চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রতিকারের ব্যবস্থা কতটা কার্যকর?

এত বছরেও সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া যায়, এমন একটি ঘটনাও ‘পায়নি’ বিএমডিসি। সেখানে গিয়ে হতাশ হওয়ার কথা বলছেন অভিযোগকারীরা।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 June 2023, 07:26 PM
Updated : 23 June 2023, 07:26 PM

ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসায় অবহেলার শিকার হলে ক্ষতিগ্রস্তের প্রতিকার পাওয়ার যে ব্যবস্থাপনা, তা আসলে কতটা কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রতিকারের জন্য তদারকি সংস্থাটির নাম বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল বা বিএমডিসি। কিন্তু সেখানে অভিযোগকারীরা হতাশ।

তারা বলছেন, অভিযোগ নিয়ে গেলে শুরুতেই তাদের নিরুৎসাহিত করা হয়, তারা বিশ্বাস করতে চায় না আর অভিযোগ নিলেও শুনানিতে দেরি হয়।

আইনের বলে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটির ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতাও সীমিত। খুব বেশি শাস্তি তারা দিতেও পারে না।

সেই সঙ্গে আবার অভিযোগ রয়েছে, বিএমডিসির কর্তাব্যক্তিরা সবাই চিকিৎসক। তারা একই পেশার অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনাগ্রহ দেখান।

তবে বিধিবদ্ধ সংস্থাটির পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ স্বীকার করা হয় না। তাদের ভাষ্য, কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার একটি প্রক্রিয়ার বিষয়। সেগুলো শেষ করতে কিছুটা দেরি হয়।

চিকিৎসা নিতে গিয়ে অন্যায্য আচরণ, অবহেলা বা ভুল চিকিৎসায় অঙ্গ বা প্রাণ হারানোর ঘটনায় ক্ষোভ-বিক্ষোভ বাংলাদেশে এক নিয়মিত ঘটনা। এসব ঘটনায় হাসপাতাল বা চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে প্রায়ই, এর প্রতিক্রিয়ায় আবার চিকিৎসক ধর্মঘটে ভোগান্তির উদাহরণও কম নয়।

চিকিৎসার জন্য ভারতে রোগীদের যাওয়ার পেছনে দেশের চিকিৎসকদের আচরণ ও ভুল চিকিৎসার অভিযোগের বিষয়টি একাধিকবার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বয়ানেও উঠে এসেছে। কিন্তু এর প্রতিকার করতে পারত যে সংস্থাটি, সেই বিএমডিসিকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ চোখে পড়ে না।

ঢাকার বেসরকারি চিকিৎসালয় সেন্ট্রাল হাসপাতালে ‘অবহেলায়’ প্রসূতি ও তার সন্তানের মৃত্যুর পর রোগীর প্রতিকার না পাওয়ার এই বিষয়টি আবার সামনে এসেছে।

অভিযোগ যেভাবে করতে হয়

ভুল চিকিৎসা, চিকিৎসায় অবহেলা বা চিকিৎসাজনিত অভিযোগের প্রতিকার পেতে ঢাকার বিজয় নগরে বিএমডিসিতে লিখিত অভিযোগ দিতে হবে।

অভিযোগটি নথিভুক্ত করার পর যায় বিএমডিসির ট্রেজারারের কাছে। তিনি যদি মনে করেন, অভিযোগটি ডিসিপ্লিনারি কমিটির বৈঠকে এজেন্ডা হিসেবে দেওয়া দরকার, তাহলেই সেটি কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়। তিনি যদি মনে করেন, দরকার নেই, তাহলে সেখানেই ‘সব শেষ’।

ডিসিপ্লিনারি কমিটির বৈঠকে অভিযোগগুলো বিশ্লেষণের পর অভিযোগকারী এবং বিবাদীকে চিঠি দেওয়া হয়। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকে জবাব দিতে ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়।

এরপর শুনানির জন্য নির্দিষ্ট দিনে শৃঙ্খলা কমিটি দুপক্ষের বক্তব্য শোনে। কমিটি মনে করলে অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য বিশেষায়িত তদন্ত কমিটিও গঠন করতে পারে।

বিষয়ভিত্তিক তদন্তের সুবিধার জন্য বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজের বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়। বিএমডিসি অভিযোগ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেয়।

ওই কমিটি কাগজপত্র পরীক্ষা করে যদি মনে করে যে, বাদী-বিবাদীর সঙ্গে আরও কথা বলা দরকার, তাহলে তারা দুই পক্ষকে আবার ডাকবেন। ফলে কয়েক দফা বৈঠক করতে হয়, কয়েক মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।

বিশেষজ্ঞ কমিটি তদন্ত শেষে শৃঙ্খলা কমিটির কাছে সুপারিশ করে। শৃঙ্খলা কমিটি সব তদন্ত প্রতিবেদন, সবগুলো বৈঠকের প্রতিবেদন দেখে, বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় অভিযুক্ত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তদন্ত কমিটি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে, আর শৃঙ্খলা কমিটি যদি মনে করে সবকিছু ঠিকঠাক আছে, তাহলে একটা সিদ্ধান্তে চলে আসে। আর কখনও যদি তদন্ত কমিটি শাস্তির সুপারিশ করে কিন্তু শাস্তির মেয়াদ বলে না দেয়, তখন সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে শৃঙ্খলা কমিটি।

শৃঙ্খলা কমিটির সুপারিশ যায় কার্যনির্বাহী কমিটির কাছে। সেখানে আরেকবার অভিযোগের বিষয়ে আলোচনা হয়। এই কমিটি সুপারিশ অনুমোদন করলে বিএমডিসি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়।

বিএমডিসির ভারপ্রাপ্ত ট্রেজারার লিয়াকত হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সুপারিশ বাস্তবায়নের পদ্ধতি হচ্ছে, সিদ্ধান্তটা নিয়ে অভিযুক্তকে চিঠি দেওয়া হয়। তাকে সাতদিনের সময় দেওয়া হয় আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য। তার উত্তর যদি গ্রহণযোগ্য না হয়, যদি নতুন কিছু প্রমাণ করতে না পারে সেক্ষেত্রে শাস্তি কার্যকর করা হয়।”

অভিযোগ নিতেই গড়িমসির অভিযোগ

২৯ বছর বয়সী এক তরুণীকে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ নিয়ে বছরখানেক আগে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের বিরুদ্ধে বিএমডিসিতে যান মেয়েটির বাবা শেখ জসিম। তবে সেখানে তিনি যথেষ্ট সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।

জসিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিএমডিসিতে গিয়েছিলাম। তারা লামছাম (যেনতেন) বোঝানোর চেষ্টা করেছে। তাদের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র ভরসা নাই। কারণ চিকিৎসকরা নিজেদের পেশার মানুষকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেবে না।

“এ কারণে বিএমডিসির পাশাপাশি উচ্চ আদালতেও আমি মামলা করেছি। চিকিৎসায় অবহেলাজনিত অপরাধের জন্য বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে চাই।”

২০১৯ সালের শেষদিকে আরেক তরুণীর মৃত্যুর পর তার বাবা চিকিৎসকের বিরুদ্ধে বিএমডিসিতে অভিযোগ করেন ২০২১ সালে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “অনেক মানুষ জানেই না বিএমডিসিতে অভিযোগ করা যায়। আবার অভিযোগ করলেও সঠিক বিচার পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়েও সংশয় আছে।

“দুই বছরের বেশি সময় হল, আমি অভিযোগ করেছি। কিন্তু এখনও বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। আর সর্বোচ্চ বিচার হল রেজিস্ট্রেশন বাতিল। একটা বিষয় হতে পারে, বিচার যেহেতু চিকিৎসকরাই করেন, তারা নিজের কমিউনিটির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে যেতে পারেন না।”

২০২২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় মরিয়ম জামান আরফিয়া নামে আট বছর বয়সী এক শিশু।

এই ঘটনায় সেই হাসপাতালের দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে বিএমডিসিতে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ করেন শিশুটির বাবা-বা।

ছয় মাস পর চলতি বছরের ২৫ মার্চ শিশুটির বাবা আরিফ উজ জামান এবং মা জোবাইদা আলমকে শুনানির জন্য ডেকে পাঠায় বিএমডিসি। সেদিনের পর এখন পর্যন্ত আর কোনো অগ্রগতি নেই।

জুবাইদা আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এরপর আর কোনো খোঁজ নেই তাদের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করেনি। আর ঘটনার ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও একবার মাত্র শুনানি হয়েছে। ১০ মাসে যদি তদন্তই শেষ না হয় তাহলে বিচার কবে পাব জানি না। বিএমডিসির বিচারের এই পদ্ধতিতে আমি খুশি না।”

সেন্ট্রাল হাসপাতালে প্রসবের জন্য আসা মাহবুবা রহমান আঁখির মৃত্যুর ঘটনায় তার স্বামী ইয়াকুব আলী সুমন থানায় মামলার পাশাপাশি বিএমডিসিতেও অভিযোগ করতে যাচ্ছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “থানায় একটা লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। বিএমডিসিতেও ভুল চিকিৎসা এবং চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ জানাব। আমি গ্রামের বাড়িতে আছি, দুয়েকদিনের মধ্যেই ঢাকায় ফিরে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেব।”

তার অভিযোগে এরই মধ্যে সেন্ট্রাল হাসপাতালের দুই চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সেখানে সব ধরনের অস্ত্রোপচার বন্ধ হয়েছে।

চিকিৎসক সংযুক্তা সাহা এবং সেন্ট্রাল হাসপাতাল- দুই পক্ষই গাফিলতি স্বীকার করেছে। তবে নিজেদের দায় অস্বীকার করে একে অন্যকে দায়ী করছে।

অভিযোগের নিষ্পত্তি কত?

  • বিএমডিসির তথ্য বলছে, গত ১২ বছরে ২৬৮টি লিখিত অভিযোগ এসেছে সংস্থাটিতে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অভিযোগের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে।

  • ২০১০ সালে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে এসেছিল চারটি অভিযোগ, ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় আটে।

  • ২০১৬ সালে ছয়টির পরের বছর ১৪টি এবং ২০১৮ ও ২০১৯ সালে জমা পড়ে ২৬টি করে অভিযোগ।

  • কোভিড মহামারীর বছর ২০২০ সালে অভিযোগ কমে ৮টি হলেও পরের দুই বছর জমা পড়ে যথাক্রমে ৩২ ও ৩১টি অভিযোগ।

  • চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ৭টি অভিযোগ এসেছে বিএমডিসিতে।

  • এসব অভিযোগের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৪টির, যা জমা পড়া অভিযোগের ১২ দশমিক ৬৮ শতাংশ।

  • ৫০ জন চিকিৎসকের নিবন্ধন সনদ যাচাই চলছে, ২৮ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

  • অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত ১২ বছরে একজন চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে, ১২ জনের বিভিন্ন মেয়াদে নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে। তবে এই স্থগিত সময়ে তারা চিকিৎসা সেবা দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন, সেই নিশ্চিত করা সম্ভবপর হয়নি।

সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া যায়, এমন একটি ঘটনাও ‘পায়নি’ বিএমডিসি

বিএমডিসির ভারপ্রাপ্ত ট্রেজারার মো. লিয়াকত আলী অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, বিএমডিসি চিকিৎসকদের জন্য নয়, রোগীদের পক্ষে কাজ করে।

“আমাদের কাছে অভিযোগ এলে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিচারের প্রক্রিয়া শেষ করি। আগে বিএমডিসি নিয়ে অনেকেরই একটা ভুল ধারণা ছিল যে বিএমডিসি চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে না। কিন্তু আমরা এক বিন্দুও ছাড় দিই না। এখন সাধারণ মানুষের আস্থা আস্তে আস্তে বাড়ছে, ফলে অভিযোগের পরিমাণও বেড়েছে।”

এখনও পর্যন্ত মাত্র একজনের লাইসেন্স বাতিলের বিষয়ে তিনি বলেন, “সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত সার্টিফিকেট স্থগিত করেছি আমরা, সর্বনিম্ন তিন মাস।

“সনদ বাতিলের ক্ষমতা আমাদের আছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে রকম কোনো ঘটনা আমরা পাইনি,যাতে সার্টিফিকেট বাতিল করা যায়।”

অভিযোগ নিষ্পত্তিতে সময় বেশি লাগার কারণ হিসেবে লিয়াকত বলেন, “আমাদের কাছে অভিযোগ বেড়েছে। ফলে দেখা গেছে এজেন্ডায় আমি পাঁচটা আনব ওইদিকে ২০টা অভিযোগ জমে গেছে। এজন্য প্রক্রিয়াটা শেষ করতে সময় লাগছে।”

`টেবিলের নিচে ফয়সালা’

জাতীয় স্বাস্থ্য আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অভিযোগকারীদের ৯০ শতাংশই পরে বিষয়টি মিটমাট করে ফেলে। এ কারণে বিচারপ্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত যেতে পারে না।”

তিনি বলেন, “তারা দরখাস্ত দিয়েই খালাস, কেইসগুলি কনটেস্টই করে না। বিচার পেতে হলে তো প্রসিডিউর অনুযায়ী যেতে হবে। কিন্তু আন্ডার দ্য টেবিল ফয়সালা করে ফেলে।”

রোগীর স্বার্থ রক্ষায় বিএমডিসি যথেষ্ট শক্তিশালী কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “বিএমডিসি দলবাজিতে চলে। সেখানে যারা আছেন তাদের ৯০ শতাংশ সরকারের মদদপুষ্ট।

“এককালে নির্বাচিত হত, কিন্তু এখন সরকারের পছন্দের না হলে এখানে আসার কোনো সুযোগ নেই। যারা সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে তারা কি অ্যাফিসিয়েন্ট লোক?”