“আমরা সবসময় আপনাদের নাগরিকদের দেখানো স্বতন্ত্র আদর্শ ও গৌরবকে সম্মান জানাই,” বলেন তিনি।
Published : 01 Nov 2022, 12:11 AM
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নমত ও উদ্বেগ থাকলেও দুদেশের সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব বজায় আছে বলে মনে করেন টেড কেনেডি জুনিয়র।
সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু সেনেটর এডওয়ার্ড এম কেনেডির ছেলে টেড কেনেডি জুনিয়র বলেন, “যদিও বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে মতানৈক্য ও উদ্বেগ রয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে দুই জাতি সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব বজায় রেখে চলেছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০ বছর স্মরণ’ শীর্ষক বক্তৃতা দেন তিনি।
একাত্তরে মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জোরালো সমর্থন জানিয়েছিলেন তার বাবা মার্কিন সেনেটর টেড কেনেডি।
যুদ্ধের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে আসতে বাধা পেয়ে কলকাতা ও আগরতলায় শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছিলেন মার্কিন এই আইনপ্রণেতা।
ওই সফর থেকে ফিরে ‘ক্রাইসিস ইন সাউথ এশিয়া’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন সিনেট জুডিসিয়ারি কমিটি অন রিফিউজিসের কাছে জমা দেন তিনি।
এরপর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সদ্য স্বাধীন দেশের রাজধানী ঢাকায় এলে টেড কেনেডিকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় ছাত্র-জনতা। ওই সফরের সময় বিপুল সমাগমের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের সামনে একটি বটগাছ রোপণ করেন তিনি, যা বর্তমানে ‘এডওয়ার্ড কেনেডি বটগাছ’ নামে পরিচিতি।
সোমবার কলাভবনের সামনে গিয়ে সেই বটগাছের নিচে কিছু সময় কাটান কেনেডি পরিবারের সদস্যরা। ক্যাম্পাসে রিকশাতেও ঘোরেন তারা।
এরপর সিনেট ভবনে দেওয়া বক্তৃতায় টেড কেনেডি জুনিয়র মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাবার অবদান যেমন তুলে ধরেন, তেমনই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য টেড কেনেডির আজীবনের সংগ্রামের পাশাপাশি বাঙালির সংগ্রামের বিরুদ্ধে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিক্সন সরকারের অবস্থানের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “যখন আমরা দুদেশের সম্পর্কের ৫০ বছরের কথা বলছি, তখন এটা স্পষ্ট যে- আমাদের সম্পর্ক অসাধারণ সাফল্যের। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতি নাটকীয়ভাবে বিস্তৃত হয়েছে। কৃষি, জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য নিরাপত্তা, বৈশ্বিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এসব কার্যক্রম দেখতে পায় যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে সবচেয়ে বেশি সৈন্য পাঠানোয় আমরা আপনাদের সাধুবাদ জানাই।”
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভাতিজা তার বক্তৃতায় বলেন, “কেনেডি পরিবার সবসময় বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করে।
“এবং আমরা সবসময় আপনাদের নাগরিকদের দেখানো স্বতন্ত্র আদর্শ ও গৌরবকে সম্মান জানাই। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় ভয়াবহ অবিচার, বিরোধিতা ও রক্তপাত মোকাবেলা করেছেন আপনারা।”
মুক্তিযুদ্ধকালে বাবার শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের কথা তুলে ধরে টেড কেনেডি জুনিয়র বলেন, “শরণার্থী সংকট ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চালানো অন্যান্য নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন আমার বাবা; তিনি সেই গুটিকয়েক রাজনীতিকদের একজন, যারা আপনাদের দেশে কী ঘটছে তার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন ও পাকিস্তানি বাহিনীর কর্মকাণ্ডকে জেনোসাইড হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।”
বাবার কাছ থেকে একাত্তরের গল্প শুনে বেড়ে ওঠার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আপনাদের এই মহান জাতি সম্পর্কে কেনেডি পরিবার সবসময় শুনেছে এবং এ কারণে শেষ পর্যন্ত এখানে এসে অসাধারণ মানুষদের সঙ্গে মিলিত হতে পেরে আমরা গর্বিত।”
নিজ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন কনসাল জেনারেল আর্চার কে. ব্লাডের ভূমিকার কথাও স্মরণ করেন টেড কেনেডি।
মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে মাঠের পরিস্থিতি তুলে ধরে এবং নিক্সন সরকারের বিরুদ্ধে সেসময় একটি প্রতিবাদী টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন ব্লাড, যা ইতিহাসে ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ নামে পরিচিত।
টেড কেনেডি বলেন, সেই টেলিগ্রাম পাঠানোর পর কনসাল জেনারেল পদ থেকে আর্চার কে. ব্লাডকে সরিয়ে নেওয়া হলেও তার দেখানো পথ ধরে এখন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরা দাপ্তরিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই ‘চাঁচাছোলা ও সৎ’ মন্তব্য ওয়াশিংটনে পাঠাতে পারেন।
টেড কেনেডির পররাষ্ট্রনীতি ভাবনার সঙ্গে রিচার্ড নিক্সন ও তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের পররাষ্ট্রনীতির পার্থক্যের কথা বক্তৃতায় তুলে ধরেন টেড কেনেডি জুনিয়র। মার্কিন কংগ্রেসের এই দুই রাজনীতিকের মধ্যে একটি কথোপকথনের বিষয় উল্লেখ করেন তিনি।
টেড কেনেডি জুনিয়র বলেন, “একবার কংগ্রেসের কক্ষে টেড কেনেডির কাছে হেনরি কিসিঞ্জার জানতে চান, ‘মানবিক বলতে আপনি কি বুঝান, আমি ঠিক বুঝি না?’ এটা একটা উদ্ধৃতি।
“তিনি এটা বুঝতেন না। তিনি বুঝতেন ভূ-রাজনৈতিক শক্তি আর অর্থনীতি। তিনি বুঝতেন আমরা কীভাবে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে একজোট হব। কিন্তু তিনি বুঝতেন না- স্বাধীনতা ও মানবিকতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পররাষ্ট্রনীতি।”
পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে মানবিকতা থাকার কারণে বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পক্ষে তার বাবা দাঁড়িয়েছিলেন বলে জানান তিনি।
তার বাবার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের একটি বড় অংশও মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির পক্ষে ছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সত্যিকারের গণতন্ত্রের জন্য স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পাশাপাশি স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের জন্য তার বাবার আজীবন সংগ্রামের কথাও মনে করিয়ে দেন টেড কেনেডি জুনিয়র।
বাবার উপস্থিতি অনুভব করেছি: বটতলা ঘুরে কেনেডি জুনিয়র
টেড কেনেডি জুনিয়র দেখলেন একাত্তরের ছবি, স্মরণ করলেন বাবাকে
সেই কেনেডির স্মৃতি আসছে ফিরে এই কেনেডির সফরে
তিনি বলেন, টেড কেনেডি বুঝতে পেরেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভারত বিভাগের সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে এক দেশ হলেও বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়া ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র।
“ভারতকে মাঝখানে রেখে নিশ্চিত দুদেশকে সমানভাবে ভাগ করে একীভূত রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন জাতি হওয়া সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র। কারণ ঐতিহাসিক, সামাজিক, ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক- কোনোভাবেই এটার (দুদেশ হওয়ার) কোনো মানে নাই।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, মার্কিন দূতাবাসের কালচারাল অ্যাফেয়ার্স অফিসার শারলিনা হুসেইন মরগ্যান বক্তব্য দেন।
অনুষ্ঠানে শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা লালনের ‘এমন মানবজনম আর কি হবে’ গান এবং নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ‘দেখেছি রূপ সাগরে’ গানে নৃত্য পরিবেশন করেন।
বক্তৃতা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের সংরক্ষণের জন্য একাত্তরে টেড কেনেডির ‘ক্রাইসিস ইন সাউথ এশিয়া’ প্রতিবেদনের মূল কপি উপাচার্যের হাতে তুলে দেন টেড কেনেডি জুনিয়র।