এই চিকিৎসক অভিযোগ করেছিলেন, তার অনুপস্থিতিতে তার নামে রোগী ভর্তি করেছিল সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
Published : 06 Jul 2023, 03:58 PM
‘মানহানিকর’ বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সংযুক্তা সাহার বিরুদ্ধে ‘মানিস্যুট’ মামলা করেছে ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ঢাকার ধানমণ্ডির নামি এ হাসপাতালের কোম্পানি সেক্রেটারি দিদারুল ইসলাম পারভেজ বৃহস্পতিবার ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ মাসুদুল হকের আদালতে মামলাটি দায়ের করেন।
বাদীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম আদালতপাড়ার সাংবাদিকদের বলেন, “আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ কোর্ট ফি আমরা আদালতে জমা দিয়েছি। আদালত মামলা নিয়ে বিবাদী সংযুক্তা সাহার বিরুদ্ধে সমন জারি করেছেন।”
ওই সমন সংযুক্তা সাহার ঠিকানায় পৌঁছানো গেল কি না, সে বিষয়ে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ২৫ জুলাই তারিখ রেখেছে আদালত।
এ ধরনের মামলায় কোর্ট ফি নির্ধারণ করা হয় দাবি করা ক্ষতিপূরণের অংকের ওপর। তবে সেই ফি হতে পারে সর্বোচ্চ ৫৭ হাজার ৫০০ টাকা। সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে সেই টাকাই দিতে হয়েছে।
কুমিল্লার গৃহবধূ মাহবুবা রহমান আঁখি এবং তার নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই আলোচনায় ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতাল এবং ডা. সংযুক্তা সাহা।
ইতোমধ্যে সংযুক্তা সাহাসহ কয়েকজন চিকিৎসক এবং সেন্ট্রাল হাসপাতালের কয়েকজন কর্মীর বিরুদ্ধে অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগে ফৌজদারি মামলা করেছেন আঁখির স্বামী মুহাম্মদ ইয়াকুব আলী।
সেন্ট্রাল হাসপাতাল শুরু থেকেই গাফিলতির জন্য ডা. সংযুক্তা সাহাকে দায়ী করে আসছিল। অন্যদিকে ডা. সংযুক্তা সংবাদ সম্মেলন ডেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছিলেন।
ওই বক্তব্য প্রত্যাহার চেয়ে গত ২২ জুন সংযুক্ত সাহাকে উকিল নোটিস পাঠিয়েছিলেন সেন্ট্রাল হাসপাতালের আইনজীবী। সংযুক্ত সাহা তা না করায় এবার মামলা করা হল।
কী ঘটেছিল
অস্ত্রোপচার ছাড়া সন্তান জন্ম দিতে নিজের ইচ্ছের কথা স্বামীকে জানিয়েছিলেন কুমিল্লার তিতাস উপজেলার আঁখি। সেজন্য গর্ভে সন্তান আসার পর থেকে ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সংযুক্তা সাহার চিকিৎসা নেন তিনি।
প্রসবব্যথা উঠলে গত ৯ জুন মধ্যরাতে কুমিল্লা থেকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে আঁখিকে নিয়ে আসেন তার পরিবার। আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলীর ভাষ্য, প্রসূতিকে ভর্তির সময় চিকিৎসক সংযুক্তা হাসপাতালেই আছেন বলা হলেও আসলে তিনি ছিলেন না।
সেই রাতে ওই চিকিৎসকের সহকারীরা প্রথমে স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা প্রসবের চেষ্টা করেন। সে সময় জটিলতা তৈরি হলে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুটি ওইদিনই মারা যায়।
সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় আঁখিকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ জুন তার মৃত্যু হয়।
ওই ঘটনায় সেন্ট্রাল হাসপাতালে সব ধরনের অস্ত্রোপচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। হাসপাতালের চিকিৎসকদের অনলাইনে কোনো ধরনের প্রচারে দেওয়া হয় নিষেধাজ্ঞা।
গাইনি ও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহা ওই হাসপাতালে আপাতত কোনো বিশেষজ্ঞ সেবা দিতে পারবেন না বলে নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এর মধ্যেই চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ এনে ধানমণ্ডি থানায় মামলা করেন আঁখির স্বামী মুহাম্মদ ইয়াকুব আলী। ডা. সংযুক্তা সাহার দুই সহযোগী চিকিৎসক শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা ও মুনা সাহাকে ওই মামলায় গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ।
ডা. সংযুক্তা সাহার পাশাপাশি ডা. মিলি এবং চিকিৎসা সহকারী জমির, এহসান ও হাসপাতালের ব্যবস্থাপক পারভেজের নাম রয়েছে আসামির তালিকায়।
সেন্ট্রাল হাসপাতাল তথ্য গোপন করে এবং ভুল চিকিৎসার মাধ্যমে আঁখি ও তার নবজাতক সন্তানকে ‘হত্যা করেছে’দাবি করে বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলেও (বিএমডিসি) লিখিত অভিযোগ করেছেন ইয়াকুব আলী।
পাল্টাপাল্টি
আঁখি ও তার সন্তানের মৃত্যুতে যে সেন্ট্রাল হাসপাতালের অবহেলা ছিল, গত ১৯ জুন তা স্বীকার করে নেন এ চিকিৎসা কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক ডা. এটিএম নজরুল ইসলাম। তবে তিনি প্রথমত সংযুক্তা সাহাকেই দায়ী করেন।
কী গাফিলতি ছিল, সে প্রশ্নে নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, “গাফিলতি ছিল প্রথমত ডা. সংযুক্তা সাহার, তারপর ওটির চিকিৎসকদের। কারণ সে সময় তারা সিনিয়র ডাক্তারদের ডাকেনি।”
পরদিন নিজের পরীবাগের বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন ডা. সংযুক্তা সাহা।
তিনি দাবি করেন, আঁখিকে যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, তখন তিনি দেশেই ছিলেন না। তাকে ‘না জানিয়ে’ ওই রোগীকে ভর্তি করা হয়েছে। সুতরাং শিশু ও মায়ের মৃত্যুতে তার কোনো দায় ‘ছিল না’।
“যে মানুষটা দেশেই নাই তার নাম করে কেন রোগী ভর্তি করবেন? এটা কার স্বার্থে? আমি যদি অপারেশন না করি,যদি নাই থাকি, তাহলে রোগী ভর্তি করালেন কোন আক্কেলে? এটা অবশ্যই একটা বেআইনি ব্যবস্থা। এ ঘটনার জন্য একমাত্র দায়ী সেন্ট্রাল হাসপাতাল।”
সিজারিয়ান অপারেশন বন্ধ করার জন্য ‘সামাজিক আন্দোলন’ শুরু করেছেন দাবি করে এই চিকিৎসক বলেন, সে কারণে একটা পক্ষ তার বিরুদ্ধে ‘এসব কাজ করছে’।
“ওই মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিডিয়া ট্রায়াল হচ্ছে। আমি সবাইকে আহ্বান জানাব, আপনারা এই অনিয়মের সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।"
সংযুক্তা সাহা অভিযোগ করেন, কোনো চিকিৎসকের অধীনে রোগী ভর্তির ক্ষেত্রে নিজস্ব কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা সেন্ট্রাল হাসপাতালে নেই। বরং বছরের পর বছর ধরে কোনো চিকিৎসকের ‘লিখিত সম্মতি না নিয়েই’ রোগী ভর্তি করা হয়। মাহবুবা রহমান আঁখিকে ভর্তি করার সময়ও তার ‘সম্মতি নেওয়া হয়নি’।
“আঁখিকে ভর্তির সময় আমার উপস্থিতির ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মিথ্যা বিবৃতি দিয়েছে যে আমি বাংলাদেশে আছি। হাসপাতালের এ ধরনের অসদাচরণ এবং অপরাধমূলক পদক্ষেপ… আমার সুনামকে বেআইনিভাবে পুঁজি করেছে। এটা কিছু আর্থিক লাভের জন্য রোগীকে বিভ্রান্ত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। হাসপাতাল তাদের অনিয়মের সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য আমাকে সহজ লক্ষ্যে পরিণত করেছে।”
অন্যদিকে সেন্ট্রাল হাসপাতালের ব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ বুধবার দাবি করেন, সংযুক্তা সাহার নামে রোগী ভর্তির অভিযোগ ‘ঠিক নয়’।
“উনার নামে কোনো রোগী ভর্তি করা হয়নি। কিন্তু উনার কাছে যে এক্সিস্টিং রোগী ছিল সেগুলো তিনি প্রফেসর সামিনা এবং মিলি ম্যাডামের কাছে অ্যাসাইন করে গেছেন। উনারা রাউন্ড দেবেন ট্রিটমেন্টের কিন্তু সংযুক্তা ম্যাডামের প্রটোকল মেনে। উনার নামে কোনো রোগী ভর্তি হয়েছে কিনা সেটা কাগজই কথা বলবে।”
ব্যবস্থাপক বলেন, কোনো কনসালটেন্ট দেশের বাইরে গেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ব্যক্তিগতভাবে একটা লিখিত নোটিস দেন। কিন্তু সংযুক্তা সাহা অফিসিয়ালি কাউকে বলে যাননি।
এরপর ২২ জুন সংযুক্ত সাহাকে উকিল নোটিস পাঠান সেন্ট্রাল হাসপাতালের আইনজীবী। সংযুক্তা সাহার ‘মানহানিকর’ বক্তব্য সাতদিনের মধ্যে প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয় সেখানে।
সংযুক্তা সাহা তার সংবাদ সম্মেলনে ‘একাধিক মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর’ তথ্য দিয়েছেন অভিযোগ করে উকিল নোটিসে বলা হয়, “সংযুক্তা সাহা বলেছেন আঁখি তার রোগী ছিল না, এ বিষয়ে হাসপাতাল মিথ্যা বিবৃতি দিয়েছে। আঁখিকে ভর্তির বিষয়ে হাসপাতাল সংযুক্তা সাহার কোনো সম্মতি নেয়নি, অস্ত্রোপচারের সময় তিনি সেখানে উপস্থিত না থাকলেও কীভাবে তাকে ওই ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছে- সংযুক্তা সাহার এই বক্তব্যও ভিত্তিহীন।”
ওই ‘মিথ্যা, বানোয়াট’ বক্তব্যের কারণে সেন্ট্রাল হাসপাতালের খ্যাতি এবং সুনামের ক্ষতি হয়েছে দাবি করে নোটিসে বলা হয়, সাত দিনের মধ্যে সংবাদ সম্মেলনে করা ‘মিথ্যা বক্তব্য’ প্রত্যাহার করে একটি বিবৃতি দিতে হবে সংযুক্তা সাহাকে। সেই বিবৃতি গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংযুক্তা সাহার অফিসিয়াল পেইজে দিতে হবে। না হলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুরনো খবর