“হাটে গেলে গরু লাথি দিতে পারে। জায়গায় জায়গায় গোবর থাকায় আছাড় খাওয়ারও সম্ভাবনা আছে। এই ঝুঁকি কে নেয়?” বলেন একজন।
Published : 27 Jun 2023, 12:45 AM
তপ্ত রোদে সশরীরে হাটে যাওয়ার কথা শুনলেই চোখ কপালে ওঠে অনেকের; সেই ঝক্কির সঙ্গে নাগরিক ব্যস্ততা তো আছেই। তারা এখন স্মার্টফোনের পর্দায় আর দশটা দরকারি কাজের মতো কোরবানির পশু কেনাও সারতে চান।
তাদেরই একজন ঢাকার ব্যবসায়ী রেজাউল আলম, যিনি সবসময় পশুর হাটে গিয়ে কোরবানির গরু কিনলেও গত দু’বছর ধরে কিনছেন অনলাইন থেকে। এ বছরও ফেইসবুক পেজে কয়েকটি গরু দেখে রেখেছেন তিনি।
উত্তরার এই বাসিন্দা রোববার বলছিলেন, “আমি অনলাইনে গরু দেখছি। কিন্তু কেনার আগে ফার্মে গিয়ে সরাসরি দেখতে হবে। মঙ্গলবার যাব দেখতে, ওইদিনই কিনে আনব।”
তবে এবার অনলাইনে ঢুঁ মেরে গরুর দাম বেশি ঠেকেছে রেজাউলের কাছে। তার কথায়, “বিভিন্ন ফার্মে কথাবার্তা বলে যা বুঝলাম, এবার আগের চেয়ে দাম বেশি পড়বে। ৬০০ টাকার উপরে কেজি। গতবার এর চেয়ে কম ছিল।
“তবে দাম বেশি পড়লেও আসলে অনলাইন থেকে দেখে গরু কেনা শান্তির। কারণ হাটে গেলে গরু লাথি দিতে পারে। জায়গায় জায়গায় গোবর থাকায় আছাড় খাওয়ারও সম্ভাবনা আছে। এই ঝুঁকি কে নেয়?”
ঝক্কি এড়াতে দিন কয়েক আগে অনলাইনে গরু কেনার কথা জানালেন দারাজ বাংলাদেশে কর্মরত ওমর ফারুক। ঢাকার বছিলা এলাকার ‘সাহারা অ্যাগ্রো’ ফার্ম থেকে তিনি ৫০০ কেজি (লাইভ ওয়েট) ওজনের একটি গরু কিনেছেন ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকায়।
ওমর ফারুক বললেন, “গরুটার ছবি আমি প্রথমে দেখি তাদের ফেইসবুক পেজে। কিন্তু তখনও ভাবি যে আমি এটাই কিনব। জাস্ট এমনিতে ওনাদের সাথে কথা বলে একদিন ফার্মে গেলাম গরুটা দেখতে। গিয়ে দেখলাম যে ছবির সাথে বাস্তবে গরুর পুরোপুরি মিল আছে। দেখতে খুবই সুন্দর। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম যে এবার আমি এটাই কিনব।
“এর আগে আমি কখনও অনলাইন থেকে গরু কিনিনি। এবারই প্রথম এবং গরুটা কিনে আমি সন্তুষ্ট। কারণ হাট থেকে কিনলে সেই গরু বাসায় নিয়ে যাওয়া লাগে। কিন্তু ফার্ম থেকে কিনলে এই ঝামেলা থাকে না। যেমন আমার বাসা বসুন্ধরায়। কাল ওরা গরু দিয়ে যাবে বাসায়।”
তার কাছেও গরুর দাম আগেরবারের চাইতে বেশিই মনে হচ্ছে।
ওমর ফারুক বলেন, “গতবার আমি হাট থেকে কিনেছিলাম। হাট থেকে তো ওয়েট দিয়ে কেনা যায় না, চোখের আন্দাজে কিনতে হয়।
“তাই গতবারের গরুর ওজন কত ছিল, সেটা স্পেসিফিক্যালি বলতে না পারলেও- এটা সিওর যে ওটার ওজন এবারেরটার কাছাকাছিই ছিল। কিন্তু গতবার সেই গরুর দাম পড়েছিল ২ লাখ টাকা।”
দাম আসলেই বেশি?
গরুর দাম নিয়ে কথা হচ্ছিল বছিলার সাহারা অ্যাগ্রোর কর্ণধার আবিদুদ্দীন রাহাতের সঙ্গে। জানালেন, লালন-পালন খরচা বেড়ে যাওয়ায় খামারিদের খরচ বেড়েছে। সেই কারণে গতবারের তুলনায় এবার কোরবানির পশুর দাম বেড়েছে।
আবিদের ভাষ্যে, “বিষয়টা খুব সহজ। গরুর দাম বেশি, কারণ বাজারে গরুর খাবারের দাম বেশি। গরুকে আমরা গম খাওয়াই। কিন্তু দেশে এখন গম আসতেছে না। আর আসলেও যে গমের কেজি ছিল ২৭ টাকা, সেটা এখন আমাদেরকে কিনতে হচ্ছে ৫২ টাকায়।
“আর হাটের থেকে ফার্মের গরুর দাম স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশি পড়বে। কারণ ফার্মে গরুর পরিচর্যা হয় বেশি। আমরা আমাদের গরুগুলোকে সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা দিয়েছি। বেস্ট খাবার দিয়েছি।”
এই খামারি জানালেন, এবার তার খামারে যে গরুর ওজন (লাইভ ওয়েট) ৫০০ কেজি, তা বিক্রি হয়েছে ২ লাখ টাকার উপরে। আর সবচেয়ে বেশি দামে যে গরু বিক্রি হয়েছে, তার ওজন ছিল ১০৫০ কেজি। ক্রেতাকে গুনতে হয়েছে সাড়ে ৭ লাখ টাকা।
অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আড়ৎ-এর কর্ণধার আরিফুজ্জামান তুহিনের বক্তব্যও একই রকম।
“আমরা যে গরুগুলো বিক্রি করছি, সেগুলো আমরা বাজারের কোনো ফিড খাওয়াই না। খড়-কুটো, ভুষি, খৈল ইত্যাদি দেই। ঈদের দুই-একদিন আগে গরু কাস্টমারের হাতে পৌঁছে দিচ্ছি।
“কাস্টমার কোনো হ্যাসেল ছাড়াই গরু কিনতে পারছেন। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই হাটের থেকে ফার্মের গরুর দাম একটু বেশি পড়বে।”
মাস চারেক আগে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১৪টি গরু এনে পরিচর্যার কথা উল্লেখ করে তুহিন বলেন, “প্রথমবার, তাই কম আনছি। এতগুলো মাস ধরে গরুগুলোকে আমরা একটা সুন্দর পরিবেশে রাখছি। ফার্মের খরচ আছে। কর্মী খরচ আছে। সবমিলিয়ে আমাদের কাছে ১ লাখ ৪০ হাজারের নিচে কোনও গরু নাই।”
কত দামে গরু বিক্রি করছেন? উত্তরে তিনি বললেন, “আমরা লাইভওয়েট করে গরু বিক্রি করি। … আমরা কেজিপ্রতি ৫৫০ টাকা করে চাইছি। হয়ত ৫১০-৫০০ করে দিবে।”
অনলাইনে যেভাবে বিকিকিনি
ওয়েবসাইট বা ফেইসবুকে গরুর সম্পূর্ণ বিবরণ থাকে। অনেকক্ষেত্রে প্রাণীটির ছোট ছোট স্টোরি বা ভিডিও থাকে। কেউ কেউ ইউটিউব চ্যানেলেও গরুর ভিডিও দিয়ে থাকেন। এসব দেখে ক্রেতারা যোগাযোগ করে। তারপর ক্রেতা খামারে গরু দেখতে যায়। গিয়ে পছন্দ হলে দরদাম করে। তবে এমন অনেক ক্রেতা আছে, যারা পরিচিত মানুষদের বা নির্ভরযোগ্য খামার থেকে গরু কিনে। সেক্ষেত্রে আস্থা নিয়ে সংকট না থাকায় অনলাইন বা ফোনে ক্রয়াদেশ দেয়। পেমেন্টের ক্ষেত্রে ব্যাংক পেমেন্ট বেশি হয়, ক্যাশও দেয় অনেকে। সাধারণত খামার মালিকরা গরুর দামের ভেতরেই ডেলিভারি খরচা রেখে দেয়। ঢাকায় খামারগুলো কোরবানির ২-৩ দিন আগে থেকে ডেলিভারি শুরু করে। ট্রাকে করে গরু পাঠানোর সময় ওই ২-৩ দিনের খাবারও দিয়ে দেন খামারি। অনেকেই আবার অনলাইনে ধারণা নিয়ে খামারে গিয়ে লাইভ ওয়েট দেখে সরাসরি ক্রয়াদেশ দিয়ে থাকে।
অবশ্য প্রতিষ্ঠান ভেদে দাম কমবেশিও দেখা গেল, যেমন মাংস প্রক্রিয়াজাতকারী শীর্ষ কোম্পানি বেঙ্গল মিটের অনলাইন হাটে কেজি ধরা হচ্ছে ৬৩০ টাকা করে।
বাড়তি দামের ব্যাখ্যায় কোম্পানিটির হেড অব মার্কেটিং শেখ ইমরান আজিজ বলেন, “এবার এমনিতেই দাম বেশি। তাছাড়া আমরা আমাদের গরুগুলোকে শেষ তিন মাস সম্পূর্ণভাবে অর্গানিক ঘাস খাওয়াই। কারণ এতে চর্বিটা কম হয়। আর বাজারে সবকিছুর দামই তো বেশি এখন।”
অনলাইন নির্ভরতা বাড়ছে
অনলাইনে গরুর দাম খানিকটা বেশি হলেও নির্ভরযোগ্য খামার থাকায় মানুষ এখন হাটের ঝক্কি এড়াতে চাইছেন বলে মনে করেন উদ্যোক্তা তুহিন।
বাজার পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি বলছিলেন, “অনলাইনে যারা গরু কিনেন, এরা উচ্চ মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত। দেখা যায় যে- এদের প্রায় সবারই ফ্ল্যাট বা গাড়ি আছে। তারা অনলাইন থেকে কিনে, কারণ এটা হ্যাসেল ফ্রি।
“আর এমন মানুষ আছে, যারা হাটে এত ভিড়ের মাঝে দরদাম করে কেনার ঝক্কি নিতে চায় না বা পারে না। সেই তুলনায় তারা ফার্মের গরুর মানের ওপর আস্থা রাখতে পারে। চেনা-পরিচিতদের থেকে কিনলে সন্দেহ থাকে না। ট্রাস্টও একটা বড় ফ্যাক্টর এখানে।”
আরেক উদ্যেক্তা রাহাত কথায় কথায় জানালেন, কুষ্টিয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ থেকে প্রথমবারের মতো তারা ৩৫টি গরু ও ৩০টি খাসি এনেছিলেন। সেগুলোর বিক্রি এখন শেষের দিকে।
“আমরা নিজেরা উইকেন্ডে দেশের বিভিন্ন এলাকার হাটে হাটে গিয়ে এই গরু ও খাসিগুলো সোর্সিং করেছি। প্রায় ৯ থেকে ১১ মাস ধরে এই এগুলোকে ফার্মে লালন-পালন করছি। আর এখন বিক্রিও শেষ।
‘মানুষ ফেইসবুক পোস্ট দেখেই বেশি এসেছে। খাসি তো একটাও নাই। গরুও প্রায় সব শেষ বলা যায়।”
কোরবানি উপলক্ষে ইতোমধ্যে ১৫০টি খাসি বিক্রি করার কথা জানিয়ে রোববার বেঙ্গল মিটের কর্মকর্তা শেখ ইমরান বলেন, “চাহিদা তো অনেক। কিন্তু লোকবলের সংকটের জন্য চাইলেও আমরা পাঁচশর বেশি গরু কোরবানি করতে পারব না। কারণ কোরবানির পরদিন সবাইকে (যারা কমপ্লিট সলিউশন নেয়) যার যার বাসায় মাংস পৌঁছে দিতে হবে।
“আর যারা লাইভ ক্যাটেল/ফার্ম থেকে গরু কিনে, তাদের কাছে এই গরুগুলোকে পাঠাতে হবে। আগামীকাল থেকে আমরা গরু ডেলিভারি দেওয়া শুরু করব।”
এবার ব্যবসার পরিস্থিতি কেমন? ইমরানের উত্তর, “কোভিডের সময়টা ছিল আমাদের ব্যবসার জন্য হাইয়েস্ট পিক। কোভিডের পরও রেসপন্স ভালো ছিল। কিন্তু যদি গতবারের সাথে তুলনা করি, এবার গতবারের চেয়ে রেসপন্স বেশি।”