নারী ভোটার কম: অনাগ্রহ নাকি প্রতিবন্ধকতা?

দেশের জনসংখ্যায় নারী বেশি হলেও ভোটার তালিকায় পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ কম।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2023, 02:56 AM
Updated : 8 March 2023, 02:56 AM

এবারের জনশুমারিতে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি থাকলেও ভোটার তালিকায় দেখা গেছে বিপরীত চিত্র। 

প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে এখন প্রায় ১২ কোটি ভোটার। চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় নারীর চেয়ে পুরুষের সংখ্যা ১৭ লাখ ৪০ হাজার বেশি। অথচ জনশুমারিতে নারী বেশি রয়েছে ১৬ লাখ ৩৪ হাজার। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, জনসংখ্যায় যেহেতু নারীর সংখ্যা বেশি, স্বাভাবিকভাবে নারী ভোটারও বেশি থাকার কথা। কিন্তু বাড়ি বাড়ি গিয়ে ব্যাপক প্রচারের অভাব, নানা প্রতিবন্ধকতা, প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের মধ্যে আগ্রহ বা সুযোগের অভাব ভোটার সংখ্যায় ওই উল্টো চিত্রের কারণ ঘটাতে পারে।

ছবিসহ ভোটার তালিকা শুরুর পর থেকে নারী-পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান সমান থাকলেও গত ১৫ বছরে হালনাগাদে নারী ভোটারদের সাড়া মিলেছে কম। অথচ নারীদের ভোটার করা নিশ্চিতে স্থানীয় মহিলা জনপ্রতিনিধি, বিশেষ করে জেলা, উপজেলা, সিটি, পৌর ও ইউপি’র সংরক্ষিত আসনের সদস্যদের সহযোগিতা নেওয়া হয়। 

ভোটার তালিকায় এই বৈপরীত্যের পেছনে নারীর অনাগ্রহকে কারণ বলে মানতে রাজি নন নারীনেত্রী ডা. ফওজিয়া মোসলেম। 

তিনি বলেন, “জনসংখ্যায় বেশি হওয়ার পরও ভোটার সংখ্যায় নারী কম হলে প্রশ্ন তো উঠতেই পারে। আমরা বারবার বলি,ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে ভোটার করতে। ভোটার হতে নারীদের আগ্রহ থাকলেও নানা প্রতিবন্ধকতায় অনেকে ভোটার হতে পারে না। এ কাজটা নির্বাচন কমিশনকে করতে হবে।” 

ব্যবধান কমাতে ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করতে বছর জুড়ে উদ্যোগের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলসহ সবক্ষেত্রে কিছু প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করার তাগিদ দেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম।

সেই সঙ্গে ভোটার অনুপাতে ভোটকেন্দ্রে বুথের সংখ্যা বাড়ানো এবং ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ ‘নারীবান্ধব’ করার ওপর জোর দেন তিনি। 

  • দেশে এখন ভোটার ১১ কোটি ৯১ লাখ ৫১ হাজার ৪৪০ জন, যারা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন।

  • মোট ভোটারের মধ্যে ৬ কোটি ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৫৭২ জন পুরুষ, ৫ কোটি ৮৭ লাখ ৪ হাজার ৮৭৯ জন নারী এবং ৮৩৭ জন হিজড়া। 

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গ তুলে ধরে মহিলা পরিষদের সভাপতি বলেন, “নারীর ক্ষমতায়নে সব স্তরের কমিটিতে নির্দিষ্ট সংখ্যক নারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যমাত্রা রাখতে হবে। সেই সঙ্গে নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের জন্য ১০-২০% নিশ্চিত করে ইশতেহার দিতে হবে।

“সাধারণ, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক নারীরা যাতে নির্বাচনে অবাধে নিজের মতামতের ভিত্তিতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।” 

  • জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ জন, নারী সংখ্যা ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন। আর হিজড়া আছেন ১২ হাজার ৬২৯ জন।

  • গত ২৭ জুলাই প্রকাশিত প্রাথমিক প্রতিবেদনে মোট জনসংখ্যা দেখানো হয় ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। পরে ৬ ফেব্রুয়ারি বিআইডিএস এর পর্যালোচনায় জনসংখ্যা বেড়ে হয় ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন।

  • সবশেষ ২০১১ সালের শুমারিতে ১৪ কোটির বেশি জনসংখ্যায় পুরুষের চেয়ে কম ছিল নারীর সংখ্য। সে সময় পুরুষ ছিলেন ৭ কোটি ২১ লাখ ৯ হাজার ৭৯৬ জন, নারী ছিলেন ৭ কোটি ১৯ লাখ ৩৩ হাজার ৯০১ জন।

নির্বাচন বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক আব্দুল আলীম বলেন, ২০০৭-০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও জাতীয় পরিচয়পত্রের কাজ শুরু করার পর থেকে ‘নির্ভুলভাবে ও উৎসাহব্যঞ্জকভাবে’ সেই কাজ চলছে। কিন্তু প্রতি বছর বা নির্দিষ্ট সময় পর পর হালনাগাদের সময় ব্যাপক ও কার্যকর প্রচার দরকার।

তিনি মনে করেন, জনসংখ্যায় ১৭ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে নারীর সংখ্যা যদি বেশি হয়, তাহলে সেটা ভোটার তালিকায় নারীর সংখ্যা কম হওয়ার একটা কারণ হতে পারে।

তবে সার্বিকভাবে ভোটার হতে নারীদের ‘অনাগ্রহ’ দেখার কথা জানিয়ে আব্দুল আলীম বলেন, “প্রবীণ অনেকেই রয়েছেন, যাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, এনআইডি সেবা নিচ্ছেন না, ভোটারও হতে চায় না। 

“ভোট নিয়ে আবার অনেকের রয়েছে গোলযোগ ভীতি, এক ধরনের অনাস্থা রয়েছে, তাদের ভোটার হতেও আগ্রহ থাকে না। ভোটার করতে প্রচারটা দোরগোড়ায় পৌঁছাচ্ছে কিনা, তাছাড়া ভোটের পরিবেশ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, ভোটকেন্দ্রসহ সংশ্লিষ্ট জায়গায় নারীদের জন্য আলাদা কিছুর অভাবও এর কারণ হতে পারে।” 

নারী ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করতে নির্বাচন কমিশনকে ‘জেন্ডার পলিসি’ করার আহ্বান জানান ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের সাবেক পরিচালক আব্দুল আলীম। 

তিনি বলেন, “ভোটের সময় জেন্ডার ডেস্ক খুলতে হবে, যেখানে নারীরা এ সংক্রান্ত সহায়তা পাবেন। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগে একটা টার্গেট সেট করবে কত শতাংশ নারী থাকবে, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মনোনয়ন দেওয়ার প্রক্রিয়ায় নারীদের জন্য লক্ষ্যমাত্রা দেবে। সবাই মিলে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে ভোটার, প্রার্থী সর্বত্র তারা সমানে সমান হবে।”

>> ভোটার তালিকায় নারী ভোটার কম হওয়ার জন্য কে এম নূরুল হুদা কমিশন আটটি কারণ চিহ্নিত করে গিয়েছিল

>> নির্ধারিত ফি দিয়ে জন্মনিবন্ধন সনদ সংগ্রহে অনীহা, হিন্দু বিবাহিত নারীদের পিত্রালয়ে নিবন্ধনে অনীহা, অবিবাহিত নারীদের ভোটার হতে অনীহা, বাবা-মা’র জাতীয় পরিচয়পত্র দিতে ব্যর্থ হওয়া, রেজিস্ট্রেশন কেন্দ্র দূরে হওয়া, আবহাওয়া অনুকূল না থাকা, ধর্মীয় অজুহাতে ছবি তুলতে অনীহা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীদের অসচেতনতার কথা বলা হয়েছিল সেখানে।

কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন কমিশন গত বছর দায়িত্ব নেওয়ার পর বছরের মাঝামাঝি সময়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ শুরু হয়। এ বছর ২ মার্চ ভোটার দিবসে দেশের চূড়ান্ত ভোটার সংখ্যা প্রকাশ করেন সিইসি। 

নারী ভোটার কম হওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, “শুধু নারী নন, আমাদের চেষ্টা নারী-পুরুষ ভোটারযোগ্য সবাইকে ভোটার করার। ভোটার হতে অনাগ্রহ রয়েছে এমন বিষয় না থাকলেও কিছু কুসংস্কার রয়ে গেছে অনেক এলাকায়। চাঁদপুরের একটি এলাকায় তো নারীরা ভোট দিতে যান না বলে সবার জানা রয়েছে। নির্বাচন কমিশন সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।” 

বাড়ির বাইরে বিভিন্ন কাজে গেলেও চাঁদপুরের দক্ষিণ রূপসা ইউনিয়নের নারীরা ‘প্রায় অর্ধশতাব্দী’ ভোট দেন না। ইউনিয়নটির জনপ্রতিনিধিদের ভাগ্য নির্ভর করে পুরুষ ভোটারদের ওপর। এমনকি সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যরাও নির্বাচিত হন শুধু পুরুষদের ভোটে।

অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, “স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সবার সহযোগিতায় নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ণের অঙ্গীকার ইসির। মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভোটার হওয়া ও রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়া ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপও রয়েছে। সবার জন্যে নির্বিঘ্ন পরিবেশ নিশ্চিতের পাশাপাশি গোলযোগ, সহিংসতা, নারী ভোটাদের ভীতি প্রদর্শনের বিষয়গুলো রোধে নির্বাচনের সময়ে আইন শৃঙ্খলা বৈঠকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার হয়।”

তার ভাষায়, জনসংখ্যার সঙ্গে ভোটার তালিকার যে বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে, তা ‘পরিসংখ্যানগত’। ভোটার করতে হালনাগাদে তথ্য সংগ্রহকারীরা বাড়ি বাড়ি যান। কেউ যেন তালিকার বাইরে না থাকে সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা থাকে। কোনো কারণে বাদ পড়েছে এমন সংখ্যা হয়ত নগন্য।  

পুরনো খবর

Also Read: জনশুমারি: চূড়ান্ত হিসাবে জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ

Also Read: দেশে গড় আয়ু বেড়েছে, পুরুষের চেয়ে নারীর ৩ বছর বেশি

Also Read: ‘পিরের মানা’, ভোট দেন না চাঁদপুরের দক্ষিণ রূপসার নারীরা

Also Read: বাংলাদেশে ভোটার এখন প্রায় ১১ কোটি

Also Read: ১৮ জেলায় নারী ভোটার বেশি

Also Read: এবার হালনাগাদে নতুন ভোটার প্রায় ৮০ লাখ

Also Read: ভোটারের বাড়ি যান, বিড়ম্বনা গায়ে মাখবেন না: সিইসি

Also Read: বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ শুরু শুক্রবার

Also Read: দেশে ভোটার এখন ১১ কোটি ৯১ লাখ