“ভাই কিছুই নাই। ছাই আর ছাই। আমি শূন্য হয়ে গেছি, কেমন চলমু। আল্লাহ গো…।”
Published : 04 Apr 2023, 08:32 PM
ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছিলেন ব্যবসায়ী মাসুদ আলী, সকাল ৬টার দিকে যখন বঙ্গবাজারে আগুন লাগার খবর পান, নাজিরা বাজারের বাসা থেকে দৌড়ে গিয়ে দেখেন গোটা মার্কেট জ্বলছে।
শিশুদের কাপড়ের লট ছিল মাসুদের দোকানে, ঈদের আগ দিয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সর্বস্ব হারিয়ে তার আর্তনাদ যেন থামছে না।
“আমার দোকানের কোনো কিছুই বাইর করতে পারিনি। আমি পথে বসে গেছি, আমার কিছুই নাই। দোকানের ক্যাশ ড্রয়ারে ৪০ হাজার টাকা রেখে আইছিলাম। ৪০ লাখ টাকার মালামাল ছিল, সব কিছু পুইড়া গেছে।”
স্থানীয় লোকজন ও অন্যান্য ব্যবসায়ীরা সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন এই ব্যবসায়ীকে, কিন্তু কিছুতেই যেন নিজেকে বোঝাতে পারছিলেন তিনি।
আক্ষেপ করে বলছিলেন, “সেহেরি খেয়ে দোকানে আসলে হয়ত কিছু মালামাল বের করতে পারতাম।”
বঙ্গবাজারে জিন্স প্যান্টের দুটি দোকান ছিল রফিকুল ইসলামের, ঈদ উপলক্ষে আগেই নতুন কাপড় তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু মঙ্গলবার ভোরে লাগা আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে তার দোকানও।
আর্তনাদ করে বলছিলেন, “ভাই কিছুই নাই। ছাই আর ছাই। আমি শূন্য হয়ে গেছি, কেমন চলমু। আল্লাহ গো…।”
বঙ্গবাজারের বেশিরভাগ ব্যবসায়ীরই আর্তনাদ এখন এমন; মঙ্গলবার ভোর ৬টা ১০ মিনিটে দেশের অন্যতম বড় এই কাপড়ের মার্কেটে আগুন লেগে জীবিকার সহায়-সম্বল হারিয়েছেন তারা।
আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস মিনিট দুইয়ের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলেও বাতাসের মধ্যে ঘিঞ্জি ওই মার্কেটের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিটের চেষ্টায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও ততক্ষণে বঙ্গবাজার মার্কেট, মহানগর মার্কেট, আদর্শ মার্কেট ও গুলিস্তান মার্কেট পুরোপুরি ভষ্মীভূত হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাশের এনেক্সকো টাওয়ার এবং আরও কিছু ভবন।
বঙ্গবাজারের পাঁচটি মার্কেটের মধ্যে চারটি পুরোপুরি পুড়ে গেছে। এই মার্কেটে দেশি-বিদেশি জিন্সের পাইকারি বিক্রি হয়। ঈদকে কেন্দ্র করে দোকানে দোকানে মজুদও ছিল প্রচুর।
মহানগর মার্কেটে মালিহা ফ্যাশন কর্নারের মালিক নজরুল ইসলাম জানান, তার দোকানে দেশি-বিদেশি জিন্সের ব্যাপক সমাহার ছিল। কিন্তু এখন সব পুড়ে ছাই।
বঙ্গবাজার এলাকায় এক দশক ধরে ব্যবসা করছেন ইকবাল হোসেন। তার চারটি দোকানে মেয়েদের লেহেঙ্গা, থ্রি পিসের বড় কালেশন ছিল।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর তিনি জানান, এনেক্সকো টাওয়ারের তিন তলা থেকে মালামালগুলো বের করতে পারলেও আন্ডারগ্রাউন্ডের গুদাম থেকে কিছুই বের করতে পারেননি। পানিতে তার থ্রি পিসগুলো ভিজে একাকার হয়ে গেছে।
ঈদ উপলক্ষে সোমবার দুপুরে বঙ্গবাজারের দোকানে প্যান্টের লট কাপড় তুলেছিলেন ব্যবসায়ী জোনাব আলী; কিন্তু আগুনে পুড়ে এখন তা কেবল ছাই।
“ভাবলাম সকাল থেকে ব্যবসা করমু। কয়েক জায়গা টেলিফোনও করছি যে, আজকে আইসা নিউ কালেশন নিয়া যান। কিন্তু কিছুই নাই।”
কাঁদতে কাঁদতে এই ব্যবসায়ী বলছিলেন, “আমি নিজেও মরে গেছি।... কোথাও যামু।”
‘এক সুতাও উদ্ধার করতে পারিনি’
২৬ বছর ধরে বঙ্গবাজারে দোকান চালান লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের মিজানুর রহমান। তার টিশার্ট ও গেঞ্জির সাতটি দোকানে ১৫ জন কর্মচারী কাজ করতেন।
সকালে আগুন লাগার খবরে শনির আখড়ার বাসা থেকে ছুটে গিয়ে দেখেন বঙ্গবাজার মার্কেটের মাঝখানে ও পূর্বপাশে অল্প অল্প আগুন জ্বলছে।
“ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট পানি দিচ্ছিল, একটি ইউনিট পুলিশ হেডকোয়ার্টাস অংশে ও আরেকটা মার্কেট সংলগ্ন দেয়ালের দিকে। কিন্তু আগুন বরাবর পৌঁছাচ্ছিল না পানি। লোকজন চিৎকার করছিল।
“মুহূর্তের মধ্যে বিকট বিস্ফোরণ হয়। বঙ্গবাজার মার্কেটের টিনশেড, তৃতীয় তলাসহ চারটি অংশে আগুন ছড়িয়ে যায়। তখন ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিটের কন্ট্রোলের বাইরে চলে যায়।”
এসি বিস্ফোরণের পরই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বলে জানান এই ব্যবসায়ী।
ঈদ উপলক্ষে ঋণ নিয়ে দোকানে মালামাল তুলেছিলেন মিজানুর। আগুন লাগার পর সেসব মালামালের কিছুই উদ্ধার করতে পারেননি বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান তিনি।
“দুই কোটি টাকা ঋণ নিয়েছি ব্যাংক ও স্বজনদের কাছ থেকে ঈদ উপলক্ষে মালামাল তুলতে। সাত দোকানে ৮-১০ কোটি টাকার মালামাল ছিল। কিন্তু এক সুতাও উদ্ধার করতে পারিনি।”
আগুন লাগার পর এসি বিস্ফোরণ হলে আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় জানিয়ে নিউ রাজু গার্মেন্টেস নামে দোকানের মালিক মিজানুর বলেন, মার্কেটের তৃতীয় তলায় শোরুমে অনেকগুলো এসি ছিল। এগুলোর বিস্ফোরণের কারণে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
চারপাশে আাগুন জ্বলার মধ্যেই মালামাল সরানোর চেষ্টার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আগুনের লেলিহানের মধ্যে ভেতরে ঢুকতে পারিনি।
ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “লাখো মানুষের রিজিকের সংস্থান ছিল এখানে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে চাই-দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক আমাদের।”
দুই বস্তা বের করেও রক্ষা হল না
বঙ্গবাজারের ভেতরে লেডিস ওয়ান পিসের দুই দোকান সাইফুলের। রাস্তার পশ্চিম পাশে বঙ্গবাজার ইসলামিয়া মার্কেটের কাঁচা অংশে আরেকটি দোকান। সেহেরি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। সকাল সাড়ে ৬টায় ভাইয়ের ফোন পেয়ে মিরপুর থেকে উবারের মটরসাইকেলে বঙ্গবাজারে ছুটে আসেন তিনি।
“তখনও আগুন দোকান পর্যন্ত আসেনি। কোনোরকমে ভেতরে ঢুকে দুই বস্তা বের করে বঙ্গবাজার ইসলামিয়া মার্কেটের দোকানে রেখে আবার ভেতরের দোকান থেকে আরও কাপড় আনতে যাই। কিছুদূর গিয়ে দেখি আর দোকান পর্যন্ত যাওয়া যাচ্ছে না। আগুন দোকানে ছড়িয়ে পড়েছে।
“দ্রুত বাইরে বের হয়ে দেখি বঙ্গবাজার ইসলামিয়া মার্কেটে তার দোকানসহ অন্য দোকানগুলো জ্বলছে।”
দুই বস্তা রক্ষা করেও শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারলাম না বলে কেঁদে ওঠেন সাইফুল।
পাওনা পাঁচ লাখ ফেরত পাব কীভাবে?
প্রায় পাঁচ বছর সিঙ্গাপুরে শ্রম দিয়ে আব্দুর রহিম কিছু টাকা জমিয়ে জিন্সের প্যান্টের দোকান দিয়েছিলেন মহানগরী মার্কেটে। সেখানের দোতালায় দুটি দোকান ছিল তার। ঈদ সামনে রেখে বেশি করে প্যান্ট তুলেছিলেন।
আগুন লাগার খবর পেয়ে সকাল ৭টার দিকে জুরাইনের বাসা থেকে এসে দেখেন মার্কেট জ্বলছে। দোকানে যাওয়া যাচ্ছে না।
“চোখের সামনে দেখি জ্বলছে, হা হুতাশ ছাড়া কিচ্ছু করার ছিল না। এমন দৃশ্য জীবদ্দশায় দেখিনি। নিজের সম্পদ পুড়ে যাচ্ছে কী করব বলেন?”
দোকানের ভেতর নগদ দুই লাখ টাকা ছিল জানিয়ে রহিম জানান, আগুনে প্যান্টের সঙ্গে সেই টাকাও পুড়ে গেছে।
আগুন এতটুকুতেই থেমে থাকেনি আরও ক্ষতি করে গেছে রহিমের। কার কাছে কত টাকা পাবেন সেই তালিকাও পুড়িয়ে দিয়ে গেছে।
পোড়া মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে হতাশ কণ্ঠে তিনি জানান, দোকানের ভেতর একটা খাতায় ছিল বকেয়া রাখা ব্যক্তিদের নাম-ফোন নম্বর। তাদের কাছে পাঁচ লাখ টাকার বেশি পাবেন তিনি।
"ওদের এখন কীভাবে পাব? ফোন নম্বরই বা পাব কই?”- কাতর শোনালো এ যুবকের কণ্ঠ।
এমন আগুন দেখেননি আলাউদ্দিন
গুলিস্তানে টিন শেডের একটি দোকান ছিল আলাউদ্দিনের। এরশাদ আমলে তাদের সেখান থেকে তুলে বঙ্গবাজারে দোকানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। এরপর থেকে বঙ্গবাজারে পাঞ্জাবির দুইটি দোকান রয়েছে তার।
বয়স্ক এ ব্যবসায়ী বলেন, “ওই সময় আমি দুইটি দোকান পাই। কিন্তু টাকার অনটনে পড়ে বিক্রি করে দেই। পরে কিছুটা স্বাবলম্বি হলে দুইটি দোকান ভাড়া নিয়ে আবার ব্যবসা শুরু করি।”
এর আগে ১৯৯৪ সালের আগুনেও তার দোকান পুড়ে যায় জানিয়ে তিনি বলেন, “এমন আগুন আমি জীবনে দেখিনি। সব ছাই হয়ে যাবে কিছুই রক্ষা পাবে না, এটা এবারই চোখের সামনে দেখলাম।”
সকালে আগুনের খবর যখন পান ততক্ষণে তার দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বলে জানালেন আলাউদ্দিন।
“কল্পনাও করতে পারিনি এরকম চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হবে।”
পোড়া কাপড়ের স্তূপে যদি কিছু মেলে
বঙ্গবাজারের একটি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী ১৬ বছরের জামাল। তার সমবয়সী সোহেল, কামাল, সিহাবসহ আরও কয়েকজন পোড়া কাপড়ের স্তূপ থেকে ভালো কাপড়টা বের করার চেষ্টা করছেন।
বঙ্গবাজারের পশ্চিম দিকের রাস্তাটি পোড়া কাপড়ের স্তূপে পরিণত হয়েছে। আগুন নেভানোর ছিটানো পানিতে সেগুলো চুপসে ছিল। এরমধ্যে কয়েকজনকে এ পোড়া কাপড়ের মধ্যে ভালোটা বেছে নিতে দেখা যায়।
জামাল জানান, আগের রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ করে বাসায় গেছেন। সকালে শুনেই যাত্রাবাড়ী থেকে ছুটে আসেন। ততক্ষণে পুড়ে গেছে সালাম নামে তার মালিকের দোকান।
“এখানে কিছু (পোড়া কাপড়ের স্তূপ) ভালো কাপড় পাওয়া যাচ্ছে, এগুলো সংগ্রহ করে পরে শুকিয়ে কী করা যায়, সেটা ভেবেই বাছাই করছি এগুলো,” বলেন তিনি।
ছোট বাচ্চাদের কয়েকটি প্যান্ট পেয়ে সিহাব জানাল সে এগুলো পরিচিত গরীব মানুষকে দিয়ে দেবে।