সিলেটের ভূকম্পন: ‘বড় ভূমিকম্পের’ ইঙ্গিত, মহড়ার তাগিদ

সিলেট অঞ্চলে চার ঘণ্টার মধ্যে মৃদু মাত্রার হলেও যেভাবে পাঁচ-ছয়বার ভূকম্পন ঘটে গেল, তাকে ভূতাত্ত্বিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এই এলাকায় যে কোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 May 2021, 05:31 PM
Updated : 29 May 2021, 07:03 PM

সদ্য ঘটে যাওয়া ভূকম্পনগুলোর সময় মানুষের মধ্যে দেখা দেওয়া আতঙ্ক ও ভবিষ্যতের বড় বিপদ বিবেচনায় প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ভূমিকম্পের সময় করণীয় বিষয়ে শিগগির মহড়া অনুষ্ঠানের উপরও জোর এসেছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র জানায়, শনিবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টার মধ্যে সিলেটে অন্তত পাঁচটি ভূকম্পন ধরা পড়ে, যেগুলোর সবটির কেন্দ্রস্থল ছিল ঢাকা থেকে ১৯৬ থেকে ২৩২ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত আর্থ অবজারভেটরির পরিচালক ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সামান্য তিন মাত্রার হলেও ৩০-৪০ মিনিটের ব্যবধানে ঘন ভন ভূমিকম্প হওয়ায় সিলেটবাসী আতঙ্কিত হয়ে গেছে। একই এলাকায় মোট ছয়বার কম্পন হয়েছে। এটাকে ‘আফটার শক’, ‘ফোর শক’- কিছুই বলা যাবে না।

“এই ভূকম্পন একটা ইঙ্গিত বহন করে যে, এটা সক্রিয় এবং ভবিষ্যতে এখানে বড় মাত্রার ভূমিকম্প যে কোনো সময় হতে পারে। যেহেতু প্রচুর শক্তি জমে আছে।“

অধ্যাপক হুমায়ুন জানান, দেশে ‘বিপজ্জনক ভূকম্পনের’ প্রধান দুটি উৎস আছে। এর একটা হচ্ছে ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাউকি ‘ফল্ট’। আরেকটা হচ্ছে টেকনাফ-পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল সাবডাকশন জোন।

আর্থ অবজারভেটরি ভূকম্পনগুলোর উৎপত্তিস্থল হিসেবে শনাক্ত করেছে সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকার লালাখাল সংলগ্ন এলাকাকে, যেটা বিপজ্জনক ডাউকি ‘ফল্টের’ পূর্ব প্রান্তের কাছাকাছি।

পৃথিবীর উপরিভাগের ৭০-১০০ কিলোমিটার পুরুত্বের লিথোস্ফিয়ার ছোট-বড় ১৩টি খণ্ডে (প্লেটে) বিভক্ত। উত্তপ্ত ও নরম এস্থোনোস্ফিয়ারের ওপর ভাসমান এ প্লেটগুলো গতিশীল।

প্লেটগুলো গতিশীল থাকায় ভূখণ্ড ধীরে ধীরে সরতে থাকে, যেটাকে ‘অ্যাকটিভ ফল্ট’ বা সক্রিয় চ্যুতি বলা হয়। প্লেটের স্থানচ্যুতির সময় জমে থাকা শক্তি বিপুল বেগে বের হয়, তখন সংযোগস্থলে ভূম্পন হয়।

বাংলাদেশের উত্তরে ইন্ডিয়ান প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল; পূর্বে বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের সংযোগস্থল। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সিলেটের ডাউকি অঞ্চলে রয়েছে এমন ফল্ট।

আর 'সাবডাকশন জোন' সমুদ্র তলদেশের এমন এলাকা যেখানে দুটি টেকটনিক প্লেট মুখোমুখি অবস্থানে থাকে এবং প্লেট দুটো পরস্পরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। এমন অবস্থায় একটি টেকটনিক প্লেট আরেকটি নিচে চলে গেলে সৃষ্টি হয় ভূমিকম্প।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের উপকূল বরাবর বঙ্গোপসাগরের এক বিশাল 'সাবডাকশন জোন'  রয়েছে।

আবহাওয়াবিদ মমিনুল ইসলাম বলেন, “সিলেট অঞ্চল ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ। একারণে যে এখানে বড় ধরনের ডাউকি ফল্ট রয়েছে। সিলেট থেকে ৫০-৬০ কিলোমিটার দুরে এ চ্যুতি। ফল্টলাইনগুলোকে ভূকম্পন হয়।”

ঝুঁকি মোকাবেলায় ভূকম্পনের মহড়া

ভূতত্তবিদ হুমায়ুন বলেন, ১৯২২ সালে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল হবিগঞ্জ অঞ্চলে; ১৯১৮ সালেও ৭.৫ মাত্রার হয়েছিল। চার বছরের ব্যবধানে বড় ভকম্পন ছিল শত বছর আগে। এক মাস আগে ডাউকি ফল্টেরই উত্তর প্রান্তে আসাম সীমান্তে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। তার মানে এ ‘ডাউকি ফল্ট খুব সক্রিয়’।

“ডাউকি ফল্ট ও টেকনাফ সাবডাকশন জোনে হাজার বছর ধরে যে পরিমাণ শক্তি ক্রমান্বয়ে সঞ্চয় হয়ে আসছে, তাতে আট মাত্রার অধিক ভূকম্পন সংগঠিত করতে পারে। এ শক্তি একবারেও বের হতে পারে; আবার আংশিক বের বের হতে পারে। সেটা আমরা বলতে পারি না।

এ অধ্যাপক বলেন, “ঝুঁকি রয়েছে, সেজন্য আমরা হুমকির মুখেও রয়েছি। ভূমিকম্পের দুর্যোগ মোকাবেলায় মানসিক প্রস্তুতি দরকার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে মহড়া ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে। 

“অনেক বছর আগে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এটা চলমান রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা- মহড়া প্রতিবছর করতে হবে।”

ভূমিকম্পের ঝাঁকুনির ফলে সিলেট শহরে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। অনেকেই উঁচু ভবন থেকে রাস্তায় নেমে আসেন। কেউ কেউ ভয়ে নিরাপত্তার কথা ভেবে শহুরে কংক্রিটের দালান ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন বলেও খবর এসেছে গণমাধ্যমে।

তবে ভূমিকম্পে কোথাও কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।

অধ্যাপক হুমায়ুন বলেন, সিলেটে মহড়া করা থাকলে এমন আতঙ্ক বিরাজ করতো না। করোনায় যেমন মাস্ক আবশ্যক, ভূমিকম্পের সচেতনতায় মহড়াও তেমন আবশ্যক।

প্রস্তুতির বিষয়ে তিন শহরে মেয়রদের উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান এই ভূতত্ত্ববিদ।

তিনি বলেন, “ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে প্রত্যেকটি সিটি মেয়রকে শহরে মহড়া আয়োজনের ব্যবস্থা করতে হবে। স্বেচ্ছাসেবক পুরনো ও নতুনদের নিয়ে ট্রেইন্ড আপ করতে হবে- একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখতে হবে। নিরাপদ জায়গাগুলো জানতে হবে। ”

আবহাওয়াবিদ মমিনুল বলেন, “ভূমিকম্প হবেই, এখন সচেনতামূলক প্রস্তুতি নিতে হবে। এর মধ্যে ‘বিল্ডিং কোড মেনে’ ভবন তৈরি করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে ভবন তৈরি না করলে দুর্যোগে উদ্ধার কাজও ব্যাহত হবে। প্রস্তুতি থাকতে হবে যেন নিয়ম মেনে স্থাপনা তৈরি করতে হবে। তাতে ছোট-মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি রোধ করা সম্ভব হবে।”

ভূমিকম্প হলে কোনোভাবে আতঙ্কিত না হয়ে কাজ করার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। ভূমিকম্পের সময় সময় নষ্ট না করে ভবনের পিলারের কাছাকাছি অবস্থান করতে হবে। প্রাথমিকভাবে পারলে টেবিল বা খাটের নিচে অবস্থান করতে হবে, যাতে ভাঙ্গা টুকরো শরীরে না লাগে। আর ভবন থেকে বেরুতে পারলে একটু ফাঁকা এলাকায় অবস্থান করতে হবে।

সেই সঙ্গে উদ্ধার ও সেবা দিতে উপযুক্ত প্রস্তুতি থাকতে হবে।

আরও পড়ুন: