বুদ্ধিজীবী দিবসে বাবা-মায়ের হাত ধরে স্মৃতিসৌধে দেখা যায় শিশু-কিশোরদের, তাদের হাতে ছিল রক্তবর্ণ গোলাপ; অভিভাবকদের কেউ কেউ গল্পের ছলে তাদের বলছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের ইতিহাস।
Published : 14 Dec 2022, 04:27 PM
ভোরের আলো ফুটতেই মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের পথে ছিল ফুল আর ব্যানার হাতে হাজারো মানুষের ঢল, শোকের গাম্ভীর্য নিয়ে ছোট-বড় সকলে সেই জনস্রোতে যোগ দিয়েছিলেন স্বাধীনতার চূড়ান্ত বিজয়ের আগে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরদের হাতে শহীদ বাঙালির সূর্যসন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতে।
সেই জনস্রোতে মিশে পাঁচ বছরের মেয়ে নাবিহাত ফেরদৌসকে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে নিয়ে আসেন বাবা নাজিম উদ্দিন। মেয়েকে ১৪ ডিসেম্বররের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চান তিনি।
নাজিম উদ্দিনের কথায়, “প্রতিবছরই এ বিশেষ দিনে মেয়েকে নিয়ে স্মৃতিসৌধে আসি। আমি চাই আমার মেয়ে দেশের ইতিহাস জানুক।”
ছোট্ট নাবিহাত ফেরদৌসের মত বাবা-মায়ের হাত ধরে বুধবার ভোরে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে দেখা যায় শিশু-কিশোরদের। তাদের হাতে ছিল রক্তবর্ণ গোলাপ; অভিভাবকদের কেউ কেউ গল্পের ছলে তাদের বলছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের ইতিহাস।
বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পাঁচ ভাতিজা-ভাইঝিকে নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন দুর্জয় চৌধুরী। সবার হাতে ছিল গোলাপ। অন্যদের মত তারাও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বীর শহীদদের।
তবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি প্রকৃত সম্মান জানাতে সকলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ব্যবসায়ী হাসান আল মামুন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমাদের দেশের জন্য যে সন্তানেরা প্রাণ দিয়ে গেছেন তাদের প্রতি সেদিনই সম্মান জানানো হবে, যেদিন দেশের সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি হবে।”
পরিবেশকর্মী আবু জায়েদ বলেন, “শহীদের রক্তে গড়া এই দেশের প্রকৃত অর্জন সেদিনই হবে যেদিন আমরা এদেশ থেকে অন্যায়-দুর্নীতি মুছে দিতে পারব। এদেশে যেদিন সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না।“
স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আইরিন সুলতানা বলেন, “শিক্ষাদীক্ষায়, জ্ঞানে-গরিমায় আমার দেশ এগিয়ে যাবে আমরা এই প্রত্যাশাই করি। আমরা চাই আমাদের নতুন প্রজন্ম ইতিহাস জানুক, দেশকে ভালবাসতে শিখুক।“
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের শেষ ভাগে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের এ দেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় হত্যা করেছিল শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ জাতির হাজারো মেধাবী সন্তানকে। ১৪ ডিসেম্বরের সেই দিনটিকে বিশেষ মর্যাদায় বুদ্ধিজীবী দিবস হিসাবে পালন করে আসছে বাংলাদেশের মানুষ।
দিবস উপলক্ষে বুধবার সকালে মিরপুরে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে গিয়ে সেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
স্মৃতিসৌধের বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর আবদুল হামিদ ও শেখ হাসিনা সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।
সশস্ত্র বাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল এ সময় সশস্ত্র সালাম জানায়; বিউগলে বাজানো হয় করুণ সুর।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের সঙ্গে সেখানে কুশল বিনিময় করেন সরকারপ্রধান।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এরপর ডেপুটি স্পিকার মো. শামসুল হক টুকু এবং চিফ হুইপ ও হুইপদের পক্ষ হতে হুইপ ইকবালুর রহিম পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শেষে সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয় স্মৃতিসৌধ এলাকা। জাতীয় পাতাকা আর শ্রদ্ধার ফুল হাতে নানা বয়সের হাজারো মানুষ জড়ো হন শহীদ বেদীতে।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, শাজাহান খান, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া শীর্ষ নেতারা।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, “একাত্তরের পরাজিত শক্তি এখন প্রতিশোধ নিতে চায়, তাই তারা এখন সক্রিয় হয়েছে।”
সকাল সাড়ে ৮টার দিকে শহীদদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আখতারুজ্জামান বলেন, “এই দিনটি জাতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় দিন। এ দিনে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করা হয়।“
পৌঁনে ৯টার দিকে মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিএনপি নেতারা। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আব্দুল মঈন খান, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমানসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
সাংবাদিকদের সামনে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “যে বাংলাদেশের জন্য বুদ্ধিজীবীরা প্রাণ দিয়েছেন সেই বাংলাদেশকে আমরা পুনরুদ্ধার করতে চাই। শহীদ বুদ্ধিজীবীরা যে চেতনার জন্য প্রাণ দিয়ে গেছেন, সেই চেতনাকে আমরা পুনরুদ্ধার করতে কাজ করছি।“
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ পেশাজীবী পরিষদ, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, বাংলাদেশ বাউল সমিতি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ব্যানার ও ফুল হাতে এসে জড়ো হয়ে শ্রদ্ধা জানাতে দেখা যায়।
আরও খবর
ফুলেল শ্রদ্ধায় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ