বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন বন্ধু টেড কেনেডি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগিয়েছিলেন বটের চারা; তার ছেলে ঢাকায় এসেছেন শনিবার।
Published : 29 Oct 2022, 09:37 PM
বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রামের সংগঠনস্থল হওয়ায় একাত্তরে যেখান থেকে বটগাছ উপড়েছিল পাকবাহিনী, স্বাধীনতার পরে সেই স্থানেই আরেকটি গাছ রোপণ করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি।
প্রয়াত এ মার্কিন আইনপ্রণেতার বাংলাদেশের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন-ভালোবাসার কথা ফের আলোচনায় এসেছে তার ছেলের ঢাকা সফর ঘিরে। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এডওয়ার্ড কেনেডি জুনিয়র সপরিবারে ঢাকা এসেছেন শনিবার।
সফরকালে সোমবার তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনের ঐতিহাসিক বটতলাও পরিদর্শন করবেন; যে জায়গার সঙ্গে ছয় দফা আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক-স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন জড়িয়ে আছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপে ’এডওয়ার্ড কেনেডি বটগাছ’ রোপণ আর মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন এই রাজনীতিকের অবদানের স্মৃতিচারণ করেছেন উত্তাল সেই সময়ের দুই ছাত্র নেতা।
মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পরে ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ডাকসুর আয়োজনে এক সমাবেশে বক্তব্য দেন এডওয়ার্ড কেনেডি। ওইদিন সেখানে বর্তমান বট গাছের চারা রোপণ করা হয়।
ডাকসুর তৎকালীন সহসভাপতি ও বর্তমানে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আব্দুর রব বলেন, “একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন জনগণ এবং নেতাদের মধ্যে একমাত্র এডওয়ার্ড কেনেডি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন। বিজয়ের পরে তিনি বাংলাদেশে আসেন এবং ঢাবি ক্যাম্পাসে ডাকসুর পক্ষ থেকে তাকে সংবর্ধনা জানানো হয়।
“পাকিস্তানি আর্মি কিন্তু আগের বটতলা যেটা, সেই বটগাছটা উপড়ে ফেলে দিয়েছিল। বর্তমানে যে বটগাছটা দেখতেছেন, সেটা এডওয়ার্ড কেনেডি, আমি ও মাখন (ডাকসু জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন)- এই তিনজনের হাতে লাগানো।”
মুক্তিযুদ্ধের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সরকার যখন পাকিস্তানি শাসকদের রাজনৈতিক ও অস্ত্র সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছিল, তখন তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে জনমত গঠন করেছিলেন সিনেটর টেড কেনেডি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভাই টেড কেনেডি ১৯৬২ সাল থেকে ২০০৯ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেনেটর ছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তানে নৃশংসতা চালানোর পরও পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি মার্কিন প্রশাসনের সমর্থনের বিরোধিতা করতে থাকেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞের চিত্র দেখার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে আসার চেষ্টা করলেও অনুমতি পাননি টেড কেনেডি। পরে কলকাতার কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন তিনি।
সফর থেকে ফিরে ‘ক্রাইসিস ইন সাউথ এশিয়া’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন তিনি সিনেট জুডিসিয়ারি কমিটি অন রিফিউজিসের কাছে জমা দেন।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা চালানোর বিষয় স্পষ্ট হওয়ার কথা তুলে ধরে ওই প্রতিবেদনে তিনি লেখেন, “ইসলামাবাদের সামরিক আইনের মাধ্যমে এটার অনুমোদন, নির্দেশ ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পূর্ববাংলার মানবিক ও রাজনৈতিক ট্রাজেডির ক্ষেত্রে আমেরিকার জোরালো সমর্থন অপরাধে সহযোগী হওয়ার চেয়ে কম কিছু নয়।”
নিক্সন সরকারের অবস্থান পরিবর্তন না হওয়ার মধ্যে টেড কেনেডি পূর্ব বাংলায় অত্যাচার-নির্যাতন ও গণহত্যার বিরুদ্ধে নিজের কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন।
যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পী সমাজ থেকে শুরু করে অনেক মানুষ মুক্তিকামী বাঙালির পক্ষে অবস্থান নিতে থাকেন। একপর্যায়ে পাকিস্তানের কাছে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের প্রস্তাবও উঠেছিল মার্কিন কংগ্রেসে।
৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের তিন মাসের মধ্যে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ সফরে আসেন টেড কেনেডি।
যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন তিনি।
বিভিন্ন পুরনো ভিডিও ও স্থির চিত্রে দেখা যায়, বাহাত্তরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এডওয়ার্ড কেনেডির সমাবেশ ঘিরে ছাত্র-জনতার বিশাল জমায়েত হয়েছিল।
সামনের খোলা জায়গায় ছাড়িয়ে কলাভবনের ছাদ আর বারান্দা থেকেও বিপুল শিক্ষার্থী ও জনতা সমাবেশে অংশ নেন। ‘জয় বাংলা’ আর ‘জয় কেনেডি’ মুখর হয়েছিল পুরো এলাকা।
সে দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আ স ম রব বলেন, “বিরাট সমাবেশ হয়েছিল। এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে অদ্বিতীয় একটা সমাবেশ। আমাদের দোসরা মার্চের সমাবেশের পরে এটা ছিল ক্যাম্পাসে বিরাট একটা সমাবেশ। এটা আমাদের জন্য অর্জনের ব্যাপার, জাতির গৌরবের ব্যাপার।”
কলাভবনের সামনেরই পুরাতন বটতলায় ১৯৭১ সালের ২ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল।
ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক ও ছাত্রলীগের তৎকালীন সহসভাপতি শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, পুরাতন বটগাছটা পাকিস্তান সেনাবাহিনী তুলে ফেলে দিয়েছে, যেভাবে তারা শহীদ মিনার ভেঙে দিয়েছিল।
“তাদের ধারণা ছিল যে, যেহেতু বটতলাতে সভা করে আমরা সংগ্রাম করি, এটা তুলে দিলে বোধহয় আমরা সংগ্রাম থেকে বিরত হয়ে যাব। পাক বাহিনী আর প্রশাসনের কতটা নির্বোধ চিন্তা!”
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শেখ শহীদুল ইসলাম বর্তমানে জাতীয় পার্টির (জেপি) মহাসচিবের দায়িত্বে রয়েছেন।
নতুন করে এডওয়ার্ড কেনেডিকে দিয়ে বটগাছ লাগানোর তখনকার পরিকল্পনার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “এডওয়ার্ড কেনেডি যখন আসবেন শুনলাম, তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিই, যে উনাকে দিয়ে বটগাছটা লাগাব আমরা।
“বটতলা ছিল আমাদের সংগ্রামের একটা স্থান। প্রতিবাদের একটা প্রতীক। সেই প্রতীকটাকে তারা নিশ্চিহ্ন করেছিল, সেই প্রতীকটা আমাদের গণতন্ত্রমনা একজন ব্যক্তি, যিনি আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন-সহযোগিতা জুগিয়েছেন, তাকে দিয়ে আবার লাগানো হলো।”
কলাভবনের সামনের সেদিনের সমাবেশের স্মৃতিচারণ করে শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, “তার আগে মাত্র ১৬ ডিসেম্বরে আমরা মুক্ত হয়েছি, ছাত্রসমাজ বিরাট ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধে রেখেছিল। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছাত্ররা সেদিন এসেছিল।
“আমরা একটা ছাত্রসভা আহ্বান করেছিলাম। ক্ষুদ্র সভা থেকে বেশ জনসভার মতো সেখানে হয়ে গিয়েছিল। সেখানে তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন।”
ওই বক্তৃতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মিল থাকার কথা উল্লেখ করেছিলেন টেড কেনেডি।
সদ্য স্বাধীনে দেশের নাগরিকদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, “আমাদের শুরুটাও আপনাদের চেয়ে শুভ কিছু ছিল না। আপনাদের এখানে যেমন ছিল, তেমনি এক শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠিত সরকার আমাদের স্বাধীনতাকেও দমিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল।
“আপনাদের মতোই যখন নতুন আমেরিকান জাতি আত্মপ্রকাশ করল, তখন একদল বলতে শুরু করল- এরকম একটি দুর্বল ও দরিদ্র দেশ আধুনিক বিশ্বে টিকতে পারবে না। তারা ভাবল- এই কঠিন পরীক্ষায় আমরা নিশ্চিত অকৃতকার্য হবো। কিন্তু আমরা তাদের সকল ভবিষ্যদ্বাণীকে ব্যর্থ করে এসেছি। আমরা সবকিছুতেই দরিদ্র ছিলাম, তবে আশা ও সাহসিকতায় ছিলাম শক্তিশালী।”
টেড কেনেডি আরও বলেছিলেন, “আপনারা জানেন, কিছু দেশের সরকার আপনাদেরকে স্বীকৃতি না দিলেও সারা বিশ্বের জনগণ আপনাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বৈরতন্ত্র ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে আপনাদের সবার যে অর্জন, সেটাকে তারা স্বীকার করে নিয়েছে।”
ঢাকা সফররত টেড কেনেডির ছেলে এডওয়ার্ড এম কেনেডি জুনিয়র সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার বাবার লাগানো বটগাছ পরিদর্শনে যাবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে একটি বক্তৃতাও দেবেন তিনি।
এডওয়ার্ড কেনেডির রোপণ করা বটগাছ ইতিহাসের সাক্ষী হিসাবে থাকার কথা উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ বলেন, “বটতলা শত সংগ্রামের ইতিহাসের অন্যতম প্রধান সাক্ষী, ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সাক্ষী; এই বট গাছ উপড়ে ফেলে দিয়েছিল পাক বাহিনী- যে এটা উপড়ে ফেলে দিলে এই দেশের আন্দোলন তা উপড়ে যাবে। কিন্তু তা যায়নি।
“নতুন করে এডওয়ার্ড কেনেডির মাধ্যমে রোপণ করা হয়, যা এখন কলাভবনের সামনে দণ্ডায়মান আছে ইতিহাসে সাক্ষী হিসাবে।”
তিনি বলেন, “মার্কিন জনগণের সাথে এডওয়ার্ড কেনেডি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পী সমাজ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন যুগিয়েছিল। এবং তাদেরই বংশধর হচ্ছেন এই এডওয়ার্ড কেনেডি জুনিয়র। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সেই দুঃসময়ে সমর্থন দিয়েছিলেন তারা। তাদের অবদান আমরা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি।”