সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের শঙ্কা, নিচের সড়কে যানজট ‘বাড়বে’, জলাবদ্ধতা দেখা দেবে, ফুটপাত সংকুচিত পথচারীরা মূল সড়কে চলতে বাধ্য হবে।
Published : 27 Mar 2024, 10:12 PM
ঢাকার বিমানবন্দর মোড় থেকে-গাজীপুর পর্যন্ত দেশের প্রথম বাস র্যাপিড-ট্রানজিট বা বিআরটি প্রকল্পের নকশায় ত্রুটির কথা জানিয়ে ক্ষোভ ঝেড়েছেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম।
তার বিবেচনায় এসব ‘ত্রুটির’ কারণে প্রকল্পটির সুফল পাবে না গাজীপুরের মানুষ, উল্টো ভোগান্তির কারণ হবে। তার অভিযোগ, নানা অসংগতি ও ত্রুটি রেখে অর্থ ও সময়ের অপচয় করা হয়েছে।
সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়রের প্রধান উপদেষ্টার দাবি, বিআরটির বাস নির্বিঘ্নে চললেও নিচে যানজট ‘বাড়বে’, জলাবদ্ধতা দেখা দেবে, পথচারীদের হাঁটার ফুটপাত সংকুচিত হওয়ায় তারা সড়কে চলতে বাধ্য হবে, এতে দেখা দেবে দুর্ঘটনার শঙ্কা।
বুধবার বিকেলে গাজীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভাওয়াল সম্মেলন কক্ষে বিআরটি প্রকল্প নিয়ে গণশুনানিতে এসব কথা বলেন জাহাঙ্গীর।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়ন ও ব্যবহার সংক্রান্ত প্রেজেনটেশন উপস্থাপন করা হয়। তবে গাজীপুরের সাবেক মেয়র বলেন, “আজকে ভিডিও প্রেজেনটেশনে প্রকল্পের যে ডিজাইনটি দেখানো হয়েছে তার সঙ্গে বাস্তবে মিল নেই।”
তার বিবেচনায় প্রকল্পে নানা ‘অসংগতি’ ও ভুল করায় একদিকে যেমন অর্থের অপচয় হচ্ছে তেমনি সময় মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। এর সঙ্গে জড়িত ডিজাইনার ও প্রকৌশলীদের বিভাগীয় মামলা ও গ্রেপ্তারের দাবিও জানিয়েছেন। বলেছেন, “যদি পাঁচ হাজার টাকা চুরি করলে কোর্টে হাজিরা দিতে হয়, তাহলে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা নষ্ট করল, লক্ষ লক্ষ মানুষের ক্ষতি ও ভোগান্তি করল, তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না?”
২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর একনেক বিআরটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। শুরুতে ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। এরপর কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেটিও হয়নি। চলতি বছরের অগাস্টে কাজ শেষ হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
বিআরটি প্রকল্পের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, বিআরটি বাস্তবায়িত হলে ১০০টি আর্টিকুলেটেড বাসের মাধ্যমে প্রতি ঘণ্টায় ২৫ হাজার মানুষ যাতায়াত করবে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানজট অনেকটাই কমে যাবে।
জাহাঙ্গীরের বিবেচনায় যেসব ‘ত্রুটি’
গাজীপুরের সাবেক মেয়র বলেন, টঙ্গী থেকে গাজীপুর শহর পর্যন্ত ১১৩টি সাবরোড করার কথা ছিল। কিন্তু করা হয়েছে ৫৬টি।
গাজীপুরে সাড়ে চার লাখ পোশাক শ্রমিক আছে, রাস্তার দুই পাশে কয়েক হাজার বাড়ি আছে এবং সাতশর মত কারখানা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ড্রেনেজ ব্যবস্থায় ত্রুটি নিয়ে ২০১৮ সালে জানানো হয়েছিল। কিন্তু সে ত্রুটি দূর করা হয়নি। বলা হয়েছিল ১০টি হকার্স মার্কেট করে দেওয়ার জন্য। তাও করা হয়নি।
“থেকে যে সবল যানবাহন চলাচল করবে, সেগুলো ব্রিজের নিচে অপ্রশস্ত রাস্তা ব্যবহার করতে গিয়ে যানজট লেগেই থাকবে।”
জলাবদ্ধতার আশঙ্কা করে তিনি বলেন, “রাস্তার পাশে ৫টি খাল রয়েছে, এগুলো ভরাট হয়ে গেছে। খালগুলো খনন না করায় বর্ষার সময় বৃষ্টির পানি, বন্যার পানি কীভাবে গড়াবে তার কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি।”
বিআরটি স্টেশনগুলো খাড়া এবং উঁচু ব্রিজে বয়স্ক মানুষের পক্ষে উঠা-নামায় সমস্যা হবে বলেও মত দেন জাহাঙ্গীর। বলেন, “অনেক ক্ষেত্রেই পথচারীদের চলাচলের ফুটপাথের উপরে ব্রিজের খুঁটি স্থাপন করা হয়েছে। ফলে মানুষকে ফুটপাত ছেড়ে সড়কে নামতে হচ্ছে।
“এতে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ও যানজটের সৃষ্টি হতে পারে। এসব ডিজাইন করার সময় সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার ও কর্মকর্তাদের বিবেক খাটানো উচিত ছিল।”
বিআরটির অংশ ছাড়া বাকি সড়ক রাস্তা অপ্রশস্ত হওয়ায় একটি গাড়ি চলতে গিয়েই সমস্যা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “তাই যানজট কমার চেয়ে আরো তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”
পথচারীদের রাস্তা পারাপারেও যথেষ্ট রাখা হয়নি মত দিয়ে গাজীপুরের সাবেক মেয়র বলেন, “ডিজাইনে ত্রুটি বিচ্যুতি থাকায় এই প্রকল্পের ফলাফল থেকে বঞ্চিত হবে মানুষ।”
তিনি ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ, প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করে বিআরটির অংশ ছাড়া বাড়ি সড়ক প্রশস্ত করা ও ফুটপাত নির্মাণের পরামর্শ দেন।
আব্দুল্লাহপুর থেকে গাজীপুর শহর পর্যন্ত একটি এবং আশুলিয়া থেকে কড্ডা পর্যন্ত আরো একটি বিকল্প সড়কে নির্মাণের দাবিও জানান তিনি।
প্রেজেনটেশনে যা বলা হয়
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব একেএম শামীম আক্তার বলেন, “আগামী অগাস্টের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে এ পথে বিআরটি বাস চলাচল শুরু করবে।”
অনুষ্ঠানে ড্রেনেজ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ফুটপাত, ফুট ওভারব্রিজ নিয়ে যে সব সমস্যার কথা উঠে এসেছে তা নিরসনে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসও দেন তিনি।
ভিডিও প্রেজেন্টেশনে বলা হয়, প্রকল্পে ১৩৭টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস চলবে। বিআরটি লেনে অন্য কোনো গাড়ি চলবে না, লেনের দুই পাশে ব্যারিকেড দেওয়া থাকবে৷
এসব বাসে ভাড়া আদায়ে কেউ থাকবে না। ডিজিটাল পদ্ধতিতে টাকা আদায় করা হবে। ২০.৫ কিলোমিটার রাস্তায় ২৫ টি স্টেশন থাকবে। গাজীপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাতায়াতে সময় লাগবে ৩৫ থেকে ৪০ মিনিট।
প্রকল্পের আওতায় ৫একর জমিতে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন বাস ডিপো নির্মাণ করা হয়েছে জানিয়ে বলা হয়, এর করিডরের দুপাশে ৩৪ কিলোমিটার ফিডার রোড নির্মাণ করা হয়েছে। এর দুপাশে ২৪.৪২ কিলোমিটার ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে।
এ প্রকল্পের ৯টি ফ্লাইওভারের মধ্যে ৭টি খুলে দেয়া হয়েছে গত ২৪ মার্চ। ৩২ কিলোমিটার ফুটপাতের ৪০ শতাংশ শেষ হয়েছে।
গণশুনানিতে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিআরটি প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. মুনিরুজ্জামান, প্রকল্প পরিচালক এএসএম ইলিয়াস, গাজীপুর ডিসি আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম, গাজীপুর মহানগর পুলিশের (ট্রাফিক) উপ-কমিশনার মো. আলমগীর হোসেন।
আরো পড়ুন:
ঈদযাত্রা সহজ করতে খুলল বিআরটি প্রকল্পের ৭ ফ্লাইওভার
বিআরটি প্রকল্প: ঢাকা-ময়মনসিংহ উড়াল সড়কের এক লেন চালু
গাড়ি ‘চলে না’ চান্দনা চৌরাস্তার ফ্লাইওভারের খুলে দেওয়া অংশে, নিচে যানজট