“আমি তো জাল টাকাটা ধরতে পারতাম না। উনারা ধরছেন, নইলে এক হাজার টাকাই লস হইয়া যাইত,” বলেন এক খামারি।
Published : 28 Jun 2023, 01:29 AM
কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে ১০টি গরু নিয়ে এসেছেন খামারী বাদশা মিয়া। হাটে জাল টাকার পাশাপাশি বড় অঙ্কের অর্থ বহন করা নিয়ে ছিলেন ভয়ে। তবে এবার তার ভয় কেটেছে কোরবানির পশুর হাটে ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থায়।
ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ি হাটে স্থাপিত ডিজিটাল পেমেন্ট বুথের সেবায় তিনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন হাটে অবস্থানের দিন বা রাতের সময়টুকুতে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানান, ক্রেতার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার আগে বুথ থেকে জাল টাকার মেশিনে যাচাই করে নিয়েছেন। তা আবার অ্যাকাউন্টে জমাও দিয়েছেন।
ঝুঁকিমুক্ত থাকতে পারার স্বস্তি নিয়ে তিনি বলেন, “আমি বাকিতে গরু নিয়ে আসছি। একটা গরু বিক্রি কইর্যা কাস্টমার ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা দিসে। এখানে আইসা টাকাটা চেক (জাল টাকা কি না সেটা শনাক্ত) কইরা নিসি। আর এইখানে জমা দিসি। আমার অ্যাকাউন্টে যে জমা হইছে সেইটাও মোবাইলে এসএমএস আসছে। আমি বাড়ি গিয়া চেক বা কার্ড দিয়া তুইল্যা নিব।”
চুয়াডাঙ্গার মোতালেব হোসেনও এ ডিজিটাল ব্যবস্থার উপকারিতার কথা তুলে ধরে জানান, দুটি গরু এনেছেন তিনি। এর মধ্যে একটা সোয়া দুই লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। সেই টাকা সঙ্গে না রেখে ওই সময়ই ব্যাংকে জমা করে দিয়েছেন।
তার ভাষ্য, “আরেকটা গরু যতক্ষণ বিক্রি না হয় এই টাকা কাছে রাখা রিস্ক। বাজারে যতক্ষণ আছি, যতক্ষণ পর্যন্ত না টাকাটা বাড়িতে পৌঁছাচ্ছে নিরাপত্তা নাই। এজন্য বুথটা করাতে আমাদের জন্য সুবিধা হইছে। আমি এইখানে টাকা জমা দিয়া দিলাম, চুয়াডাঙ্গায় আমাদের ব্র্যাঞ্চ থেকে তুলে নিব।”
দিয়াবাড়ির এ হাটসহ ঢাকার কোরবানির পশুর আটটি হাটকে ‘স্মার্ট হাট’ ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এসব হাটে রয়েছে ডিজিটাল পেমেন্ট বুথ; যা ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কেই নগদ টাকা বহনের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে। এ ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন।
৯৯৯: কোরবানির পশুর গাড়ি নিয়ে টানাহেঁচড়া, চাঁদাবাজির ২৮২ অভিযোগ
কোরবানির পশুর হাটে বৃষ্টির বাগড়া
অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেতা-বিক্রেতাদের সুবিধা দিতে বুধবার রাত ১০টা পর্যন্ত এসব হাটের পাশের ব্যাংক শাখা খোলার নির্দেশ দিয়েছে।
এতে বাসা-বাড়ি থেকে নগদ টাকা বহন না করেও হাটে এসে কোরবানির পশু কিনতে পারছেন ক্রেতারা। আবার বিক্রেতা গরু বিক্রির টাকা সঙ্গে না রেখে ডিজিটাল পেমেন্ট বুথে বা ব্যাংক শাখায় এসে জমা দিয়ে দিচ্ছেন।
ডিজিটাল লেনদেনের ব্যবস্থা থাকা অন্য হাটগুলো হল- ভাটারা (সাঈদনগর), কাওলা, শিয়ালডাঙ্গা, আফতাবনগর, মোহাম্মদপুরের বছিলা, গাবতলী হাট, মিরপুর ইস্টার্ন হাউজিং ও ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের খেলার মাঠের হাট।
হাটগুলোয় এবি ব্যাংক লিমিটেড, ব্যাংক এশিয়া লিমিটেড, ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড, আইএফআইসি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড, পূবালী ব্যাংক লিমিটেড, সিটি ব্যাংক লিমিটেড ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের বুথ করা হয়েছে। সেখানে কার্ডে মূল্য পরিশোধ ছাড়াও মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা কোম্পানি বিকাশ, নগদ, উপায় ও এমক্যাশেও টাকা লেনদেনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
মঙ্গলবার ঢাকার কোরবানির পশুর হাটে গিয়ে ক্রেতা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্মার্ট হাটের এই ডিজিটাল লেনদেনের পরিমাণ এখনও খুব বেশি না। তবে ধীরে ধীরে এর ব্যবহার বাড়ছে।
উত্তরার দিয়াবাড়ি হাটে গরু কিনতে আসা সরকারি কর্মকর্তা আতিকুর রহমান সঙ্গে আনা টাকার চেয়ে বেশি দামের গরু পছন্দ করে দরদাম ঠিক করে ফেলেন। তাকে বিব্রত হওয়া থেকেও রক্ষা করেছে ডিজিটাল এ ব্যবস্থা। আশপাশে কোনো এটিএম বুথ না পেয়ে শেষে হাটে থাকা ডিজিটাল লেনদেনের বুথে গিয়ে বাড়তি কয়েক হাজার টাকা তুলে ব্যাপারিকে পরিশোধ করেন তিনি।
তিনি বলেন, “স্মার্ট লেনদেনের সুবিধা রাখায় বেশ ভালো হয়েছে। নইলে বেশ ঝামেলায় পড়ে যেতাম।”
দিয়াবাড়ী হাটে সেবা দিচ্ছে বেসরকারি ব্র্র্যাক ব্যাংক। এ বুথের দায়িত্বপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক দীপক চন্দ দাস জানান, সোমবার এ হাটে তাদের বুথে দেড় কোটি টাকার বেশি লেনদেন করেছেন। মঙ্গলবার দিন শেষে আগের দিনের চেয়ে দ্বিগুণ লেনদেন হবে বলে ধারণা তার।
এ কর্মকর্তা বলেন, কোনো ধরনের সার্ভিস চার্জ ছাড়াই বুথে সেবা নিয়ে ক্রেতারা তাদের ঝুঁকি কমিয়েছেন বিনামূল্যে। বিক্রেতারা এখানে এসে তাদের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করছেন। তা না হলে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুদের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাচ্ছেন। তা সম্ভব না হলে এখানেই অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হচ্ছে। এটাই ডিজিটালের সুফল, যোগ করেন তিনি।
ঢাকার আটটি স্মার্ট হাটের ডিজিটাল বুথের কার্যক্রম সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য তুলে ধরে দীপক চন্দ্র দাস জানান, মঙ্গলবারের লেনদেনের তথ্য পাওয়া যাবে বুধবার। সোমবার পর্যন্ত চারটি ছাড়া বাকি ব্যাংকগুলোতে ২৭০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। ৪ হাজার ১৮১টি লেনদেনের মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতারা ১৫ কোটি ২৬ লাখের বেশি টাকা লেনদেন করেছেন।
তিনি জানান, মঙ্গলবার বিকালের পর থেকে হাটগুলোতে বিক্রি বেড়েছে। তখন বুথগুলোতে সেবা দিতেও হিমশিম খেতে হয়েছে। বুধবার তা আরও বাড়বে।
আফতাবনগর হাটে নওগাঁর খামারি আফজাল হোসেন জানান, গরু বিক্রির টাকা হাতে পেয়ে ডিজিটাল লেনদেনের বুথে এসে পরীক্ষা করেছেন তিনি। এতে এক হাজার টাকার একটা নোট জাল পাওয়া গেছে।
“আমি তো জাল টাকাটা ধরতে পারতাম না। উনারা ধরছেন, নইলে এক হাজার টাকাই লস হইয়া যাইত। আর আমার টাকাও আমি ব্যাংকের বুথে দিয়া দিছি। গরু বিক্রির সব টাকাই এম্নে পাঠামু। পথে চোর, ডাকাত, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টির কোনো ভয় থাকল না,” বলেন তিনি।
এ হাটের ইজারাদার আবদুল মান্নান বলেন, হাটের মোট লেনদেনের অন্তত ২০ শতাংশ হচ্ছে ডিজিটাল মাধ্যমে। এটা খুবই ভালো কাজ হয়েছে। বিশেষ করে বিক্রেতারা ঝুঁকি নিচ্ছেন না।
মঙ্গলবার দিয়াবাড়ি হাট পরিদর্শনে যান ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
ডিজিটাল লেনদেনের বুথ পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের জানান, ২০২১ সালে পরীক্ষামূলক উদ্যোগে সাড়া মেলায় এবার স্মার্ট হাট বাড়ানো হয়েছে। এ ব্যবস্থা পছন্দের কোরবানির পশু কিনতে একজন ক্রেতার কিছু টাকার কম পড়ে যাওয়ার মতো বিব্রত হওয়া থেকে যেমন মুক্তি দিয়েছে, তেমনি বিক্রেতাকেও টাকা বহনের মতো চরম ঝুঁকি থেকে স্বস্তি দিয়েছে। ডিজিটাল লেনদেনের কারণেই তা সম্ভব হয়েছে।