ভূমিকম্প: ক্ষয়ক্ষতি কমানোর উপায় কী?

“এখানে কাছের বা দূরের বড় বিষয় নয়। এ অঞ্চলের ভেতরে যদি ৬ মাত্রার উপরে ভূমিকম্প হয়; এতে কম বেশি ঢাকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে আর ৮ মাত্রার ভূমিকম্প যদি ঢাকা থেকে দূরেও হয় তবুও ক্ষয়ক্ষতি বাড়বে,” বলেন ভূতত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 May 2023, 03:16 AM
Updated : 6 May 2023, 03:16 AM

বড় ভূমিকম্পে ঢাকার কী হবে তা নিয়ে দীর্ঘদিনের শঙ্কা আবারও সামনে এসেছে সাত সকালের এক ভূকম্পনে; ঘুম ভাঙানিয়া এ ঘটনার পর এক বিশেষজ্ঞ মহড়া বাড়ানোর পাশাপাশি অ্যাপভিত্তিক গেইমের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরিতে জোর দিয়েছেন।

রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের অন্য জেলায় শুক্রবার সকালের ঘুম ভাঙে ভূমিকম্পের দুলুনিতে; রিখটার স্কেলে যেটির মাত্রা ছিল ৪.৩। এ ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র ছিল ঢাকার দোহারে এবং উৎপত্তিস্থল ছিল ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে।

ভোর ৫টা ৫৭ মিনিটে রাজধানীর এত কাছেই হওয়া এ ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি না থাকলেও ঘুম জড়ানো নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল বেশি।

ঠিক ১০ দিন আগে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকায় রিখটার স্কেলে ৩.৯ মাত্রার আরেকটি ভূকম্পন হয়েছিল।

কাছাকাছি সময়ে কম মাত্রার এমন ভূকম্পনে ক্ষয়ক্ষতি না হলেও গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন থেকে ঢাকা মহানগর ভূমিকম্পের কারণে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে গবেষণার তথ্য এবং বিভিন্ন পরিসংখ্যান-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানিয়ে আসছেন।

বিশেষজ্ঞরা আগে থেকেই বলে আসছেন, দুটো প্লেটের (ইন্ডিয়ান ও বার্মা প্লেট) সংযোগস্থলে বাংলাদেশ অবস্থিত হওয়ার কারণে এখানে বড় ভূকম্পনের ঝুঁকি থাকে। এছাড়া নদ-নদীর গতি পরিবর্তন হওয়ায় তা দেশে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি তৈরি করেছে।

শুক্রবারের ভূমিকম্পের পর ভূতত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার ঘনঘন মহড়ার মাধ্যমে ভূমিকম্পের সময়ে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন।

পাশাপাশি কিশোর ও তরুণদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে এ নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে অ্যাপভিত্তিক গেইমের মতো ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের তাগিদ দিয়েছেন।

বর্তমানে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করা এই বিশেষজ্ঞ বলেন, আড়াইহাজার এলাকায় ২৫ এপ্রিলে ও শুক্রবার দোহার এলাকায় মৃদু মাত্রার যে ভূমিকম্প হল, এগুলো হচ্ছে সঞ্চিত বড় শক্তির বের হওয়ার প্রবণতা। সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ হাওর এলাকার কাছাকাছি ফল্ট রেখার পূর্ব অংশটুকু বার্মাপ্লেট। এখানে ৮ মাত্রার বেশি ভূকম্পনের শক্তি জমা হয়ে আছে। যে কোনো সময় ভূমিকম্প হতে পারে। এ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলম্বিয়া ল্যামন্ট ডোহার্টি আর্থ অবজারভেটরির যৌথ গবেষণা রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ অধ্যাপকের মতে, “এখানে কাছের বা দূরের বড় বিষয় নয়। এ অঞ্চলের ভেতরে যদি ৬ মাত্রার উপরে ভূমিকম্প হয়; এতে কম বেশি ঢাকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর ঢাকার অতি নিকটে হলে বেশি ক্ষতি করবে। আর ৮ মাত্রার ভূমিকম্প যদি ঢাকা থেকে দূরেও হয় তবুও ক্ষয়ক্ষতি বাড়বে।”

ঢাকাসহ শহরগুলো যেভাবে অপরিকল্পিত, অনিয়ন্ত্রিভাবে গড়ে উঠেছে, তাতে জনসংখ্যার যে ঘনত্ব বড় ভূমিকম্প হলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি অনুমেয়, মনে করেন তিনি।

তার মতে, “কিন্তু এখন যদি আমরা প্রস্তুতি নিই এবং জনগণকে দুর্যোগ মোকাবিলায় মহড়ার মাধ্যমে সচেতন করতে পারি তাহলে ক্ষয়ক্ষতি কম হবে।“

তবে দুই দশক ধরে এত তাগিদ দেওয়ার পরও সেভাবে মহড়া হয় না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

Also Read: ভূমিকম্প: ঝুঁকি থাকলেও আতঙ্ক নয়, চাই সচেতনতা

Also Read: ভূমিকম্পের কেন্দ্র গভীরে বলে ক্ষয়ক্ষতি কম: বিশেষজ্ঞ

অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন ভূমিকম্পের প্রবণতা থাকলেও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে মহড়াকেই একমাত্র কৌশল হিসেবে তুলে ধরে বলেন, আতঙ্ক না ছড়িয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আতঙ্কে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি বাড়ে। এখন দরকার মহড়া।

তার পরামর্শ, ঢাকা শহর বা নগরগুলোয় ওয়ার্ডভিত্তিক নিয়মিত মহড়ার আয়োজন করতে হবে। প্রতি বছরে একবার করলেও হবে। ঢাকা শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে পালাক্রমে বছরের যে কোনো সময় সচেতনতামূলক মহড়া করতেই হবে।

১০ মার্চ জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস ও ১৩ অক্টোবর দুর্যোগ প্রশমন দিবসে ভূমিকম্প, অগ্নিনির্বাপণসহ নানা ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় মহড়ার আয়োজন ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিয়ে থাকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

শুক্রবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) যুগ্ম সচিব মো. আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, “বিশেষ করে এ দুটি দিবসে রাজধানীসহ মহানগর, জেলা, উপজেলা পযায়ে স্বেচ্ছাসেবক কমিটি রয়েছে, সমন্বিতভাবে মহড়ার আয়োজন করে থাকি। সেই সঙ্গে নানা ধরনের আলোচনা, প্রচারণা, প্রশিক্ষণসহ নানা উদ্যোগ রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস মহড়ার কাযক্রমও চালিয়ে আসছে।”

তিনি জানান, দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসে জনগণ ও সংশ্লিষ্টদের সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রশিক্ষিত লোকবল তৈরি, উদ্ধার ও মহড়ার জন্যে যুগোপযোগী যন্ত্রপাতি কেনার কাজও চলমান রয়েছে।

সব ধরনের প্রস্তুতি থাকার পরও অপরিকল্পিত নগরায়ন যে বড় ঝুঁকি তৈরি করে দিচ্ছে তা বলেছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন।

তার ভাষ্য, অনেকই বলছেন, যে কোনো সময় ঢাকা শহরে এমন ভূমিকম্প হতে পারে। এমন বিপর্যয় মোকাবেলায় আমরা বিভিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছি।

“অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা, জনবল প্রশিক্ষিত করাসহ প্রয়োজন অনুযায়ী জনবল বাড়ানো হচ্ছে। সাথে সাথে আমাদের সাথে যারা এসব বিপর্যয়ে কাজ করবেন, যেমন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ বা অন্যান্য বিভাগ রয়েছে, তাদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।”

চাই মহড়া, মহড়া আর মহড়া

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন জানান, বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার মতো দুটি উৎস আছে। সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলের সাবডাকশন জোন এবং ডাউকি ফল্ট, যার পূর্বপ্রান্ত সুনামগঞ্জ থেকে জাফলং পর্যন্ত বিস্তৃত।

এ দুটি উৎস থেকে যে কোনো সময় ভূমিকম্প হতে পারে। সাবডাকশন জোনে ইন্ডিয়া প্লেট বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। তার মানে যে শক্তি জমা হয়ে আছে, তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এমন প্রেক্ষাপটে তার পরামর্শ, “ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলার একমাত্র পথ মহড়া, মহড়া, মহড়া।

Also Read: ৪.৩ মাত্রার ভূমিকম্পে কাঁপল ঢাকা

Also Read: ভূমিকম্প মোকাবেলায় সমন্বয়ে ঘাটতি, স্বীকার ডিজির

Also Read: সিলেটের ভূকম্পন: ‘বড় ভূমিকম্পের’ ইঙ্গিত, মহড়ার তাগিদ

Also Read: ভূমিকম্প: ঢাকা কতটা প্রস্তুত?

“এর সঙ্গে মোবাইল অ্যাপসের গেইমের মাধ্যমে জনগোষ্ঠীকে সচতেন করতে পারবো। গেইমিং বিষয়টি হচ্ছে-শিশু ও তরুণ সমাজ এখন বিভিন্ন গেইম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সেখানে আমরা যদি ন্যাচারাল হ্যাজার্ড নিয়ে গেইম তৈরি করি তাহলে গেইমের মাধ্যমে ধাপে ধাপে একেকটা পর্ব পার হতে গিয়ে সচেতনতা গড়ে উঠবে।”

তিনি জানান, শুধু ভূমিকম্প নয়, বন্যা, বজ্রপাত, ভূমিধসসহ নানা ধরনের দুর্যোগ নিয়ে খেলা থাকবে। গেইমে থাকবে কীভাবে নিরাপদ থাকতে হবে, কোথায় যেতে হবে, সব থাকবে। স্টেপ বাই স্টেপ খেলতে গিয়ে সচেতনতার বিষয়গুলো যুক্ত থাকলে অতি সহজেই জেনে যাবে।

“সরকার যদি উন্মুক্ত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমের এ ধরনের অ্যাপ তৈরির আহ্বান জানায় অনেকে পার্টিসিপেট করবে। এ গেইমের মাধ্যমে নাগরিকদের বড় একটা অংশ সচেতনও হবে,” যোগ করেন তিনি।

ভূমিকম্পের সময় করণীয়

>> ভূকম্পন অনুভূত হলে আতঙ্কিত হবেন না।

>> ভূকম্পনের সময় বিছানায় থাকলে বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে টেবিল, ডেস্ক বা শক্ত কোনো আসবাবপত্রের নিচে আশ্রয় নিন।

>> রান্না ঘরে থাকলে গ্যাসের চুলা বন্ধ করে দ্রুত বেরিয়ে আসুন।

>> বিম, কলাম ও পিলার ঘেঁষে আশ্রয় নিন।

>> শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকালে স্কুল ব্যাগ মাথায় দিয়ে শক্ত বেঞ্চ অথবা শক্ত টেবিলের নিচে আশ্রয় নিন।

>> ঘরের বাইরে থাকলে গাছ, উঁচু বাড়ি, বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে দুরে খোলা জায়গায় আশ্রয় নিন।

>>গার্মেন্ট কারখানা, হাসপাতাল, মার্কেট ও সিনেমা হলে থাকলে বের হওয়ার জন্য দরজার সামনে ভিড় কিংবা ধাক্কাধাক্কি না করে দুহাতে মাথা ঢেকে বসে পড়ুন।

>> ভাঙা দেয়ালের নিচে চাপা পড়লে বেশি নড়া চড়ার চেষ্টা করবেন না। কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখুন, যাতে ধুলাবালি শ্বাস নালিতে না ঢোকে।

>> একবার কম্পন হওয়ার পর আবারও কম্পন হতে পারে। তাই সুযোগ বুঝে বের হয়ে খালি জায়গায় আশ্রয় নিন।

>> উপর তলায় থাকলে কম্পন বা ঝাঁকুনি না থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে; তাড়াহুড়ো করে লাফ দিয়ে বা লিফট ব্যবহার করে নামা থেকে বিরত থাকুন।

>> কম্পন বা ঝাঁকুনি থামলে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ুন এবং খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিন।

>> গাড়িতে থাকলে ওভার ব্রিজ, ফ্লাইওভার, গাছ ও বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে দূরে গাড়ি থামান। ভূকম্পন না থামা পর্যন্ত গাড়ির ভিতরে থাকুন।

>> ব্যাটারিচালিত রেডিও, টর্চলাইট, পানি এবং প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম বাড়িতে রাখুন।

>> বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ করুন।