“৫০ বছর পরও এই গাছ দাঁড়িয়ে আছে এবং এটা এখন সহনশীলতার বাতিঘর, আশার বাতিঘর,” বলেন তিনি।
Published : 01 Nov 2022, 12:05 AM
আন্দোলনের সংগঠনস্থল হওয়ায় নিরীহ একটি বটগাছকেও শত্রু মনে করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী, আক্রোশ থেকে যেটিকে সমূলে উপড়ে ফেলেছিল তারা। কিন্তু বিজয়ের পর সেই একই জায়গাতেই বটের চারা রোপণ করল বিজয়ী বাঙালি; যাতে হাত লাগালেন মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধু মার্কিন সেনেটর এডওয়ার্ড মুর (টেড) কেনেডি।
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের মত নতুন সেই চারাও এখন পার করেছে ৫০ বছর; পত্রপল্লবে বিস্তৃত হয়ে এখনও সেটি আছে বিভিন্ন আন্দোলনের কেন্দ্রে।
সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়ে টেড কেনেডির ছেলে টেড কেনেডি জুনিয়র হাঁটলেন বাবার পথ ধরে। সময় কাটালেন বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে।
বটতলা ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে কেনেডি জুনিয়র বলেন, এ গাছের কথা তিনি সারাজীবন ধরে শুনেছেন, সে গাছের কাছে আসা তার জন্য ‘প্রেরণাদায়ী অভিজ্ঞতা’।
“যখন আমি ওই গাছের তলায় ছিলাম, তখন আমার বাবার উপস্থিতি অনুভব করেছি।”
পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আট দিনের সফরে শনিবার ঢাকায় আসেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভাতিজা টেড কেনেডি জুনিয়র।
৬৯’র গণঅভ্যুত্থান আর স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা লগ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রে ছিল ঐতিহাসিক বটতলা। বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলনও করা হয়েছিল সেখানে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী গাছটি উপড়ে ফেলে। আন্দোলনে দমানোর জন্য নিরীহ গাছ উপড়ানোকে ‘নির্বোধের’ মত সিদ্ধান্ত হিসাবে অভিহিত করেছেন সেই সময়ের ছাত্র নেতারা।
বাংলাদেশ সফরের তৃতীয় দিন সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে গিয়ে ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি টেড কেনেডির লাগানো বটগাছ দেখতে যান কেনেডি পরিবারের সদস্যরা।
বাঙালি সাজ নিয়ে বটতলা পরিদর্শনে যান তারা। সাদা পাজামার সঙ্গে হালকা কমলা প্রিন্টের পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়েছেন টেড কেনেডি জুনিয়র। পাঞ্জাবির বুকে আর হাতায় ছিল মেরুন সুতার কাজ।
তার স্ত্রী ক্যাথরিন ‘কিকি’ কেনেডি পরেন সবুজ রঙের সালোয়ার, কামিজ আর ওড়না। কামিজের মাঝে ছিল সোনালি আর বেগুনির কারুকাজ।
কেনেডি পরিবারের পুরুষরাও পাঞ্জাবি পরেন আর নারীরা গায়ে জড়িয়েছেন রঙিন সালোয়ার, কামিজ আর ওড়না।
সকালে কলা ভবনের সামনের বটতলায় পৌঁছালে কেনেডি পরিবারের সদস্যদের ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান।
এরপর রিকশায় চড়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে আবার বটতলায় ফিরে আসেন তারা। রিকশা যাত্রায় তাদেরকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রাপ্ত ঘুরে দেখান শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
এদিন সকাল ১১টায় ঢাবির নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০ বছর স্মরণ’ শীর্ষক বক্তৃতা দেন কেনেডি জুনিয়র।
বক্তৃতায় মুক্তিযুদ্ধে বাবা টেড কেনেডির অবদান ও বাংলাদেশের সঙ্গে তার আজীবন জড়িয়ে থাকার প্রসঙ্গ টানেন তিনি।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও বিরোধী মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার থাকার কারণে তার বাবা গাছটি লাগাতে আসেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
টেড কেনেডি জুনিয়র বলেন, তার বাবা আশা করেছিলেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে সম্পর্কের স্থায়ী প্রতীক হবে গাছটি। পাশাপাশি এটা মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনও।
“পঞ্চাশ বছর পরও এই গাছ দাঁড়িয়ে আছে এবং এটা এখন সহনশীলতার বাতিঘর, আশার বাতিঘর।”
তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের সম্পর্ক এই গাছের মতই। শক্তি ও বিস্তৃতি নিয়ে এটা তৈরি হয়েছে।”
বটগাছের উপড়ে ফেলার ইতিহাস কিছুটা স্মরণ করে কেনেডি জুনিয়র বলেন, “তিনি এখানে আসতে চেয়েছেন এবং আগের জায়গায় গাছটি লাগাতে চেয়েছেন, যেটা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী উড়িয়ে দিয়েছিল। তারা গাছটি উপড়ে ফেলেছিল, কারণ তারা জানত এটা শিক্ষার্থী সমাবেশের জনপ্রিয় স্থান।
টেড কেনেডি জুনিয়র দেখলেন একাত্তরের ছবি, স্মরণ করলেন বাবাকে
সেই কেনেডির স্মৃতি আসছে ফিরে এই কেনেডির সফরে
“আর তারা জানতে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হচ্ছে বিদ্রোহ আর স্বাধীনতার অগ্নিগর্ভ। ওই বটগাছের নিচেই দ্রোহের শব্দ উচ্চারিত হত।”
একাত্তরে মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জোরালো সমর্থন জানিয়েছিলেন টেড কেনেডি জুনিয়রের বাবা মার্কিন সেনেটর টেড কেনেডি।
যুদ্ধের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে আসতে বাধা পেয়ে কলকাতা ও আগরতলায় শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছিলেন মার্কিন এই আইনপ্রণেতা।
ওই সফর থেকে ফিরে ‘ক্রাইসিস ইন সাউথ এশিয়া’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন সিনেট জুডিসিয়ারি কমিটি অন রিফিউজিসের কাছে জমা দেন তিনি।
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সদ্য স্বাধীন দেশের রাজধানী ঢাকায় এলে টেড কেনেডিকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় ছাত্র-জনতা।
বিপুল সংবর্ধনার মধ্যে স্বাধীনতার ঠিক পরে ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বটের চারা রোপণ করেন টেড কেনেডি, যা বর্তমানে ‘এডওয়ার্ড কেনেডি বটগাছ’ নামে পরিচিতি।
১৯৬২ সাল থেকে ২০০৯ সালে মৃত্যু পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনেট সদস্য ছিলেন তিনি। দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় সেনেট সদস্য থাকাদের তালিকায় তার অবস্থান তৃতীয়।