নানা আয়োজনে উদযাপিত হল সন্জীদা খাতুনের ৯০তম জন্মবার্ষিকী।
Published : 04 Apr 2023, 04:21 PM
সকাল থেকে সাজ সাজ রব ছিল ধানমণ্ডির ছায়ানট ভবনে, অপেক্ষায় ছিলেন নানা বয়সের শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীরা। কারণ জীবনের ৯০তম বার্ষিকীতে ভবনে আসবেন বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব সন্জীদা খাতুন। তিনি এলে রবিঠাকুরের গানে আর নাচে তাকে বরণ করে নেওয়া হল।
বাঙালির আত্ম পরিচয়ের সুলুক সন্ধানের এই সারথীকে ঘিরে মঙ্গলবার তার হাতে গড়া ছায়ানট মিলনায়তনে আয়োজন করা হয় ‘নবতিপূর্ণা’ শিরোনামে অনুষ্ঠান। অন্য যে কোনো দিনের চেয়ে এই দিনটি তাই ছায়ানটে বিশেষ আনন্দের।
সন্জীদা খাতুন: ‘বিস্ময় জাগানিয়া’ এক জীবনের ৯০ বছর
সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ সন্জীদা খাতুন যখন ছায়ানট ভবনের ফটকে, তখন সমস্বরে শিল্পীরা গেয়ে উঠলেন ‘ভয় হতে তব অভয়মাঝে/ নূতন জনম দাও হে’; গানের সঙ্গে চলে নৃত্য শিল্পীদের পরিবেশনা।
বয়সের কারণে কিছু অশক্ত সন্জীদা খাতুন হুইল চেয়ারে করে যখন ভবনের ভেতরে প্রবেশ করলেন, চারপাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা শিল্পীদের কণ্ঠে উঠল ‘আনন্দ লোকে মঙ্গলালোকে’; গানের সঙ্গে প্রদীপ জ্বালালেন নাচের শিল্পীরা।
লিফট ব্যবহার করে সন্জীদা খাতুন যখন দোতলার করিডরে, সেখানেও তাকে বরণ করতে প্রস্তুত ছিলেন শিল্পীরা, গাইলেন ‘আলোকের এই ঝরণা ধারা’।
তারপর ব্রতচারী নৃত্য আর কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে স্বাগত জানিয়ে মিলনায়তনে নিয়ে যাওয়া হয় সন্জীদা খাতুনকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের মেয়ে সন্জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল।
তিনি কামরুন্নেসা স্কুল, ইডেন কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শান্তি নিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করে ১৯৭৮ সালে সেখান থেকেই তিনি পিএইচডি করেন। দীর্ঘদিন অধ্যাপনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে তিনি অবসর নেন।
সন্জীদা খাতুনের লেখার এক বড় অংশ জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্যাপক পরিসরে জনমানসে কবিগুরুকে পৌঁছে দেওয়ার কাজে ঐতিহাসিক ভূমিকায় ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানট’ গড়ে তোলার অনন্য কারিগরও তিনি।
তার জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠানস্থল ছায়ানট মিলনায়তনে সকাল ১০টায় শিল্পী অভিজিৎ কুণ্ডুর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ‘ধ্রুপদ পরিবেশন ও রাগ বৃন্দাবনী সারং’ দিয়ে শুরু হয় পরিবেশনা।
এরপর মঞ্চে এসে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী।
বক্তব্যের শুরুতেই বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি। লিখিত বক্তব্যে বলেন, “আজ সন্জীদা খাতুন, আমাদের প্রিয় মিনু আপার নব্বই বছর পূর্ণ হল। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, বয়সের কারণে দেহ কিছুটা অসমর্থ হলেও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও চিন্তাধারার ক্ষেত্রে তিনি। সচল ও সক্রিয় রয়েছেন। এটি কেবল তার হাতে গড়া ছায়ানট, রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ ও নালন্দা নয়, যারা বাংলা ভাষা-সাহিত্য- সংস্কৃতির সুস্থ ধারা এবং মানবিক সমাজ গড়ায় আগ্রহী তাঁদের সকলের জন্য সুসংবাদ।”
“মুক্তচিন্তা ও সঙ্গীতের পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা সন্জীদা খাতুন সর্বজন যেন বাঙালি জাতিসত্ত্বাকে হৃদয়ে ধারণ করে বিশ্বমানব হয়ে ওঠে, তার সাধনা করে চলেছেন। স্থির প্রত্যয়ের এই যাত্রাপথ মসৃণ ছিল না। কিন্তু, তিনি লক্ষ্য অর্জনে সর্বদা আপন সিদ্ধান্তে অবিচল রয়েছেন।”
“এই সাধনায় সংগীতচর্চা ও শিক্ষার প্রসার সন্জীদা খাতুনের প্রধান অবলম্বন। উনি ও ওনার সহযাত্রীদের তত্ত্বাবধানে লক্ষ ছাত্র ছায়ানটে সঙ্গীতশিক্ষা গ্রহণ করেছে। তাদের কাছে তিনি নিখুঁত শুদ্ধরূপে সংগীতের পরিবেশনা প্রত্যাশা করেছেন, আশা করেছেন তারা শিল্পী হয়ে উঠবে, বিনোদন তারকা নয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষক ও উচ্চশিক্ষার এই বরেণ্য শিক্ষকের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে শিশু- কিশোরদের জন্য সংস্কৃতি- সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রম। গভীর আগ্রহের সাথে যুক্ত রয়েছেন ব্রতচারী প্রশিক্ষণে।”
“সন্জীদা খাতুন দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংস্কৃতিচর্চা, শিক্ষা কার্যক্রম ও সংশ্লিষ্ট সংগঠনে ধারাবাহিক কাজ করে চলেছেন। তিনি আশা করেন, সঙ্গীতের বাণী ও সুর সুরুচির মানুষ গড়ে তুলবে, সংস্কৃতি সমন্বিত শিক্ষা সম্প্রীতির বহুত্ববাদী সমাজের ভিত্তিভূমি নির্মাণ করবে। সর্বজনে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হবে।”
“বেশ কয়েক দশক ধরে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল- লোকসঙ্গীতের বাণী ও সুরের বিকৃতি অব্যাহত রয়েছে, তথাকথিত ফিউশনের প্রসার ঘটছে। বিশ্বায়নের যুগে জাতীয় সংস্কৃতি সুরক্ষা কঠিন হয়ে পড়েছে। আজ ধর্মের মর্মবাণীর স্থলে বিদ্বেষ ও সংস্কৃতিবিনাশী প্রচারণা সমাজকে প্রভাবিত করছে। লোভের কারণে নৈতিক অবক্ষয়ের বিস্তৃতিও দৃশ্যমান। দেশের অভাবনীয় অগ্রগতি যেমন তাঁর প্রাণে আশার সঞ্চার করে, তেমন উপরোক্ত নেতিবাচক প্রবণতা তাঁর কাছে পীড়াদায়ক।”
“গত কয়েক বছরে আমরা বেশ কয়েক গুণিজনকে হারিয়েছি। সঙ্গীতের শুদ্ধরূপ ও জাতীয় সংস্কৃতি সুরক্ষা এবং ধর্মবিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা ও নৈতিক অবক্ষয় রোধে সর্বজন শ্রদ্ধেয় দৃঢ়চিত্ত সনজীদা খাতুনের সক্রিয় উপস্থিতি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। মিনু আপা, আপনি আমাদের সকলের পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানবেন।”
সারওয়ার আলীর বক্তব্যের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর’ গানটি সম্মেলক কণ্ঠে গেয়ে শোনায় ছায়ানটের ‘বড়’দের দল।
পরে মণিপুরি শিল্পীরা সম্মেলক নৃত্য পরিবেশন করেন। এদিন রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, অধ্যাপক মেসবাহ কামাল থেকে শুরু করে অনেক গুণীজনই উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে।
গান প্রসারের আন্দোলনে সন্জীদা
লিখিত বক্তব্যে ছায়ানট প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন সন্জীদা খাতুন।
তিনি বলেন, “ছায়ানটের ‘শ্রোতার আসর' করতে গিয়ে দেশে সংগীতশিল্পীর অভাব টের পেলাম। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য 'ছায়ানট সঙ্গীতবিদ্যায়তন শুরু হলে, তার সঙ্গে যুক্ত হলাম। গানের শিক্ষা, সাধনা আর প্রসারের কাজে আগাপাশতলা সম্পৃক্ত হয়ে গেলাম।
“এ আন্দোলনের আনন্দ জীবনের সব চাওয়া-পাওয়াকে ছাড়িয়ে গেল। এই ধারাতেই আরও একটি আন্দোলনের সূত্রপাত হল কিছুকাল পরে ‘জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ’র অন্তত ত্রিশ/পঁয়ত্রিশটি শাখায় ঘুরে ঘুরে, কখনওবা ঢাকাতে শাখা প্রতিনিধিদের ডেকে এনে সংগীতশিক্ষার আয়োজন করা হয়েছিল। এতে সংগীতের সম্প্রসারণ ঝটিকাগতি পেল।”
সন্জীদা খাতুনের প্রিয় সুর-বাণী-ছন্দের পরিবেশনা
ছায়ানট সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা জানান, সামাজিক সব ধরনে বৈকল্যের বিষয়ে ‘আপসহীন’ মানুষটিরই নির্বাচিত প্রিয় সুর-বাণী-ছন্দের পরিবেশনা দিয়ে জন্মবার্ষিকী উদযাপনের অনুষ্ঠান সাজানো হয়।
অনুষ্ঠানে ফাহমিদা খাতুন গান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্লান্ত বাঁশির শেষ রাগিণী’, ইফফাত আরা দেওয়ান গান ধীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা’।
জহিরুল হক খান আবৃত্তি করেন রামবসুর ‘ভাষণ’। লাইসা আহমদ লিসা গেয়ে শোনান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ’, চন্দনা মজুমদার গেয়েছেন লালন শাহের ‘আমারে কি রাখবেন গুরু চরণদাসী’।
এরপর সম্মেলক নৃত্য পরিবেশন করে ‘ভরতনাট্যম’ দল।
নাচের পর আবারও একক কণ্ঠে পরিবেশিত হয় গান। ফারহানা আক্তার শ্যার্লি শোনান দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘আমি সারা সকালটি বসে বসে’, সুমন মজুমদার গেয়েছেন অতুলপ্রসাদ সেনের ‘ওগো নিঠুর দরদী, এ কি খেলছ অনুক্ষণ’, শারমিন সাথী ইসলাম ময়না গান কাজী নজরুল ইসলামের ‘পাষাণের ভাঙালে ঘুম’।
সবশেষে ছায়ানটের ‘ছোট’দের দল পরিবেশন করে শাহ্ আবদুল করিমের ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান’।
গানের পরিবেশনায় তবলায় ছিলেন- গৌতম সরকার, ইফতেখার আলম ডলার। পাখোয়াজে ছিলেন দীপ্র নিশান্ত, সেতারে ছিলেন ফিরোজ খান, এস্রাজে ছিলেন অসিত বিশ্বাস, মন্দিরায় ছিলেন প্রদীপ কুমার রায় এবং কীবোর্ডে ছিলেন রবিন্স চৌধুরী।