“সন্জীদা আপার জীবন পরিক্রমা আর বাংলাদেশের জাতীয় জাগরণ হাতে হাত ধরে চলেছে,” বলেছেন গবেষক মফিদুল হক।
Published : 04 Apr 2023, 12:12 AM
বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে কিংবদন্তিতুল্য, গবেষকের চোখে বিস্ময় জাগানিয়া ব্যক্তিত্ব, তিনি সন্জীদা খাতুন। বাঙালির আত্ম পরিচয়ের সুলুক সন্ধানের এই সারথী পূর্ণ করলেন জীবনের ৯০ বছর।
নানা আয়োজনে মঙ্গলবার সন্জীদা খাতুনের জন্মবার্ষিকী উদযাপন হবে।
এই উদযাপনের গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে গবেষক মফিদুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সন্জীদা আপার জীবন পরিক্রমা আর বাংলাদেশের জাতীয় জাগরণ হাতে হাত ধরে চলেছে। সত্যিকার অর্থে একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছে।”
‘সনজীদা আপা এক বিস্ময় জাগানিয়া ব্যক্তিত্ব’ মন্তব্য করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মুফিদুল হক বলেন, “এমন কথা খুব বেশি মানুষের ক্ষেত্রে বলা যায় না, কিন্তু তার সম্পর্কে উচ্চকণ্ঠে বলা যায়।”
সন্জীদা খাতুনের নিজ হাতে গড়া সংগঠন ছায়ানট তার জন্মবার্ষিকী উদযাপনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, যার সূচনা হবে মঙ্গলবার সকাল ১০টায় ধানমণ্ডির ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবনে।
ছায়ানট সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সামাজিক সকল বৈকল্যের বিষয়ে আপসহীন মানুষটিরই নির্বাচিত প্রিয় সুর-বাণী-ছন্দের পরিবেশনা দিয়ে আমরা অনুষ্ঠান সাজিয়েছি।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের মেয়ে সন্জীদা খাতুনের জন্ম ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল।
তিনি কামরুন্নেসা স্কুল, ইডেন কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শান্তি নিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করে ১৯৭৮ সালে সেখান থেকেই তিনি পিএইচডি করেন। দীর্ঘদিন অধ্যাপনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে তিনি অবসর নেন।
সন্জীদা খাতুনের লেখার এক বড় অংশ জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্যাপক পরিসরে জনমানসে কবিগুরুকে পৌঁছে দেওয়ার কাজে ঐতিহাসিক ভূমিকায় ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানট’ গড়ে তোলার অনন্য কারিগরও তিনি।
শুদ্ধ সংগীতের চর্চার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন সন্জীদা খাতুন, তখন ‘মিনু আপা’ নামে সহযোদ্ধাদের কাছে পরিচিত ছিলেন তিনি।
মফিদুল হক বলেন, “গানের মধ্য দিয়ে সন্জীদা খাতুন বাঙালি সত্তাকে শক্তি জুগিয়েছেন, আত্মপরিচয়ের সাধনাকে গভীরতা দিয়েছেন।
“আবার যখন জাতির দায় মোচনের প্রশ্ন উঠেছে, তিনি নিবিড়ভাবে সেখানে সম্পৃক্ত হয়েছেন। সেটা ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্ম-শতবর্ষ উদযাপন হোক, আর ছায়ানটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের প্রবর্তনের পরম্পরা হোক, মুক্তিযুদ্ধকালে শিল্পীর দায় মোচনের প্রশ্ন হোক, সবখানেই তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। স্বাধীন বাংলাদেশে নানা পরিক্রমায় সেই ধারাবাহিকতা তিনি বহন করে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। হয়ে উঠেছেন পরম শ্রদ্ধেয়।”
এই সন্জীদা খাতুনের জীবনের নানা দিক উঠে এসেছে আবুল আহসান চৌধুরী ও পিয়াস মজিদের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘বড়ো বিস্ময় লাগে হেরি তোমারে: সন্জীদা খাতুন সম্মাননা-স্মারক গ্রন্থে আটটি বিভাগে প্রায় ৬০ জনের লেখায়।
সেখানে কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন, “গান তার জীবিকা নয়, গান তার জীবন, চারপাশের মানুষজনের সঙ্গে মিশে যাওয়া এক জীবন। ধর্মতলা স্ট্রিটের প্রথম পরিচয়ে জেনেছিলাম যে দেশের আত্মপরিচয় খুঁজছেন তিনি রবীন্দ্রনাথের গানে, আর আজ জানি যে সে-গানে তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিজেরই আত্মপরিচয়।”
দেবেশ রায় সন্জীদার কণ্ঠে গান শোনার সূত্র ধরে লিখেছেন, “সন্জীদা দুই বাংলারই সেই বিরলতম গায়িকা, যিনি গান না গাইলেও শুধু মননচর্চার সুবাদেই মান্য হয়ে থাকতেন।”
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ভাষ্য, “তাকে অভিনন্দন এক সৃজনশীল জীবন যাপনের জন্য। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর কীর্তির মধ্যে, তার অনুরাগীদের ভালোবাসায়। জয় হোক তার।”
কবি ও গবেষক পিয়াস মজিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সন্জীদা খাতুনের কর্মব্যাপ্তি অনেক বড়। কিন্তু আমরা তাকে কেবল পহেলা বৈশাখ আর ছায়ানট প্রতিষ্ঠা দিয়েই মূল্যায়ন করি। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন, আবার শিশুদের নিয়েও গড়েছেন নালন্দা নামে স্কুল। একেবারে প্রাথমিক ধাপ থেকে সংস্কৃতির সামগ্রিক জায়গায় তিনি অনন্য।”
‘জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ’, ‘ব্রতচারী আন্দোলন’, আবৃত্তিচর্চার সংগঠন ‘কণ্ঠশীলন’ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা- সব জায়গাতেই সন্জীদা খাতুন নিজেকে ‘অনন্য হিসেবে প্রমাণ করেছেন’, বলছেন পিয়াস মজিদ।
“তাকে সামগ্রিক জায়গা থেকে মূল্যায়ন করা উচিৎ এবং সবচেয়ে বড় যে জায়গাটি তিনি তৈরি করেছেন, শুদ্ধতার একটা লড়াই সমস্ত জীবনের কাজের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন।”
কলকাতা থেকে তার একাধিক বই এবং গানের অ্যালবাম বেরিয়েছে বহু আগেই। একাত্তরের কলকাতাবাসে তিনি ‘রূপান্তরের গান’ এবং ‘মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র হয়ে সাংস্কৃতিক লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন।
পিয়াস মজিদ বলেন, “উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যুক্ত থেকে রবীন্দ্রনাথকে তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌছে দেওয়া। তিনি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে যেমন কাজ করেছেন, একই সাথে কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদদীন নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ নিয়ে কাজ করেছেন। তার বাবা মোতাহার হোসেন রচনাবলী প্রকাশসহ নানা বিষয়ে তিনি অনেক অমূল্য কাজ করেছেন।
“সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, সুফিয়া কামাল এবং তার বাবা কাজী মোতাহার হোসেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামকে তাদের বাড়িতে দেখা। এই সকল সাংস্কৃতিক পরম্পরা তিনি বহন করে বেড়ে উঠার মধ্য দিয়েই সন্জীদা খাতুনের সাংস্কৃতিক মন গড়ে উঠেছে এবং তিনি ৯০ বছরের জীবনে ধারাবাহিকভাবে এই চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এটা অনেক বড় বিষয়।”
রবীন্দ্র গবেষক হিসেবে ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত গবেষণাধর্মী বই ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’কে একটি ‘দুর্দান্ত কাজ’ বলে অভিহিত করেন পিয়াস মজিদ।
প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্যর কর্ণধার আরিফুর রহমান নাঈম বলেন, সন্জীদা খাতুনের বর্ণিল জীবনের নয় দশক পূর্তির মাহেন্দ্রক্ষণে ঐতিহ্য দুই খণ্ডে প্রকাশ করেছে তার রবীন্দ্র বিষয়ক বিপুল রচনার সংকলন ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’। গ্রন্থ দুটোর প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী ধ্রুব এষ।
দুই খণ্ডের ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ ধারণ করেছে সন্জীদা খাতুনের রবীন্দ্রযাপন, বাঙালি জীবন, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথের অবদান, রবীন্দ্রকবিতা, রবীন্দ্রসংগীত এবং রবীন্দ্রভাবনার দশ দিগন্ত নিয়ে নানা স্বাদের রচনা৷ একই সঙ্গে শান্তিনিকেতন, শিলাইদহ, পতিসরসহ বিভিন্ন রবীন্দ্রতীর্থ নিয়ে লেখকের স্মৃতি ও অবলোকনও স্থান পেয়েছে ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ এ।
সন্জীদা খাতুন রচিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবসম্পদ’, ‘রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে’, ‘রবীন্দ্রনাথ: তাঁর আকাশ ভরা কোলে’, ‘রবীন্দ্রনাথ: বিবিধ সন্ধান’, ‘তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য’, ‘রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ’, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত: মননে লালনে’, ‘রবীন্দ্র-বিশ্বাসে মানব-অভ্যুদয়’। রবীন্দ্র বিষয়ক তাঁর সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে আছে ‘রইল তাঁহার বাণী: রইল ভরা সুরে’, ‘গীতবিতান: তথ্য ও ভাবসন্ধান’, ‘সার্ধশততম জন্মবর্ষে রবীন্দ্রনাথ’।
একাধারে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সঙ্গীতজ্ঞ এবং শিক্ষক সন্জীদা খাতুন রবীন্দ্র চর্চা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রসারে অবদানের জন্য একুশে পদকে ভূষিত।
এশিয়াটিক সোসাইটির সাম্মানিক ফেলো সনজীদা বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার, বিশ্বভারতী প্রবর্তিত দেশিকোত্তম সম্মাননায় ভূষিত হন।
সম্প্রতি ভারত সরকারের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’ খেতাবে ভূষিত হন তিনি।