উৎসবের এ দিনে একটি দলে ছিলেন পরিবারের ১৬ জন, সঙ্গে তিন প্রজন্মের সদস্য; যারা মেট্রোর ছোট্ট ভ্রমণে ভেসেছেন উপভোগের আনন্দে।
Published : 22 Apr 2023, 10:40 PM
"ওহ ফাইন! দারুণ! খুবই ভালো! বাচ্চা-বয়স্ক -তরুণ সবাই এনজয় করছে। উঠলাম আর চলে আসলাম।"
বাংলাদেশে মেট্রো রেল যুগে প্রথম ঈদের দিন ঢাকাবাসীর নতুন এ বাহনে চড়ে মাঝবয়সী আবু বকরের অনুভূতির প্রকাশ ছিল এমনই।
শনিবার উৎসবের আমেজে শেওড়াপাড়া স্টেশন থেকে ১৬ জনের লম্বা বহর নিয়ে মেট্রোতে চড়ে যেন আনন্দের ফোয়ারায় ভেসেছেন তিনি। তাদের সঙ্গী পরিবারের তিন প্রজন্মের সদস্যরাও বেজায় খুশী৷
তারা মেট্রোতে উঠে গেছেন উত্তরার উত্তর স্টেশনে; সেখানে অনেকটা সময় ঘোরাঘুরির পর দিনের শেষ মেট্রোতে চড়ে আবার ফিরেছেন মিরপুরের পথে নিজেদের গন্তব্যে।
আবু বকরের ৮৩ বছরের বাবা সিরাজউদ্দিন আহমেদ এবং ৬৬ বছরের মা মেহেরুন্নেসা বেগমও ছিলেন তাদের সঙ্গে।
সিরাজউদ্দিন এর আগেও মেট্রোতে চড়েছেন, তবে বিদেশে। দেশের মেট্রোতে প্রথম চড়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, "শর্টকার্ট জার্নি, বেশ ভালো। শৃঙখলাটা বাড়লে আরও ভালো হবে।"
তার স্ত্রী মেহেরুন্নেসার মেট্রোতে এবারই প্রথম। বললেন, "নাতি-নাতনিকে নিয়ে নতুন এই বাহনে চড়লাম। হঠাৎ করে চলে আসছি। ভালো লাগছে৷" তার নাতি তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া জাহিনের মেট্রো চড়ে 'খুবই মজা লেগেছে’।
কর্মব্যস্ত রাজধানীবাসীর ঈদ আনন্দ উপভোগে নতুন এ অনুষজ্ঞের অভিজ্ঞতা নিতে আবু বকরের মতো হাজারো মানুষ আনন্দ কুড়িয়েছেন মেট্রোতে চড়ে।
পরিবার, বন্ধু, প্রিয়জন কিংবা একাকি এসে উপভোগে মেতেছেন; ছবি, সেলফি ও ভিডিওতে ধরে রেখেছেন আনন্দঘন মুহূর্তের স্মৃতি৷
ঈদের ছুটিতে ঢাকায় মেট্রো চালু রাখার সিদ্ধান্ত আগেই জানিয়েছিল মেট্রো রেল পরিচালনাকারী ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এন সিদ্দিক গত ১৭ এপ্রিল জানিয়েছিলেন, ঈদের ছুটিতে ২০ থেকে ২৩ এপ্রিল মেট্রো রেল চলবে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত। এর মধ্যে যেদিন ঈদ হবে, সেদিন সকালের বদলে দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলবে ট্রেন।
সেই খবর জেনেই ঈদের দিন বিকালের পালায় মেট্রো রেলে চড়তে এসেছিলেন তারা; স্টেশনগুলো ছিল কানায় কানায় ভরা।
এদের মধ্যে ব্যাংকার মাসুদুর রহমান এসেছিলেন ছেলে-মেয়ে ও ভাতিজা-ভাগ্নিদের নিয়ে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও স্টেশন পর্যন্ত আসা-যাওয়া করেছেন মেট্রোতে চড়ে। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “দারুণ। এত অল্পসময়ে যানজটের এই শহরে ভ্রমণ কল্পনাতেও ছিল না। বাচ্চারা ভীষণ উপভোগ করেছে।"
সপরিবারে ঘুরতে আসা গার্মেন্টসকর্মী এমদাদুল হকের অভিজ্ঞতাটা একটু অন্যরকম। তার সঙ্গে কথা হয় আগারগাঁও স্টেশনে। মেট্রো রেলে চড়ে তার মনে হয়েছে, 'পরিশ্রমের অর্থে একটা দারুণ জিনিস হইলো’।
মিরপুর থেকে এদিন যারা মেট্রোতে চড়েছেন তাদের বেশির ভাগেরই গন্তব্য ছিল উত্তরার তিন স্টেশন। মেট্রো রেল ভ্রমণের পাশাপাশি সেখানে রাজউকের প্রকল্পের খোলা ময়দান আর লেকের সৌন্দর্য উপভোগের উদ্দেশ্যের কথা বলছিলেন তারা।
পল্লবী স্টেশন থেকে মেট্রোতে চড়া ব্যাংকার ফারজানা ইয়াসমিন বলেন, "বিদেশে এর আগে মেট্রোতে চড়েছি। তবে নিজের দেশে মেট্রোতে চড়ার অভিজ্ঞতা সবার সেরা, অন্যরকম। উপর থেকে ঢাকা শহরকে দেখতে ঈদের দিনে মেট্রোতে চড়লাম। ফ্যামিলি এসেছে৷ বাচ্চা এসেছে, সেও খুব উপভোগ করছে।"
মেট্রো রেলের কাজীপাড়া স্টেশনের কন্ট্রোলার নজরুল ইসলাম বলেন, "দুইটার পর যারা টিকেট কেটেছেন তারা বেশিরভাগ উত্তরা অভিমুখী।”
ঢাকার মধ্যভাগের প্রারম্ভিক স্টেশন আগারগাঁওয়ের স্টেশন ম্যানেজার শাহিন আনওয়ারের কাছে এদিনের ভিড় ঠিক উদ্বোধনের দিনের মতোই ঠেকেছে।
তিনি বলেন, “আমরা যেরকম প্রত্যাশা করেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্রাউড। লোকজন খুবই উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে মেট্রো ভ্রমণ করছে, যাত্রীরা খুবই খুশি।“
উত্তরা থেকে আগারগাঁও স্টেশনে আসা মাহফুজ পলাশের কাছে মেট্রো চড়াটা ‘আনন্দের চেয়ে প্রয়োজনের বেশি’। তিনি বলেন, “ঈদের দিনে ঘোরার আনন্দ তো আছেই। তবে এই যে দ্রুত চইলে আসলাম সবাইকে নিয়ে এটা তো প্রয়োজন, এই প্রয়োজন মিটল।”
শনিবার ঈদের দিনে মেট্রোতে চাপ ছিল বরাদ্দের পুরোটা সময়েই। দুপুর দুইটা থেকেই মানুষ এসে জড়ো হয়েছেন দুই প্রান্তের স্টেশনগুলোতে।
এবারই প্রথম কোনো ঈদে মেট্রো যোগ হওয়ায় রাজধানীর উত্তরা ও মিরপুর এলাকার ছুটি উপভোগে বের হওয়া নানা বয়স আর শ্রেণি পেশার মানুষের কাছে এটি আনন্দের বাহনে পরিণত হয়েছিল।
স্ত্রীকে নিয়ে বিকাল চারটার দিকে শেওড়াপাড়া স্টেশন থেকে উত্তরা উত্তরের পথে রওনা হয়েছিলেন আনিছুর রহমান। মিরপুরের এ বাসিন্দার এবারই প্রথম মেট্রোতে চড়া। এ ভ্রমণকে তিনি বলছেন, ‘স্বার্থক’।
কারণ হিসেবে বললেন, “আমি মিরপুরে থাকি। এই মেট্রোর পাইলিং করা থেকে মেট্রো তৈরি হওয়া সব দেখেছি। কত যানজটে ছিলাম, কত ধূলা খাইসি। আজকে যে চড়লাম মনে হচ্ছে, সব স্বার্থক। উঠলে পরেই না বোঝা যায় একটা জায়গা কেমন।”
পাঁচ বছরের মেয়ে ইয়ারার বায়নায় মেট্রোতে ঘুরতে এসেছিলেন সালেহ আহম্মেদ। তিনি বলেন, “বাসা তো ১০ নম্বরে। মেয়ে বাসা থেকে প্রতিদিন দেখে মেট্রো যায়, আর সে বায়না ধরে উঠবে। তাই আজ উঠলাম। মেট্রোতে আজ সবাই চিল মুডে থাকলেও এটা আসলয়ে প্রয়োজন। যত দ্রুত এটা কমলাপুর পর্যন্ত চলবে তত এটা কার্যকর হবে।”
দিনভর যাদের ঘরের কাজ সামলে কাটে তাদের একজন সুরাইয়া আক্তারও এদিন মেট্রোর সওয়ারী ছিলেন। তার ভাষায়, “মেট্রোতে চড়ে ঈদ উপভোগে বের হলাম খুবই ভালো লাগছে। বাচ্চাদের নিয়ে বের হলাম, আগে অনেক জায়গায় যেতাম এটা নতুন অভিজ্ঞতা।”
এদিন মাত্র চার ঘণ্টা চলায় বিশাল সংখ্যক মানুষের মেট্রোতে চড়ার ইচ্ছার বাস্তবায়নে হিমশিম খেতে হয়েছে ডিএমটিসিএলকে। দুই প্রান্তের শেষ স্টেশনগুলোতে উপচে পড়া ভিড় হওয়ায় টিকেট বুথ ও কাউন্টারগুলোর সামনে হয়েছে লম্বা লাইন। এত মানুষের ভিড়ে আধা ঘণ্টা থেকে ৪০ মিনিট পর্যন্ত টিকেটের লাইনে দাঁড়িয়ে গরমে অস্বস্তিতে ছিলেন যাত্রীরা। অতিরিক্ত ভিড়ের জন্য এদিন সব বুথ থেকেই টিকেট দেওয়া হয়েছে।
আনন্দ উপভোগের ভিড় খানিক ভোগালেও এদিন পোয়াবারো হয়েছে উত্তরা উত্তর ও সেন্টার স্টেশন এলাকার রিকশাচালক ও দোকানদারদের। দিয়াবাড়ী ও রাজউক প্রকল্পের নানা এলাকায় এদিন রিকশায় চড়ে বেড়িয়েছেন শত শত মানুষ। দোকানে সেরেছেন নাস্তা।
উত্তরা উত্তর স্টেশন এলাকার দোকানদার লাবু বলেন, “আমার আজকে ব্যবসা হাণ্ড্রেড পারসেন্ট। ২০-৩০ শতাংশ বেশি ব্যবসা হইছে।”
খুশি উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনের নিচে যাত্রী তুলতে ব্যস্ত রিকশাচালক ইমরানও। বললেন, “অনেক খুশি। অনেকগুলা খ্যাপ পাইসি।”
এদিন ঠিক কত মানুষ চড়েছেন তার হিসাব তাৎক্ষণিক জানাতে পারেননি স্টেশন কর্মকর্তারা। বাড়তি ভিড়ের কারণে ঘড়ি ধরে ঠিক ছয়টায় এদিন পরিচালনা শেষ করতে পারেনি মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ। উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে শেষ ট্রেন ছেড়েছে প্রায় সোয়া ছয়টায়।
উত্তরা উত্তর স্টেশন ইনচার্জ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “প্রত্যাশার চেয়ে অনেক অনেক বেশি যাত্রী। কত মানুষ গেল অফিসিয়ালি এখনও বলা যাবে না। মেইন্টেনেন্সে নির্দেশনা আছে শেষ ট্রেন স্টেশনে থাকা শেষ যাত্রীটাকেও আমরা নিয়ে যাব। কাউকে ফেলে যাব না।”