করে। তারা যে ট্রফি এনে দিছে এজন্য অবশ্যই তারা এই বাস ডিজার্ভ করে। আমরা চাই সরকার নারী ফুটবল টিমের প্রতি আরও মনোযোগ দিক, যাতে তারা ভালো খেলতে পারে।“

ছাদখোলা বাসের যাত্রার আগে বিমানবন্দরে উৎসুক জনতার সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন ক্রিকেট ভক্ত শোয়েব আলী।

তিনি বলেন, “আমি সব সময় ছেলেদের ক্রিকেট খেলা দেখতে যাই। মেয়েদের খেলা কম দেখি, এখন থেকে মেয়েদের আর কোনো খেলা দেখা মিস করবো না। এমন পারফরমেন্স দেখিয়েছে, এটা অবিশ্বাস্য।

“মেয়েরা যদি ছেলেদের ক্রিকেটের মত শতভাগ সুযোগ-সুবিধা পায়, তাহলে খুব তাড়াতাড়ি বাংলাদেশের মেয়েরা ফুটবল বিশ্বকাপে খেলবে।”

সব পথ মিশেছে মতিঝিলে

বিমানবন্দর থেকে বিজয়ী মেয়েদের নিয়ে ছাদখোলা বাস কাকলি হয়ে, মহাখালী ফ্লাইওভার দিয়ে শহীদ জাহাঙ্গীর গেইট হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে দিয়ে বিজয় সরণীতে পৌঁছায়।

সেখান থেকে তেজগাঁও ফ্লাইওভার পেরিয়ে মৌচাক, কাকরাইল, ফকিরেরপুল, আরামবাগ ও শাপলা চত্বর হয়ে মতিঝিলে বাফুফে ভবনে পৌঁছায় বাসটি। সবপথ পেরিয়ে মতিঝিল পৌঁছাতে বেজে যায় সন্ধ্যা ৭টা।

বাফুফের সামনের রাস্তায় বিজয়ীদের দেখতে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অর্ক সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আমরা উচ্ছ্বসিত, অনেক ভালো লাগছে। যখন বাংলাদেশের একটি গোষ্টী মেয়েদের চার দেয়ালে বন্দি রাখতে এবং কয়েকটি নির্দিষ্ট পোশাকর মধ্যে আবদ্ধ রাখতে উঠে পড়ে লেগেছে, ঠিক সেই সময় নারী ফুটবলাররা দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। যখন তারা বিশ্বজয় করবে তখন ওই শ্রেণির মানুষের মুখে সমুচিত জবাব হবে।

“নারী ফুটবলারদের এই অর্জন বাঙালি মেয়েদের অর্জন, আমাদের গর্ব।"

মতিঝিল পোস্ট অফিস কলোনি থেকে আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার্থী আয়রুন্নাহার তনয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "অনেক বেশি এক্সাইটেড, তাই বাসা থেকে বের হয়ে আড়াই ঘন্টা ধরে এখানে (ফকিরাপুল) দাঁড়িয়ে আছি। তাদের এই অর্জন মেয়েদের খেলায় উৎসাহিত করবে। আসলেই তাদের সামনাসামনি দেখব, এটা খুশি লাগছে।"

মতিঝিলের বাসিন্দা জিয়াউর রহমান জিয়া ছেলে রাফিউল ইসলাম ও মেয়ে তাসনিম সোনারা নাদিরাকে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ দাড়িয়ে আছেন ফকিরাপুলে।

তিনি বলেন, "আমার ছেলে মেয়েদের উৎসাহ দিতেই নিয়ে এসেছি। তারা নারী খেলোয়ারদের এই অর্জনে আনন্দিত।"

বাফুফের সামনে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তাসলিম রিমা বলেন, "দুপুর দুইটা থেকে দাঁড়িয়ে আছি। উনাদের দেখে আমাদের উৎসাহ বাড়বে। আমি খেলাধুলা করি। এখন আরও বেশি উৎসাহ পাচ্ছি।“

সাফ ফুটবলে এবার ম্যাচের পর ম্যাচ অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখিয়ে দুর্দান্ত ধারাবাহিকতায় শিরোপা জিতে নেয় বাংলাদেশের মেয়েরা।

আগের সব আসরের চ্যাম্পিয়ন ভারতকে গ্রুপ পর্বে উড়িয়ে দেওয়ার পর সোমবার ফাইনালে তারা হারায় স্বাগতিক নেপালকে।